চিঠির জবাব পেলে হাসিনাকে ফেরানোর পরবর্তী পদক্ষেপ
- কূটনৈতিক প্রতিবেদক
- ২৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৩:৫৩
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর জন্য ভারতকে যে কূটনৈতিক পত্র দেয়া হয়েছে, তার জবাব এলে বাংলাদেশ পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে।
গতকাল সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মুখপাত্র মোহাম্মদ রফিকুল আলম এ কথা জানান। গত জুলাই ও আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান দমনে গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর তা তামিল করার পদক্ষেপ নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এরই প্রেক্ষাপটে গণ-অভ্যুত্থানের মুখে দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নেয়া শেখ হাসিনাকে ফিরিয়ে দিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে দিল্লিকে নোট ভারবাল পাঠিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। ঢাকার ভারতীয় হাইকমিশনের মাধ্যমে নোট ভারবাল ভারত সরকারের কাছে পৌঁছেছে বলে জানিয়েছেন দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রনধির জয়সোওয়াল। তবে জয়সোওয়াল এ ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
শেখ হাসিনাকে ভারত থেকে ফেরানোর বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানান, শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে ভারতকে চিঠি দেয়া হয়েছে। এই চিঠির জবাব এখনো আসেনি। উত্তর এলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।
আরেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, স্বাভাবিক সময়ের মধ্যে চিঠির জবাব না এলে ভারতকে তাগাদাপত্র দেয়া হবে।
স্বাভাবিক সময় বলতে কত দিন বোঝায় তা জানতে চাইলে মুখপাত্র বলেন, এটি নির্ভর করে কোনো বিষয়ের ওপর কথা হচ্ছে। আমরা যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করছি, সেটি অত্যন্ত সংবেদনশীল। এর স্বাভাবিক সময় ব্র্যাকেটিং করার সুযোগ নেই। এসব ক্ষেত্রে কোনো কোনো বিষয়ে কখনো কখনো বছরের পর বছর লেগে যায়। সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনার বর্তমান স্ট্যাটাসটা কী, ভারত সরকার তা জানিয়েছে কিনা জানতে চাইলে রফিকুল আলম বলেন, এ বিষয়ে বিগত দিনগুলোতে বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যম থেকে আমরা প্রশ্ন পেয়েছি। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্র সচিব এটার উত্তর দিয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে আমার মন্তব্য করার সুযোগ নেই। আমি সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারব না।
গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে সেখানেই আছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। তার দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের কয়েকজন গ্রেফতার হলেও অনেকেই এখনো দেশে-বিদেশে আত্মগোপনে রয়েছেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল থেকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির পর বিদেশে অবস্থানরত আসামিদের ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের মাধ্যমে ‘রোড নোটিশ’ জারির উদ্যোগ নিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী জানিয়েছেন, বাংলাদেশের সাথে ভারতের প্রত্যর্পণ চুক্তি রয়েছে। এই চুক্তির আওতায় ভারতে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা যেতে পারে।
বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বন্দী প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত প্রথম খসড়া চুক্তিটি ২০১৩ সালে স্বাক্ষরিত হয়। পরে ২০১৬ সালে চুক্তিটির সংশোধিত সংস্করণে স্বাক্ষর করে দিল্লি ও ঢাকা। মূলত দুই দেশের সন্ত্রাসবাদ ও বিচ্ছিন্নতাবাদের সাথে সংশ্লিষ্টদের বিনিময়ের উদ্দেশ্যেই চুক্তিটি স্বাক্ষর করা হয়েছিল।