২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ১১ পৌষ ১৪৩১, ২৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ ও পৃথক সচিবালয় গঠনে অগ্রগতি নেই

উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব
-


সংবিধানের ২২ অনুচ্ছেদে নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া সংবিধানের চতুর্থ তফসিলের অন্তর্গত ‘অন্তর্বর্তীকালীন ও সাময়িক বিধানাবলী’র দফা ৬(৬) অনুযায়ী অধস্তন আদালত সম্পর্কিত সংবিধানের ষষ্ঠ ভাগের ২য় পরিচ্ছেদের বিধানাবলি যথাশিগগিরই সম্ভব বাস্তবায়নের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার আলোকে সুপ্রিম কোর্টের প্রস্তাবিত পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি, শৃঙ্খলা, ছুটি ইত্যাদি বিষয়ে প্রচলিত দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটবে এবং বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এ লক্ষ্যে গত ২৭ অক্টোবর সুপ্রিম কোর্ট থেকে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠনসংক্রান্ত প্রস্তাব আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। ওই প্রস্তাবে সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে হাইকোর্ট বিভাগ কর্তৃক অধস্তন আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ যথাযথরূপে পালনের উদ্দেশ্যে একটি স্বতন্ত্র সচিবালয় প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি অধ্যাদেশের খসড়া, প্রস্তাবিত সচিবালয়ের অর্গানোগ্রাম এবং রুলস অব বিজনেস ও অ্যালোকেশন অব বিজনেসের সম্ভাব্য সংস্কার সম্পর্কে পরিপূর্ণ প্রস্তাব আইন মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়।

আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠার সুপ্রিম কোর্ট প্রস্তাবের ব্যাপারে আইন মন্ত্রণালয় ও আইন উপদেষ্টার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এ বিষয়ে কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তবে কোনো অগ্রগতির তথ্য পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, রাজনৈতিক সরকারগুলোর সময় দীর্ঘ দিনে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণে অনীহা দেখে গেছে। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়েই বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠন ও বিচার বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সম্ভব। তাদের মতে, দ্বৈত শাসন ভাঙার সময় এখনই। কিন্তু এ বিষয়ে আশানুরূপ অগ্রগতি নেই।
সম্প্রতি পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় সম্পর্কে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল সচিবালয়ে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, এটি নিয়ে বিভিন্ন রকম মতামত রয়েছে। এমনকি মাসদার হোসেনের রায় শুনেছেন না, রায়ে অভিমতে লেখা হয়েছে, মাসদার হোসেনের রায় কার্যকর করার জন্য পৃথক সচিবলায় করা দরকার। মাসদার হোসেন সাহেব নিজে আমাকে বলেছে মাসদার হোসেনের রায়ে পৃথক সচিবলায়ের কথা বলা নেই। উনি নিজে বলেছেন। তিনি আরো বলেন, এখানে উচ্চ আদালতে যারা বিচারক আছেন, নিম্ন আদালতে যারা বিচারক আছেন। স্টেকহোল্ডার যারা আছেন সবার বিভিন্ন রকম মতামত আছে। আমরা খুব উচ্চপর্যায়ে মিটিং করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেব।

সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন থেকে জানানো হয়েছে, গত ১০ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্ট রেজিস্ট্রির তিনজন কর্মকর্তা আইন ও বিচার বিভাগের সচিব মহোদয়ের কক্ষে আইন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক প্রস্তাবিত বিচার বিভাগীয় সচিবালয়ের বিভিন্ন কৌশলগত বিষয় সম্পর্কে প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন। এর ফলে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠনের বিষয়টি আবার বেগবান হয়। বর্তমানে বিচার বিভাগীয় সচিবালয় তৈরির বিষয়টি আইন মন্ত্রণালয়ে সক্রিয়ভাবে প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। আশা করা যায় যে, অচিরেই বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবালয় স্থাপনের বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয় কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপগুলো দৃশ্যমান হবে। পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় প্রতিষ্ঠিত হলে অধস্তন আদালতের বিচারকদের পদায়ন, বদলি, পদোন্নতি, শৃঙ্খলা, ছুটি ইত্যাদি বিষয়ে প্রচলিত দ্বৈত শাসনের অবসান ঘটবে এবং বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব : গত ২১ সেপ্টেম্বর প্রধান বিচারপতি কর্তৃক ঘোষিত রোডম্যাপের ধারাবাহিকতায় ইতোমধ্যে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়নের কাজ চলমান রয়েছে। প্রতিবেশী দেশগুলোসহ বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে যেসব প্রক্রিয়া অনুসৃত হয়, তা গভীরভাবে বিশ্লেষণপূর্বক এ-সংক্রান্ত একটি অধ্যাদেশের খসড়া প্রস্তুত করে ওই খসড়া সম্পর্কে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের উভয় বিভাগে কর্মরত বিচারপতিদের মতামত গ্রহণের জন্য খসড়াটি গত ১৪ নভেম্বর বিচারপতি মহোদয়দের কাছে প্রেরণ করা হয়। বিচারপতিদের কাছ থেকে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগসংক্রান্ত মোট ১৫টি মতামত পাওয়া যায়। প্রাপ্ত মতামতগুলো নিরীক্ষাপূর্বক সুপ্রিম কোর্টের সুপারিশটি গত ২৮ নভেম্বর আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়।
সুপ্রিম কোর্টের ওই প্রস্তাবে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের জন্য একটি জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। বিশ্বের অন্যান্য দেশ যেমন- ইংল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, কেনিয়া, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ভারত ও পাকিস্তানে উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগে স্বাধীন নিরপেক্ষ কমিশন বা অনুরূপ প্রতিষ্ঠান বিদ্যমান রয়েছে।

সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃক প্রেরিত প্রস্তাবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে নিয়োগের লক্ষ্যে উপযুক্ত ব্যক্তি বাছাইক্রমে রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করার জন্য একটি জুডিশিয়াল অ্যাপয়েন্টমেন্ট কাউন্সিল গঠনের কথা বলা হয়েছে। প্রধান বিচারপতির সভাপতিত্বে ওই কাউন্সিলের মোট সদস্য সংখ্যা হবে ১০ জন। প্রধান বিচারপতি ওই কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হবেন। এ ছাড়া ওই কাউন্সিলের সদস্যরা হবেন যথাক্রমে- আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম জ্যেষ্ঠ বিচারক, আপিল বিভাগের কর্মে প্রবীণতম দ্বিতীয় জ্যেষ্ঠ বিচারক, হাইকোর্ট বিভাগের কর্মে প্রবীণতম জ্যেষ্ঠ বিচারক, অধস্তন আদালতের বিচারক হতে হাইকোর্ট বিভাগের বিচারক হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন এরূপ বিচারকদের মধ্য হতে কর্মে প্রবীণতম জ্যেষ্ঠ বিচারক, বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন কর্তৃক মনোনীত বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন আইনের অধ্যাপক এবং দুইজন নাগরিক প্রতিনিধি। প্রস্তাবটিতে নাগরিক প্রতিনিধি নিযুক্ত করার নিয়ামাবলি সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, কাউন্সিলের শিক্ষক সদস্য ব্যতিরেকে অন্যান্য সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রণীত বিধি মোতাবেক, কিংবা এরূপ বিধি প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত কাউন্সিলের চেয়ারম্যানের লিখিত আদেশ অনুসারে দুই বছরের জন্য নাগরিক সদস্যরা নিযুক্ত হবেন।

সুপ্রিম কোর্টের বিচারক পদে উপযুক্ত প্রার্থীকে সুপারিশ প্রদানসহ কাউন্সিলের যেকোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠ মতামতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে মর্মে প্রস্তাবে উল্লেখ রয়েছে। সংবিধানের ৯৫ ও ৯৮ অনুচ্ছেদের অধীনে বিচারক নিয়োগের নিমিত্ত সুপারিশ প্রদান করার জন্য রাষ্ট্রপতি কর্তৃক অনুরোধ জ্ঞাপন করা হলে কাউন্সিল সম্ভাব্য প্রার্থীদের কাছ থেকে দরখাস্ত আহ্বান করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করবে মর্মে প্রস্তাবে সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া কাউন্সিল প্রাথমিকভাবে বাছাইকৃত প্রার্থীদের বিষয়ে মতামত বা পরামর্শ গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্ট যেকোনো ব্যক্তিকে কাউন্সিলের সভায় আহ্বান করতে পারবে বা যেকোনো সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে কাউন্সিল কর্তৃক চাহিদাকৃত তথ্য উপস্থাপনের নির্দেশ প্রদান করতে পারবে মর্মে প্রস্তাবে উল্লেখ রয়েছে। কাউন্সিলটি গঠিত হলে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত হবে।

আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, উচ্চ আদালতের বিচার নিয়োগের আইনটি চূড়ান্তপর্যায়ে রয়েছে। আগামী শনিবার এ বিষয়ে উচ্চপর্যায়ে আলোচনা হওয়ার কথা রয়েছে বলেও জানা গেছে।
এ বিষয়ে সম্প্রতি আইন উপদেষ্টা বলেছেন, হাইকোর্ট বিভাগ ও আপিল বিভগের বিচারক নিয়োগে নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন সরকারের আমলে অনেক অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। এটিকে অ্যাডড্রেস করার জন্য আমরা আইন প্রণয়নের চেষ্টা করছি। এ ব্যাপারে পরামর্শ নেয়ার জন্য আমি বিচার বিভাগীয় সংস্কার কমিশনের কাছে গিয়েছিলাম। উনারাও আমাদের সাহায্য করছেন। এটি নিয়ে আমাদের উচ্চ আকাক্সক্ষা রয়েছে। তিনি আরো বলেন, পরবর্তীতে হাইকোর্টে যে নতুন বিচারক নিয়োগ হবে। উনারা এই আইনের মাধ্যমে হবেন। কারো পছন্দ সুপারিশ এসবের ভিত্তিতে না।

এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, প্রধান বিচারপতি বিচার বিভাগের সংস্কারের যে প্রস্তাব দিয়েছেন স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠার জন্য তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ছিল না বলেই দেশে ভোটারবিহীন নির্বাচন হয়েছে। লুটপাট হয়েছে। তিনি বলেন, সংবিধানে স্বাধীন বিচার বিভাগের কথা বলা আছে। স্বাধীন বিচার বিভাগের জন্য পৃথক সচিবলায় দরকার। আইন মন্ত্রণালয় থেকে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ আলাদা করতে হবে। তিনি বলেন, আমি সরকারের আইন উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান জানাবো কালক্ষেপণ না করে পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠনের কাজ দ্রুত বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।

এ বিষয়ে এসসিবিএ সংবিধান সংরক্ষণ কমিটির সাধারণ সম্পাদক এবং স্বাধীন বিচার বিভাগ ও বার প্রতিষ্ঠার অন্যতম সমন্বয়ক অ্যাডভোকেট সৈয়দ মামুন মাহবুব বলেন, জুলাই ৩৬ গণবিপ্লবের পর বিচার বিভাগের বৈপ্লবিক পরিবর্তন তো দূরের কথা ন্যূনতম সাংবিধানিক আদালতের চরিত্রই এখনো ফিরে আসেনি। তিনি বলেন, বিচারপতি আর আইনজীবীরা স্বাধীন বললে হবে না। জনগণ এখানে মনে করছে কি না যে বিচার বিভাগ স্বাধীন হচ্ছে। বিচার বিভাগে দ্বৈত শাসনের অবসান এবং পৃথক বিচার বিভাগীয় সচিবালয় গঠনের এখনই প্রকৃত সময়।


আরো সংবাদ



premium cement
সচিবালয়ের আগুন নিয়ন্ত্রণে, এক গেট দিয়ে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রবেশ কাপ্তাইয়ে ৪২ ঘণ্টা পর ভেসে উঠলো ২ বন্ধুর লাশ কুড়িগ্রামে খেজুর রসের ঐতিহ্যে ভাটা সচিবালয়ে আগুন : তদন্ত কমিটি গঠনের কথা জানালেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বান্দরবানে ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগে সরকারের নিন্দা কুড়িগ্রামে আ.লীগ-ছাত্রলীগের ২ নেতা গ্রেফতার জড়িতদের বিন্দুমাত্র ছাড় দেয়া হবে না : আসিফ মাহমুদ সচিবালয়ের আগুন নিয়ন্ত্রণে সচিবালয়ের আগুন লাগা ভবনেই উপদেষ্টা নাহিদ-আসিফের মন্ত্রণালয় নিয়ন্ত্রণে আসেনি সচিবালয়ের আগুন, কাজ করছে ২০ ইউনিট ট্রাকচাপায় আহত সেই ফায়ার সার্ভিস কর্মীর মৃত্যু

সকল