২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

আরাকান আর্মির সাথে সরকার আলোচনা করতে পারে না : পররাষ্ট্র উপদেষ্টা

-

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, বাংলাদেশ সীমান্তসংলগ্ন এলাকা মিয়ানমার সরকারের নিয়ন্ত্রণে নেই। এটা ননস্টেট অ্যাক্টর (রাষ্ট্রবহির্ভূত শক্তি) আরাকান আর্মির হাতে চলে গেছে। রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ বা সরকার মিয়ানমারের ননস্টেট অ্যাক্টরের সাথে আলোচনা করতে পারে না। তাই মিয়ানমার সরকারকেই দেখতে হবে কোন পদ্ধতিতে সীমান্ত ও রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে।
ব্যাংককে মিয়ানমার পরিস্থিতির ওপর ছয় জাতির অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শেষে গতকাল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তৌহিদ হোসেন এসব কথা বলেন। গত বৃহস্পতিবার থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারিস সাঙ্গিয়াম্পংসারের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন- মিয়ানমারের উপ-প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী উ থান সোয়ে, চীনের উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী মা ঝাউজু, ভারতের পররাষ্ট্র সচিব বিক্রম মিশ্রি ও লাওসের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সেলুয়েমেস্কেই কোমাসিথ। বাংলাদেশসহ এসব রাষ্ট্রের সাথে মিয়ানমারের সীমান্ত রয়েছে। আলোচনায় মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সশস্ত্র সঙ্ঘাত, মানবপাচার, মাদকদ্রব্য ও অস্ত্র চোরাচালানসহ আন্তঃদেশীয় সঙ্ঘবদ্ধ অপরাধ নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা। গত দুই মাসে আরো ৬০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের কারণে সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানবিক পরিস্থিতি নিয়েও তিনি উদ্বেগ জানিয়েছেন।

সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে তৌহিদ হোসেন বলেন, ব্যাংককের আলোচনায় বিষয় ছিল মূলত তিনটি। সীমান্ত, মাদক ও অস্ত্র চোরাচালান এবং মানবপাচার। এ ছাড়া মিয়ানমারের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ ও বর্তমান অবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কেউ বিশ্বাস করেন না, মিয়ানমার তিন বছর বা পাঁচ বছর আগে যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায় ফিরে যাবে। সেটি যদি প্রত্যাশা করত, তবে এই আলোচনার দরকার ছিল না। সবাই বলেছে, আমরা মিয়ানমারকে সমর্থন করব। মিয়ানমার যদি ফেডারেল স্ট্রাকচার চায়, আমরা হস্তক্ষেপ করব না; কিন্তু আমরা চাই সমস্যার সমাধান হোক।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, সীমান্তের ব্যাপারে প্রধানত মিয়ানমারের উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ সীমান্ত নিয়ে বেশি কথা হয়েছে। আলোচনায় দেশটির পশ্চিমের সীমান্তও ছিল, যেখানে আমাদের স্বার্থ রয়েছে। এই অঞ্চলে কিছু স্ক্যাম সেন্টার গড়ে উঠেছে, যা ইন্টারনেটভিত্তিক অপরাধের সাথে জড়িত। এটা নিয়ে সবাই উদ্বিগ্ন। মিয়ানমার সীমান্তবর্তী স্ক্যাম সেন্টারের অনেকগুলো চীন নষ্ট করে দিয়েছে। এখন স্ক্যাম সেন্টারগুলো আছে মূলত থাইল্যান্ড ও লাওসের সীমান্তে। এসব সেন্টারে অনেক বাঙালি আটকা পড়েছেন। তবে সবাই যে পাচার হয়ে গেছেন, তা কিন্তু নয়। অনেকেই লোভে পড়ে সেখানে গেছেন।
রোহিঙ্গাদের নতুন করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ নিয়ে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমাদের নীতিগতভাবে অবস্থান ছিল, আর কোনো রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে ঢুকতে দেবো না। তবে পরিস্থিতি কখনো কখনো এমন দাঁড়ায় যে, আমাদের কিছু করার থাকে না। সে রকম পরিস্থিতিতে আমরা ৬০ হাজার রোহিঙ্গাকে ঢুকতে দিয়েছি। আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের ঢুকতে দিয়েছি, তা-ও না। রোহিঙ্গারা বিভিন্ন পথে ঢুকেছে। একটি কথা আমাদের মনে রাখতে হবে, সীমান্তে প্রচুর দুর্নীতি রয়েছে। এটা সত্যি এবং অস্বীকার করার কোনো কারণ নেই। দুর্নীতির মাধ্যমে প্রচুর রোহিঙ্গা ঢুকে যাচ্ছে। বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে, নৌকা নিয়ে ঢুকছে। এটা আটকানো খুব কঠিন হচ্ছে। অনেকে আশঙ্কা করছেন, আরো একটি রোহিঙ্গা ঢল আসবে। এই আশঙ্কা আমাদেরও আছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সাথে নিয়েই সম্ভাব্য ঢলকে মোকাবেলা করতে হবে।

রোহিঙ্গা পরিস্থিতি পুরো অঞ্চলের জন্য কিভাবে অশনিসঙ্কেত সৃষ্টি করছে জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, এখন বয়স্ক যেসব রোহিঙ্গা আছেন, তারা হয়তো পরিস্থিতি মেনে নেবে। তবে আগামী পাঁচ বছর পর যেসব রোহিঙ্গার বয়স ২০ বছর হবে, তারা বেপরোয়া হয়ে উঠবে। তখন আমাদের সমস্যা বেশি হবে ঠিকই, কিন্তু অন্যদেরও সমস্যা হবে। এর মধ্যেই নৌকায় করে রোহিঙ্গারা অস্ট্রেলিয়া পর্যন্ত পৌঁছে গেছে। ব্যাংকক আলোচনায় আমি স্পষ্টভাবে বলেছি, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না হলে আপনারা যে শান্তি বা স্থিতিশীলতার কথা চিন্তা করছেন, এটা কোনো দিন সম্ভব না।
বঙ্গোপসাগরের সম্ভাবনা উন্মোচনে শান্তি গুরুত্বপূর্ণ : গতকাল রাজধানীর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজে (বিআইআইএসএস) আয়োজিত এক সেমিনারে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, বঙ্গোপসাগরের সম্ভাবনা উন্মোচনের জন্য মিয়ানমারে শান্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গৃহযুদ্ধ-জর্জরিত প্রতিবেশী দেশটিতে সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের টেকসই প্রত্যাবাসন অপরিহার্য। যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা নিরাপত্তা ও অধিকার নিয়ে মিয়ানমারে তাদের বাড়ি ফিরে যেতে পারবে না, ততক্ষণ পর্যন্ত এই অঞ্চলে শান্তিশৃঙ্খলা ফিরে আসবে না।

‘রিকানেক্টিং দ্য বে অব বেঙ্গল রিজিয়ন : এক্সপ্লোরিং দ্য কনভারজেন্স অব ইন্টারেস্ট’ বিষয়ক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি আরো বলেন, বঙ্গোপসাগরের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে মিয়ানমারসহ সমুদ্র উপকূলীয় রাজ্যগুলোতে শান্তি ও সম্প্রীতি অপরিহার্য। গত সাত বছরে চরম নৃশংসতার শিকার হয়ে রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হওয়া ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের প্রত্যাবাসনে কোনো অগ্রগতি হয়নি। ননস্টেট অ্যাক্টর আরাকান আর্মি বাংলাদেশের সাথে মিয়ানমারের সমগ্র সীমান্তের নিয়ন্ত্রণ নেয়ায় পরিস্থিতি আরো জটিল হয়ে উঠেছে।
থাইল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আমন্ত্রণে মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে ব্যাংককে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় কথা উল্লেখ করে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, আমি সবাইকে সতর্ক করেছি যে, রাখাইনে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবর্তন ছাড়া সেখানে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হবে না। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের জন্য একটি অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করা মিয়ানমার ও আঞ্চলিক শক্তির দায়িত্ব।
বাংলাদেশে জাপান দূতাবাসের পৃষ্ঠপোষকতায় বিআইআইএসএস এবং ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপিং ইকোনমিস যৌথভাবে সেমিনারের আয়োজন করে। এতে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন জাপানের রাষ্ট্রদূত ইওয়ামা কিমিনোরি।
বিআইআইএসএসের চেয়ারম্যান রাষ্ট্রদূত গাউসুল আজম সরকারের সভাপতিত্বে উদ্বোধনী অধিবেশনে স্বাগত বক্তব্য রাখেন প্রতিষ্ঠানের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল ইফতেখার আনিস।

 


আরো সংবাদ



premium cement