বাবরসহ ৬ জন খালাস
পরেশের যাবজ্জীবন, খালাস পেলেন নিজামীও- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বহুল আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় মৃত্যুদণ্ড থেকে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ ছয়জনকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। আর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর ছয় আসামির সাজা কমিয়ে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। এ ছাড়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সাবেক সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়াকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
গতকাল বুধবার বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলাম ও বিচারপতি নাসরিন আক্তারের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ মামলায় ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আসামিদের আপিলের ওপর শুনানি শেষে রায় দেন।
রায়ে আদালত বলেছেন, লুৎফুজ্জামান বাবর, রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক মহসিন উদ্দিন তালুকদার, তৎকালীন মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কে এম এনামুল হক ও প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা মহাপরিদপ্তরের (ডিজিএফআই) সাবেক পরিচালক মেজর জেনারেল (অব:) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। যে কারণে তারা অভিযোগ থেকে খালাস পাওয়ার অধিকারী। তাদের খালাস দেয়া হলো।
ওই মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীর মৃত্যুদণ্ড ও জরিমানা হয়েছিল। হাইকোর্ট গতকাল রায়ে বলেছেন, মারা যাওয়ায় তার আপিল মেরিটে নিষ্পত্তি করে অব্যাহতি দেয়া হলো।
এ ছাড়া মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত শিল্প মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব নুরুল আমিনকে খালাস দেন হাইকোর্ট। তার বিষয়ে রায়ে আদালত বলেন, বিচারের শুরু থেকেই তিনি পলাতক। তার বিরুদ্ধে প্রসিকিউশন অভিযোগ প্রমাণ করতে পারেনি। তাই তিনি অভিযোগ থেকে খালাস পাওয়ার অধিকারী।
তবে লুৎফুজ্জামান বাবর এ মামলায় খালাস পেলেও এখনই মুক্তি পাচ্ছেন না। কারণ একই ঘটনায় আরেক মামলায় তার দণ্ড রয়েছে বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন।
১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৪ আসামির মধ্যে যারা খালাস পেয়েছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির মাওলানা মতিউর রহমান নিজামীও।
জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমিরের বিষয়ে আইনজীবী শিশির মনির বলেন, আমরা মতিউর রহমান নিজামীর পক্ষে ছিলাম। তিনি মৃত্যুবরণ করায় মামলাটা অ্যাবেট হয়ে গেছে। কিন্তু যে জরিমানা ছিল, সেটা থেকে অন মেরিটে খালাস করে দিয়েছেন আদালত। ফলে এ মামলায় তিনি খালাস পেলেন।
আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেন, জান্নাতবাসী মতিউর রহমান নিজামী। ওনার পক্ষে আমার বক্তব্য ছিল- তিনটা পেপার বুক মিলে যে হাজার হাজার পৃষ্ঠা, কোথাও তার বিরুদ্ধে সামান্যতম সাক্ষ্য নেই। যদিও তিনি আজ দুনিয়াতে নেই, তার রূহ শান্তি পাবে যদি ন্যায়বিচারে তাকে নির্দোষ সাব্যস্তে খালাস দেয়া হয়। আদালত সমস্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ নিরীক্ষা করে সিদ্ধান্তে এসেছেন, তার বিরুদ্ধে কিছু নেই, তাকে আমরা খালাস দিলাম। দেয়ার ইজ নো অ্যাভিডেন্স এগেইনস্ট হিম। তার বিরুদ্ধে কোনো সাক্ষী নেই।
নিজামীকে রাজনৈতিক কারণে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল-নাজিব মোমেন : ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলায় বেকসুর খালাসের মাধ্যমে প্রমাণ হলো মাওলানা নিজামীকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছিল। গতকাল এক বিবৃতিতে মাওলানা নিজামীর পুত্র ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার নাজিব মোমেন বলেন, সম্পূর্ণ রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে পার্শ্ববর্তী দেশের ইঙ্গিতে মাওলানা নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। অথচ এই মামলায় উনার সংশ্লিষ্টতাসংক্রান্ত কোনো প্রমাণ সরকারপক্ষ হাজির করতে পারেনি। এ মামলায় বেকসুর খালাস পাওয়ার মাধ্যমে প্রমাণিত হলো মামলাটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ছিল। আমি এই বিচারের নামের প্রহসনের সাথে জড়িত সবার বিচার দাবি করছি। একইভাবে তথাকথিত যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালেও তথ্যপ্রমাণ ছাড়া মাওলানা নিজামীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, যা বিচারিক হত্যার নামান্তর। আইনের শাসন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে এই হত্যাকাণ্ডসহ ফ্যাসিবাদী হাসিনার আদালতে সংঘটিত সব রাজনৈতিক বিচারিক হত্যাকাণ্ডের কমিশন গঠন করে সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করছি।
পরেশ বড়ুয়ার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড : বিচারিক আদালতের রায়ে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়ার মৃত্যুদণ্ড ও জরিমানা হয়েছিল। তার বিষয়ে হাইকোর্ট রায়ে বলেন, শুরু থেকেই তিনি পলাতক। তার বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণ রয়েছে বলে প্রতীয়মান হয়। সর্বোচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত এবং পারিপার্শ্বিকতা ও সাক্ষ্য-প্রমাণ বিবেচনায় নিয়ে তার সাজা পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করা হলে ন্যায়বিচার হবে। তাই সাজা মৃত্যুদণ্ড থেকে কমিয়ে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হলো।
ছয়জনের ১০ বছরের কারাদণ্ড : বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ছয় আসামিকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দিয়েছেন হাইকোর্ট। তারা হলেন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা (এনএসআই) সংস্থার তৎকালীন মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, এনএসআইয়ের সাবেক উপপরিচালক মেজর (অব:) লিয়াকত হোসেন, তৎকালীন পরিচালক উইং কমান্ডার (অব:) সাহাব উদ্দিন আহাম্মদ, চোরাকারবারি হাফিজুর রহমান, শ্রমিক সরবরাহকারী দ্বীন মোহাম্মদ ও ট্রলারমালিক হাজী সোবহান। বিচারিক আদালতের রায়ে তাদের ৫ লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়েছিল। সেটি জরিমানা পরিবর্তন করে তাদের ১০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
যা বললেন আসামিপক্ষের আইনজীবী : আদালতের আদেশের বিষয়ে এ মামলার অন্যতম আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির জানান, এ মামলায় ১৪ জন ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড হয়েছিল। তাদের ডেথ রেফারেন্স শুনানি শেষে রায় হয়েছে। এ রায়ে খালাস পেয়েছেন সাতজন। এর মধ্যে চারজন মামলার শুনানিতে অংশ নিয়ে খালাস পেয়েছেন। পলাতক নুরুল আমিনও খালাস পেয়েছেন। আর ইতোমধ্যে মৃত্যুবরণ করায় মতিউর রহমান নিজামী ও আব্দুর রহিমের আপিল অ্যাবেটেড (বাদ) হয়ে গেছে। বাকি ছয়জনকে ১০ বছরের সাজা দেয়া হয়েছে। বন্দিবিনিময় চুক্তির আওতায় ভারত চলে যাওয়া পরেশ বড়ুয়াকে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন আদালত। ১৪ জনের মধ্যে মোট সাতজন খালাস, ছয়জনের ১০ বছর এবং একজনের যাবজ্জীবন।
লুৎফুজ্জামান বাবরের বিষয়ে শিশির মনির বলেন, দ্বিতীয় তদন্তের ভিত্তিকে তাকে প্রধান আসামি করা হয়। আদালত তাকে খালাস দিয়েছেন এ কথা বলে যে তিনি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ভিকটিম। তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট তথ্যপ্রমাণ কেউ হাজির করতে পারেনি। জামায়াতের সাবেক আমিরের বিষয়ে শিশির মনির বলেন, আমরা মতিউর রহমান নিজামীর পক্ষে ছিলাম। তিনি মৃত্যুবরণ করায় মামলাটি অ্যাবেট হয়ে গেছে। কিন্তু যে জরিমানা ছিল, তা থেকে অন মেরিটে খালাস পেয়েছেন। ফলে এ মামলায় তিনি খালাস পেলেন।
আদালতে মহসীন, এনামুলসহ পাঁচজনের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী এস এম শাহজাহান। মাওলানা নিজামী ও লুৎফুজ্জামান বাবরের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির। আবদুর রহিম ও লিয়াকতের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মোহাম্মদ আহসান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুলতানা আক্তার রুবী ও সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেল মো: আসিফ ইমরান জিসান।
রহিমের জরিমানা কমে ১০ হাজার : এ মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে এনএসআইয়ের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) মো: আবদুর রহিমের মৃত্যুদণ্ড ও জরিমানা হয়েছিল। তার বিষয়ে রায়ে হাইকোর্ট বলেন, মারা যাওয়ার কারণে তার আপিল অ্যাবেট (পরিসমাপ্তি) ঘোষণা করা হলো। বিচারিক আদালতের দেয়া জরিমানার আদেশ সংশোধন করে ১০ হাজার টাকা জরিমানা আরোপ করা হলো।
২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকসংক্রান্ত দু’টি মামলার মধ্যে চোরাচালান মামলায় (বিশেষ ক্ষমতা আইনে) সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী (ফাঁসির দণ্ড কার্যকর), সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর এবং ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়াসহ ১৪ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন চট্টগ্রামের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এস এম মজিবুর রহমানের আদালত।
অস্ত্র আইনে দায়ের করা অন্য মামলাটিতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পেয়েছেন একই আসামিরা। এ ছাড়া অস্ত্র আটক মামলার অপর ধারায় সাত বছর কারাদণ্ড দেন বিচারক। দণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেক আসামিকে ৫ লাখ টাকা করে জরিমানাও করা হয়।
মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত অন্য ১১ জন হলেন এনএসআইর সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআইর সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আব্দুর রহিম, ডিজিএফআইর সাবেক পরিচালক (নিরাপত্তা) অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার সাহাবুদ্দিন আহমেদ, এনএসআইর সাবেক উপ-পরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর লিয়াকত হোসেন, এনএসআইর সাবেক মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহসিন উদ্দিন তালুকদার, সিইউএফএলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কে এম এনামুল হক, সাবেক ভারপ্রাপ্ত শিল্পসচিব নুরুল আমিন, চোরাচালানি হিসেবে অভিযুক্ত হাফিজুর রহমান, অস্ত্র খালাসের জন্য শ্রমিক সরবরাহকারী দীন মোহাম্মদ ও ট্রলার মালিক হাজী আবদুস সোবহান।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা