বে-টার্মিনালে দিনে ক্ষতি ১০ লাখ ডলার
বিশ্বব্যাংকের সমীক্ষার তথ্য- নূরুল মোস্তফা কাজী চট্টগ্রাম ব্যুরো
- ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:০৩
বেসরকারি বিনিয়োগে বাস্তবায়ন এবং পরিচালনার মাধ্যমে দৈনিক প্রায় এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার হিসাবে বছরে ৩৬৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সাশ্রয় করতে পারে বাংলাদেশের অর্থনীতি। সম্প্রতি বিশ্বব্যাংকের বে-টার্মিনাল সম্পর্কিত এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। আর বে-টার্মিনাল বাস্তবায়নে শম্বুক গতির ফলে যতই পেছাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রতিদিনই এক মিলিয়ন মার্কিন ডলার লস করছে বলে মনে করছেন শিপিং-সংশ্লিষ্টরা।
‘চিটাগং পোর্ট : নিডস ক্যাপাসিটি এক্সপানশন’ শীর্ষক ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী, দুই হাজার জাহাজ ও ৩২ লাখ ৭০ হাজার টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিংয়ের তথ্য উল্লেখ করে এতে বলা হয়েছে, এই টার্মিনাল বাস্তবায়ন হলে প্রতিটি জাহাজের অপেক্ষমাণ সময় চার দিন পর্যন্ত বেঁচে যাবে। জাহাজপ্রতি দৈনিক পাঁচ হাজার ডলার পরিচালন ব্যয় হিসাবে বছরে ১৬০ মিলিয়ন ডলার শিপিং লাইন কস্ট সাশ্রয় হবে। এ ছাড়া কনটেইনার ডেলিভারিতেও চার দিন সময় সাশ্রয় হবে এবং এতে ২০৩ মিলিয়ন ডলার ইনভেন্ট্রি কস্ট কমবে বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। জাহাজ ও কনটেইনার উভয় ক্ষেত্রে বছরে ৩৬৩ মিলিয়ন ডলার সাশ্রয় হবে বলে এতে উল্লেখ করা হয়েছে।
বে-টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার এবং এক্সেস চ্যানেল নির্মাণে ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাংক বোর্ড সভায় গত ২৮ জুন ৬৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। এই ঋণের আওতায় জলবায়ুঝুঁকি সহনশীল একটি ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ ছাড়াও চ্যানেলে ক্যাপিটাল ড্রেজিং, ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ভিটিএমএস) প্রস্তুত করা হবে। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্পে কনসালট্যান্সি সার্ভিসও দেবে।
কেন বে-টার্মিনাল : প্রথমত দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে পণ্য হ্যান্ডলিং সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং রফতানিমুখী গার্মেন্টশিল্পের প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়াবে। দেশের অর্থনৈতিক সম্প্রসারণে সহায়ক হবে।
এই টার্মিনাল অর্থনৈতিক মানদণ্ডে পূর্ব এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে নৌসংযোগ সৃষ্টি করবে এবং আমদানি-রফতানি বাণিজ্যে ভারসাম্য আনতে ভূমিকা রাখবে। বে-টার্মিনাল বাস্তবায়ন হলে বন্দরে কোনো ধরনের কনজেশনের মতো পরিস্থিতি থাকবে না। জাহাজের অপেক্ষমাণ সময় অনেকাংশেই কমে যাবে।
এক নজরে বে-টার্মিনাল : আলোচিত এই মেগা প্রকল্পে দু’টি কনটেইনার টার্মিনাল এবং একটি মাল্টিপারপাস টার্মিনাল থাকবে। ৩৫০ মিটার প্রশস্ত চ্যানেল ও বেসিনকে ঢেউয়ের হাত থেকে রক্ষায় নির্মাণ করা হচ্ছে ছয় কিলোমিটার প্রশস্ত ব্রেকওয়াটার।
চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান কর্ণফুলী চ্যানেলে সর্বোচ্চ ৯.৫ মিটার গভীরতার এবং ১৮০-১৯০ মিটার প্রশস্ত জাহাজ প্রবেশ করতে পারে। এসব জাহাজে সর্বোচ্চ দুই হাজার টিইইউএস কনটেইনার পরিবাহিত হয়। কিন্তু বিপরীতে বে-টার্মিনালে সাড়ে ১১মিটার গভীরতা ২৮৫-৩০০ মিটার প্রশস্ত জাহাজ অনায়াসেই চলাচল করতে পারবে এবং এসব জাহাজের একেকটি সাড়ে চার হাজার থেকে পাঁচ হাজার টিইইউএস কনটেইনার পরিবহন করতে পারবে।
তা ছাড়া বিদ্যমান বন্দর চ্যানেলের দূরত্ব বহির্নোঙরের আলফা অ্যানকারেজ থেকে ১১ কিলোমিটার এবং বন্দরের গমনাগমনকারী জাহাজগুলোহকে জোয়ার-ভাটার ওপর নির্ভর থাকতে হয়। কিন্তু বে-টার্মিনালের দূরত্ব আলফা অ্যানকারেজ থেকে মাত্র চার কিলোমিটার এবং সেখানে জোয়ার-ভাটার কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না বিধায় সর্বক্ষণই জাহাজ চলাচল করতে পারবে।
বন্দর সূত্র জানিয়েছে, বে-টার্মিনাল বাস্তবায়নে ব্যয় হবে প্রায় তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার। সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী সেখানে শুরুতেই প্রায় এক হাজার ৩০০ মানুষের কর্মসংস্থান হবে।
বে-টার্মিনালের তিনটি টার্মিনালের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ নিজস্ব অর্থায়ন ও ব্যবস্থাপনায় চারটি জেটি-সংবলিত একটি এক হাজার ৫০০ মিটার দৈর্ঘ্য ও ৭৫০ মিটার প্রস্থবিশিষ্ট মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনা করবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ এ নিয়ে আবুধাবি পোর্ট কর্তৃপক্ষের সাথে একটি নন বাইন্ডিং এমওইউ সই করেছিল।
এ ছাড়া পিপিপি’র আওতায় জি টু জি কনসেশন চুক্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক টার্মিনাল অপারেটর পিএসএ, সিঙ্গাপুর কনটেইনার টার্মিনাল-১ (এক হাজার ২২৫ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৭৫০ মিটার প্রস্থবিশিষ্ট) এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে ডিপি ওয়ার্ল্ড কনটেইনার টার্মিনাল-২ (এক হাজার ২২৫ মিটার দৈর্ঘ্য এবং ৭৫০ মিটার প্রস্থবিশিষ্ট) বাস্তবায়ন করবে।
২০১৮ সালের ১২ মার্চ সিঙ্গাপুরে ইন্টারন্যাশনাল এন্টারপ্রাইজ সিঙ্গাপুর (ইএসজি) এবং বাংলাদেশের পিপিপি অথরিটির সাথে এমওইউ সই হয়। পরবর্তী সময়ে ২০১৯ সালে ইএসজি পিএসএ ইন্টারনাশনাল প্রাইভেট লিমিটেড সিঙ্গাপুরকে এই টার্মিনালে বিনিয়োগের জন্য মনোনীত করে।
এ ছাড়া ২০১৯ সালে দুবাইয়ে ডিপি ওয়ার্ল্ড, দুবাই ও বাংলাদেশের পিপিপি অর্থরিটির মধ্যে এমওইউ সই হয় প্রকল্প বাস্তবায়নে। এর আগে ঢাকা ও দুবাইয়ে এ নিয়ে দু’দফায় জয়েন্ট প্লাটফর্ম মিটিং হয়।
সূত্রমতে, এর মধ্যে ২০৩০ সালের মধ্যে বন্দর কর্তৃপক্ষ বাস্তবায়নাধীন মাল্টিপারপাস টার্মিনাল এবং পিএসএ সিঙ্গাপুরের সাথে এমওইউ সই হওয়া কনটেইনার টার্মিনাল-১ বাস্তবায়নের টাইমফ্রেম নির্ধারণ করেছে। ডিপি ওয়ার্ল্ডের টার্মিনালটি ২০৩৫ সালের মধ্যে বাস্তবায়নের টাইমফ্রেম নির্ধারণ করা আছে।
এ ছাড়া গ্যাস ও তেল খালাসের অপর একটি টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার প্রস্তাব দিয়েছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান ইস্ট কোস্ট গ্রুপ।
২০১৩ সালের চট্টগ্রাম বন্দরের স্ট্র্যাটেজিক মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ২০১৯ সালের মধ্যে বন্দরের বিদ্যমান সক্ষমতা অতিক্রম করার পূর্বাভাস দেয়া হয়। ওই প্ল্যানের সুপারিশ অনুযায়ী বে-টার্মিনাল প্রকল্পের সম্ভাব্যতা সমীক্ষা চালায় আন্তর্জাতিক পরামর্শক ফার্ম শেলহর্ন-এইচপিসি-কেএস জেভি এবং ২০১৭ সালে তা সম্পন্ন হয়।
২০১৯ সালের ৪ আগস্ট সরকারের অগ্রাধিকার পিপিপি (পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ) প্রকল্প হিসেবে বে-টার্মিনাল প্রকল্প অনুমোদন পায়।
বন্দরের তথ্য অনুযায়ী ২০২৭ সালে দেশে কনটেইনার হ্যান্ডলিং করতে হবে ৪.৯৭ মিলিয়ন টিইইউএস; কিন্তু সে সময় বন্দরের জিসিবি, এনসিটি, সিসিটি ও পিসিটি মিলে হ্যান্ডলিং সক্ষমতা থাকবে ৩.৩৫ মিলিয়ন টিইইউএস। বাকি ১.৬২ মিলিয়ন টিইইউএস কনটেইনার হ্যান্ডলিং করার ক্ষমতা ২০২৭ সালেই থাকবে না চট্টগ্রাম বন্দরের বিদ্যমান টার্মিনালগুলোর। একই সময়ে প্রায় ৯০ কোটি মেট্রিক টন অতিরিক্ত কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা থাকবে না চট্টগ্রাম বন্দরের। ২০২৮ সালে কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা পৌঁছাতে হবে ৫.৩৫ মিলিয়ন টিইইউএস। প্রতি বছরই বাড়তে থাকবে কনটেইনার আগমন ও নির্গমন। এমনি পরিস্থিতিতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বে-টার্মিনালের দ্রুত বাস্তবায়ন চান মেরিটাইম-সংশ্লিষ্টরা।
প্রায় এক যুগ আগে তৎপরতা শুরু হওয়া এই প্রকল্প এখনো বাস্তব রূপ না নেয়ায় শিপিং-সংশ্লিষ্টদের মাঝে নানা প্রশ্নের জন্ম নিচ্ছে। তাদের মতে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির স্বার্থে এই প্রকল্প দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা