২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১, ২১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

৪ বিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাতের অভিযোগে টিউলিপকে ব্রিটেনে জিজ্ঞাসাবাদ

২০১৩ সালে রাশিয়ার সাথে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের চুক্তি স্বাক্ষরের সময়ের চিত্র : সংগৃহীত -


ব্রিটেনের মন্ত্রিসভার কর্মকর্তারা বাংলাদেশে রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্রের প্রায় ৪ বিলিয়ন পাউন্ড ঘুষ নেয়ার অভিযোগ ওঠার পর শেখ রেহানার মেয়ে ও ব্রিটিশ মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন। ব্রিটেনের মন্ত্রিপরিষদ অফিসের ‘ন্যায় এবং নৈতিকতা’ দল তাকে এই জিজ্ঞাসাবাদ করে। তবে টিউলিপ তাদের কাছে ঘুষ নেয়ার কথা অস্বীকার করেছেন।
ব্রিটেনের দ্য সানডে টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, টিউলিপকে গত বৃহস্পতিবার জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তবে এই খবরটি সামনে আসে গত রোববার। জিজ্ঞাসাবাদে নিজের অবস্থান তুলে ধরেন তিনি। যদিও টিউলিপ নিজে জিজ্ঞাসাবাদের ব্যাপারে কোনো মন্তব্য করেননি।
তবে মন্ত্রিসভা অফিসের এক মুখপাত্র বলেছেন, অর্থ আত্মসাতের সাথে জড়িত থাকার দাবি অস্বীকার করেছেন তিনি।
টিউলিপ ব্রিটেনের লেবার মন্ত্রিসভার সদস্য। তিনি ইকোনমিক সেক্রেটারি টু দ্য ট্রেজারি অ্যান্ড সিটি মিনিস্টার হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তার কাজ ব্রিটেনের অর্থবাজারের ভেতরের দুর্নীতি সামাল দেয়া।

ব্রিটিশ এই সংবাদমাধ্যমটি বলছে, বাংলাদেশে একটি পারমাণবিক শক্তি প্রকল্প থেকে নিজের পরিবারকে প্রায় ৪ বিলিয়ন পাউন্ড আত্মসাৎ করতে সহায়তা করার অভিযোগে মন্ত্রিপরিষদ অফিসের ন্যায় ও নৈতিকতা দল মন্ত্রী টিউলিপ সিদ্দিককে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। ২০১৩ সালে টিউলিপ বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য রাশিয়ার সাথে চুক্তি করতে সহায়তা করেছিলেন বলে অভিযোগ উঠেছে। যে চুক্তিতে প্রায় ১ বিলিয়ন পাউন্ড ঘুষের লেনদেন হয়েছিল।
সে সময়ের এক ছবিতে দেখা যায়, ক্রেমলিনে শেখ হাসিনা ও রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে টিউলিপ সিদ্দিক উপস্থিত ছিলেন। অভিযোগ অনুযায়ী, রূপপুরের এই প্রকল্প থেকে ৩.৯ বিলিয়ন (৩৯০ কোটি) পাউন্ড সরিয়ে নেয় শেখ হাসিনার পরিবার ও তার মন্ত্রীরা।
এ নিয়ে সানডে টাইমস তাদের প্রতিবেদনে জানায়, টিউলিপ সিদ্দিক ব্রিটেনের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী স্যার কিয়ার স্টারমারের বন্ধু এবং তার নির্বাচনী এলাকার পাশের আসন হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেইট আসনের প্রতিনিধিত্ব করেন তিনি। দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগ সামনে আসার পর টিউলিপ সিদ্দিক দেশটির মন্ত্রিপরিষদ অফিসের ন্যায় এবং নৈতিকতা দলের (পিইটি) প্রতিনিধির সাথে বৈঠকে যোগ দিতে সম্মত হন।

গত বৃহস্পতিবার পিইটির ওই কর্মকর্তা টিউলিপ সিদ্দিকের অফিসে যান। পরে ওই কর্মকর্তার কাছে ১০ বিলিয়ন পাউন্ডের রূপপুর প্রকল্পের দুর্নীতির সাথে তার জড়িত থাকার অভিযোগের বিষয়ে জবাব দেন টিউলিপ।
এ দিকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর দফতর ডাউনিং স্ট্রিটের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, টিউলিপের ওপর প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমারের আস্থা আছে এবং দুর্নীতিবিরোধী পদক্ষেপগুলোর দেখাশোনো করার ক্ষেত্রে তার দায়িত্ব অব্যাহত থাকবে। তিনি তার মন্ত্রীর দায়িত্ব অব্যাহত রাখবেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মুখপাত্র জানিয়েছেন, টিউলিপ সিদ্দিকের অর্থ আত্মসাতে জড়িত থাকার যে অভিযোগ রয়েছে, সেগুলোতে তার কোনো সম্পৃক্ততা থাকার দাবিও উড়িয়ে দিয়েছেন স্টারমার। আরেক সংবাদমাধ্যম ডেইলি মেইল জানিয়েছে, টিউলিপকে এগুলো নিয়ে আগামী মাসে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। এ ছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশন ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনের মাধ্যমে যুক্তরাজ্যে একটি চিঠি দেবে। এর মাধ্যমে তিনি বিদেশী অপরাধ তদন্তের অধীনে পড়বেন।
এ দিকে টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে ৪ বিলিয়ন পাউন্ড ঘুষ নেয়ার অভিযোগের খবর ব্রিটেনের কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশী কমিউনিটিতে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। গত কয়েক দিন ধরেই কমিউনিটির বিভিন্ন পত্রিকা, সভা সমাবেশ ও আচার অনুষ্ঠানে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে এটি। তারা বলছেন, এতে ব্রিটেনে বাংলাদেশীরা বিশ্বাসযোগ্যতা হারাবে। এটি বাংলাদেশী কমিউনিটির রাজনীতিবিদদের জন্যও নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
এমন পরিস্থিতিতে কমিউনিটির বেশির ভাগ মানুষই বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। আবার টিউলিপের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভের ডাকও দিয়েছেন কেউ কেউ। তবে টিউলিপ ভক্তরা বলছেন, এটি বর্তমান সরকারের একটি প্রতিহিংসামূলক অপপ্রচার। এ বিষয়ে কমিউনিটির অন্যতম মুখপত্র ‘বাংলা সংলাপে’র সম্পাদক মো: মোশাহিদ আলী বলেন, এ ঘটনায় ব্রিটেনে বাংলাদেশীদের সুনাম ক্ষুণœ হয়েছে। এতে ভবিষ্যতে ব্রিটেনের রাজনীতিতে বাংলাদেশীদের যে একটা সম্ভাবনা রয়েছে তা নষ্ট হবে। ব্রিটিশরাসহ অন্যান্য দেশ বা কমিউনিটি আমাদের ওপর আস্থা হারাতে পারে। ব্রিটিশ সরকারের উচিত বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়া।

ব্রিটেনে বিএনপির সভাপতি এম এ মালেকও মনে করেন রূপপুর বিদ্যুৎ প্রকল্পের দুর্নীতির সাথে তার পুরো পরিবার জড়িত। তার বরখাস্ত এখন সময়ের দাবি। টিউলিপের দল লেবার সদস্য ও যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ নেতা আতিয়ার রসুল কিটন বলেন, এটি একটি মিথ্যা অভিযোগ। শেখ পরিবার ও টিউলিপের উজ্জ্বল রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ দেখে বিরোধীরা হেনস্তা করতে এমন অভিযোগ তুলেছে। টিউলিপের জনপ্রিয়তায় ঈর্ষান্বিত হয়ে সরকার এমনটা করছে বলে মনে করেন লন্ডন প্রবাসী বাংলাদেশী ও সাবেক ছাত্রনেতা মো: তোহিদুল ইসলাম। তিনি বলেন, এই অভিযোগ ইউনূস সরকারের একটি প্রতিহিংসা মাত্র।
ব্রিটেন স্বেচ্ছাসেবক দলের সাধারণ সম্পাদক মো: আবুল হোসেন বলেন, ব্রিটেনের রাজনীতিতে বাংলাদেশীদের যে সম্ভাবনা সেটি টিউলিপ নষ্ট করে দিয়েছেন। এটি বাংলাদেশী কমিউনিটির অন্য নেতাদের রাজনীতির মাঠে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
২০১৩ সালে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান রোসাটমের সাথে বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের চুক্তি করে। সেখানে উপস্থিত ছিলেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, টিউলিপ সিদ্দিক, তার মা শেখ রেহানা ও ছোট বোন আজমিনা সিদ্দিক। সে সময় টিউলিপ সিদ্দিক ছিলেন একজন লেবার কাউন্সিলর। এ চুক্তি থেকে টিউলিপ রুশ কর্মকর্তাদের সাথে যোগসাজশে ৪ বিলিয়ন পাউন্ড ঘুষ হিসেবে গ্রহণ করেছেন। টিউলিপের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ ছাড়াও বিলাসবহুল বাড়ি ব্যবহারের তথ্য গোপন করার অভিযোগে ব্রিটেনে তদন্তের মুখোমুখি হয়েছিলেন। যেখানে তিনি ক্ষমা চেয়েছেন।
ব্রিটেন প্রবাসী সাংবাদিক কায়ছারুল ইসলাম সুমন মনে করেন, অভিযোগটি বাংলাদেশী কমিউনিটির জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক। এই পরিবারটি বাংলাদেশের মতো ব্রিটেনেও কলঙ্কিত রাজনীতি শুরু করেছে। এতসব কিছুর পর টিউলিপ সিদ্দিকের মন্ত্রী পদে থাকা নিয়ে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। উইট ইস্টের টোরি এমপি জো রবার্টসন বলেছেন, এটি স্পষ্ট যে অভিযোগ গুরুতর ও এ তদন্তের ফলে সিদ্দিক তার মন্ত্রী পদে বহাল থাকবেন কি না সেটি জানা প্রয়োজন।

 


আরো সংবাদ



premium cement