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশে দায়িত্ব পালন করে যাওয়া ভারতের সাবেক হাইকমিশনার মহেশ সাচদেব গতকাল ভারতীয় সংবাদমাধ্যম এএনআইকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে বন্দী প্রত্যর্পণ চুক্তিটি রয়েছে, সেটি অনেক সতর্কভাবে করা। এ চুক্তিটি রাজনৈতিক ইস্যুতে প্রত্যপর্ণ প্রত্যাখ্যান করে, কিন্তু রাজনৈতিক বিবেচনায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে আমলে নেয়। বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশটির বর্তমান সরকারের প্রত্যর্পণের অনুরোধের বিরুদ্ধে ভারতের আদালতের দ্বারস্থ হতে পারেন। আদালতে তিনি লিখিতভাবে আবেদন জানাতে পারেন, ভারতের সরকার তাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠালে তার সাথে অন্যায় আচরণ করা হবে। আবার বাংলাদেশের সরকারকে ভারত জানাতে পারে, শেখ হাসিনাকে ফেরত পাঠানো হলে তার সাথে ন্যায়বিচার করা হবে কিনা সে সম্পর্কে দিল্লি নিশ্চিত নয়। ভারতের অনেক তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আছে। কিন্তু দিল্লির বারবার অনুরোধ সত্ত্বেও তাদের ফেরত পাঠানো হচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে ইউরোপ বলেছে, ভারতের বিচারব্যবস্থা ও কারাগারগুলোর মান নিয়ে তাদের সংশয় রয়েছে। এখন এ পদক্ষেপগুলো বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অনুসরণ করা যেতে পারে।
সাবেক এই ভারতীয় রাষ্ট্রদূত বলেন, আমার মনে হয় শেখ হাসিনা ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় চাইবেন। যদি তিনি আশ্রয় চেয়ে আবেদন করেন, সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিবেচনায় এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে দিল্লি। আর এ ক্ষেত্রে কোনো নির্দিষ্ট নিয়ম নেই। অর্থাৎ কোনো নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে আবেদন করতে হবে, এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। আর এ কথা তো আমরা সবাই জানি যে তিনি যখন ঢাকা ছেড়ে এসেছিলেন, সে সময় তাকে অস্থায়ীভিত্তিতে আশ্রয় দিয়েছিল ভারত। কারণ তখন ধারণা করা হয়েছিল, শিগগিরই ভারত থেকে অন্য কোনো দেশে তিনি চলে যাবেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে আশ্রয় চেয়ে আবেদনও করেছিলেন। কিন্তু দুই দেশই তার আবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে। এ কারণেই তিনি এখানে রয়েছেন। এখন যেহেতু তিনি এখানে রয়েছেন, তাকে যদি আমরা বহিষ্কার করি, সে ক্ষেত্রে তা খুবই অনৈতিক একটি কাজ হবে। আর রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে সরকারপ্রধানদের নিজ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হওয়ার ঘটনা তো নতুন কিছু নয়। এই চলতি মাসেই সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ নিজ দেশ ছেড়ে রাশিয়ায় গিয়েছেন এবং রাশিয়া তাকে বিনা বাক্যব্যয়ে আশ্রয় দিয়েছে। মহেশ সাচদেব বলেন, আসলে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক, তাতে কাগজপত্র বা নথি বড় কোনো নির্ধারকের ভূমিকায় নেই। এমন অনেক ব্যাপার এখানে রয়েছে যেসব চোখে দেখা যায় না, রাডারেও ধরা পড়ে না। সম্পর্কই এর গতিপ্রকৃতি নির্ধারণের সবচেয়ে বড় নিয়ামক।
ভূমধ্যসাগরে আট বাংলাদেশী নিহত : লিবিয়ার নৌবাহিনী ভূমধ্যসাগর থেকে বাংলাদেশী অভিবাসীসহ মোট ৮২ জনকে জীবিত ও ১৫ জনকে মৃত উদ্ধার করেছে। নিহতদের মধ্যে আটজন বাংলাদেশী।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাপ্তাহিক ব্রিফিংয়ে মুখপাত্র এ কথা জানান। তিনি বলেন, ১২১ অভিবাসী বহনকারী একটি নৌকা গত ১৮ ডিসেম্বর লিবিয়ার উপকূলে ভূমধ্যসাগরে বিধ্বস্ত হয়েছে। লিবিয়ার নৌবাহিনী ঘটনাস্থল থেকে ৮২ জনকে জীবিত এবং কমপক্ষে ১৫ জনের মৃতদেহ উদ্ধার করেছে। এ ঘটনার পর স্থানীয় রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির একজন স্বেচ্ছাসেবক লিবিয়ার ত্রিপলিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসকে নিশ্চিত করেছেন, উদ্ধারকৃতদের মধ্যে ২৪ জন বাংলাদেশী রয়েছেন। এ ছাড়া আটজন বাংলাদেশীর লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। জীবিতদের বর্তমানে ত্রিপলি থেকে ৮০ কিলোমিটার পশ্চিমে অবস্থিত জাওয়াইয়া সিটিতে রাখা হয়েছে। নিহতদের মৃতদেহ পাবলিক প্রসিকিউশনের তত্ত্বাবধানে জাওয়াইয়া হাসপাতালে রাখা হয়েছে। নিখোঁজদের মধ্যে আরো বাংলাদেশী নাগরিক থাকতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
রফিকুল আলম জানান, এ দুর্ঘটনায় নিহত বাংলাদেশীদের পরিচয় নিশ্চিত করতে ত্রিপলিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস কাজ করছে। দূতাবাসের কর্মকর্তারা লিবিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নিয়ে বেঁচে থাকা ব্যক্তিদের সাথে দেখা করার চেষ্টা করছে। তাদের সাথে দেখা করার পরে এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত তথ্য জানা যাবে। ত্রিপলিতে অবস্থিত দূতাবাসের সাথে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা