হাসিনা দিল্লিতে, তলানিতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক
এবিসির বিশ্লেষণ- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
কয়েক দশক ধরেই দুই প্রতিবেশী দেশ বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু চলতি বছরের মাঝামাঝি থেকে সেই সম্পর্কে টানাপোড়েন শুরু হয়। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের সাম্প্রতিক অবস্থা তুলে ধরে মার্কিন গণমাধ্যম এবিসি নিউজের করা এক প্রতিবেদনে এ কথা বলা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারি চাকরিতে কোটার বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ ছাত্র বিক্ষোভের ফলে শুরু হওয়া আন্দোলন শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ‘দেশব্যাপী আন্দোলনে’ পরিণত হয়।
ছাত্র-জনতার এই গণ-আন্দোলনকে ‘বিশ্বের প্রথম জেন-জি বিপ্লব’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। বিশ্বজুড়ে সাড়া ফেলে দেয়া এই আন্দোলনের ফলস্বরূপ শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে করে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যান এবং এরপর থেকে তিনি দিল্লিতেই নির্বাসিত আছেন। এরপরের মাসগুলোতে নানা ঘটনাবলীর প্রেক্ষপটে বাংলাদেশে এক ইসকন নেতাকে গ্রেফতার এবং ভারতে বাংলাদেশের একটি কনস্যুলেটে উগ্র হিন্দুত্ববাদী জনতার হামলার ঘটনা দুই দেশের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। এখন দক্ষিণ এশীয়ার এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে সম্পর্ক তলানিতে নেমেছে এবং সম্পর্কের মধ্যে ধর্মীয় উত্তেজনাও বিদ্যমান রয়েছে।
‘আয়রন লেডি’ খ্যাত শেখ হাসিনার কট্টর ও স্বৈরাচারী শাসনের অধীনে ভারত দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশকে তার অন্যান্য দক্ষিণ এশিয়ার প্রতিবেশীদের তুলনায় অনেক বেশি স্থিতিশীল অংশীদার বলে মনে করত। যদিও আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং শ্রীলঙ্কা সবাই সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উত্থান-পতনের অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। কিন্তু হাসিনার ১৫ বছরের শাসনামল গত আগস্টে আকস্মিকভাবে অবসান ঘটার পর নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়।
বাংলাদেশের ১৭৪ মিলিয়ন বা ১৭ কোটি ৪০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যা প্রায় ১০ শতাংশ এবং তাদের অনেকেই ঐতিহাসিকভাবে হাসিনার আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছিল। শেখ হাসিনা ক্ষমতা থেকে বিতাড়িত হওয়ার পর বিক্ষুব্ধ অনেকে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন প্রতীক এবং কিছু ক্ষেত্রে দলটির সাথে সংশ্লিষ্ট হিন্দুদেরও টার্গেট করেছিল।
হিন্দুদের রক্ষা করার জন্য তবুও ড. ইউনূসের সরকার যথেষ্ট কাজ করছে না বলে অভিযোগ করেছে ভারত। ভারতে নির্বাসিত থাকা হাসিনাও দাবি করেছেন, সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ‘গণহত্যার’ জন্য দায়ী এই সরকার।
ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং গত সেপ্টেম্বরে ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীকে রাশিয়া-ইউক্রেন, ইসরায়েল-গাজার মধ্যে চলমান সংঘাত এবং বাংলাদেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির উল্লেখ করে অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতির জন্য প্রস্তুত থাকতে এবং প্রতিবেশী দেশগুলোর পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
কিন্তু গত নভেম্বরের শেষের দিকে বাংলাদেশে এক হিন্দু সন্ন্যাসীকে (ইসকন) রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় এবং এটি ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে বড় ধরনের কূটনৈতিক উত্তেজনার সৃষ্টি করে।
চলতি বছরের অক্টোবরে এক সমাবেশে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাকে অসম্মান করার অভিযোগে হিন্দু নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু তার সমর্থকদের বিশ্বাস, হিন্দুদের বিরুদ্ধে হামলার বিষয়ে সোচ্চার থাকায় তাকে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে।
যদিও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ভারতীয় এক সংবাদ সংস্থাকে বলেছেন, হিন্দুদের বিরুদ্ধে সহিংসতার দাবিগুলো অতিরঞ্জিত করে সামনে আনা হয়েছে। চলতি ডিসেম্বর মাসের শুরুতে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় অবস্থিত বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনে সম্প্রতি হামলার ঘটনা ঘটে। হামলার সময় উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা সেখানে ভাঙচুর চালায় এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা নামিয়ে ছিঁড়ে ফেলার পাশাপাশি অবমাননা করে।
সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের রিসার্চ ফেলো অমিত রঞ্জন বলেন, ‘বাংলাদেশীদের মনে এই অনুভূতি সব সময় থাকে যে, ভারত বাংলাদেশের বিষয়ে খুব বেশি হস্তক্ষেপ করে। হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনকে ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্ট সমর্থন করেছিল বলেও তাদের মধ্যে ক্ষোভ রয়েছে।’
বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির গবেষক খন্দকার তাহমিদ রেজওয়ান বলেছেন, ‘বাংলাদেশের সাথে ভারতের সম্পর্ক শুধুমাত্র হাসিনার আওয়ামী শাসনামলের সাথেই উষ্ণ ছিল, সাধারণ মানুষের সাথে নয়। অন্যদিকে ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা ইউনূসের কুশপুত্তলিকা পুড়িয়েছে এবং বাংলাদেশের পতাকার অবমাননা করেছে। বিষয়টি বাংলাদেশে ভারতের প্রতি ক্ষোভ দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। ডিসেম্বরের শুরুতে প্রায় ৫০ জন বিক্ষোভকারী ভারতের আগরতলায় বাংলাদেশী কনস্যুলেটে প্রবেশ করে বিক্ষোভ দেখায়। এ ঘটনায় সাতজনকে গ্রেফতার ও একে ‘গভীরভাবে দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেছে।
এই মাসের শুরুর দিকে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি ড. ইউনূসের সাথে দেখা করতে এবং সম্পর্কের বরফ গলাতে ঢাকায় গিয়েছিলেন। আগস্টে হাসিনা দিল্লিতে পালিয়ে যাওয়ার পর থেকে এটি ছিল দুই দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের সফর।
প্রত্যর্পণের প্রশ্ন : ড. ইউনূস বলেছেন, বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন হবে ২০২৫ সালের শেষের দিকে বা ২০২৬ সালের শুরুতে। বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), যারা হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছিল তাদের সরকার গড়ার সম্ভাবনা প্রবল। প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা জেনসের সিনিয়র বিশ্লেষক শিবানী গায়কোয়াড় বলেছেন, অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে বিএনপি তার চীনপন্থী অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে। বিএনপি তার চীনপন্থী এবং ইসলামপন্থী অবস্থান নিয়ে ক্ষমতায় এলে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, অক্টোবরে বাংলাদেশের একটি ট্রাইব্যুনাল অন্যান্য অভিযোগের পাশাপাশি মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ পিস অবজারভেটরির গবেষক রেজওয়ান মনে করেন, হাসিনাকে প্রত্যাবাসনের যেকোনো প্রচেষ্টা ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি এবং বিরোধী কংগ্রেস পার্টি কেউই সমর্থন করবে না। কারণ ভারতও চাইবে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশ পুনর্গঠন করুক এবং মূলধারার রাজনীতিতে ফিরে আসুক। তবুও দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে ভারত সরকার শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করতে প্রস্তুত কি না তার ওপর।
অস্ট্রেলিয়ায় সাত বছর নির্বাসনের পর বাংলাদেশের শিক্ষাবিদ ও মানবাধিকারকর্মী মোবাশ্বের হাসান তার জন্মভূমিতে ফিরে আসেন হাসিনার পতনের পর। ড. হাসান এবিসির দ্য ওয়ার্ল্ডকে বলেছেন যে ভারত যদি তাকে প্রত্যর্পণ করতে অস্বীকার করে, তাহলে বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণভাবে ভারতবিরোধী মনোভাব বৃদ্ধি পাবে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা