১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

সিরিয়ায় নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল গড়ার ঘোষণা ইসরাইলের

-

- ইসরাইলি হামলায় সিরিয়ার সামরিক শক্তির ৮০ শতাংশ ধ্বংস
- অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকারের আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের
- শান্তি-স্থিতিশীলতার ডাক অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রীর

সিরিয়ায় কথিত সন্ত্রাসী তৎপরতা প্রতিরোধে একটি নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল গঠনের কথা জানিয়েছেন ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাৎজ। এরই মধ্যে দেশটির দক্ষিণে ওই অঞ্চলে সিরিয়ার ভূখণ্ড দখলে নিয়েছে সাময়িক ইসরাইলি বাহিনী। দেশটিতে বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের পর বিমান হামলাও জোরদার করেছে ইসরাইল। সিরিয়ার অভ্যন্তরে সাম্প্রতিক দিনগুলোয় ‘বেসামরিক অঞ্চলে’ সরে গেছে ইসরাইলি বাহিনী। ওই অঞ্চলের মধ্যে দামেস্ক এড়িয়ে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ মাউন্ট হারমনের সিরীয় অংশও রয়েছে। সেখানে সিরিয়ার পরিত্যক্ত সামরিক ঘাঁটি নিয়ন্ত্রণে নিয়েছেন ইসরাইলি সেনারা। আলজাজিরা।

প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাৎজ গত মঙ্গলবার বলেন, তিনি সামরিক বাহিনীকে সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে নিয়ন্ত্রিত অঞ্চল গড়ে তোলার নির্দেশ দিয়েছেন। সেখানে ইসরাইলি বাহিনীর স্থায়ী উপস্থিতি থাকবে না, তবে সেটি নিয়ন্ত্রিত হবে। এর চেয়ে বেশি বিস্তারিত কিছু জানাননি ইসরাইল কাৎজ। তবে তিনি বলেন, এই অঞ্চল গড়ে তোলার লক্ষ্য সিরিয়ার ভূখণ্ডে সন্ত্রাস প্রতিষ্ঠা ও সন্ত্রাসীদের সংগঠিত হওয়া প্রতিহত করা। ইসরাইলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী এটাও নিশ্চিত করেন যে গভীর রাতে হামলা চালিয়ে সিরিয়ার বেশ কয়েকটি নৌযান ধ্বংস করা হয়েছে।

বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের পর সিরিয়ায় একের পর এক সামরিক স্থাপনায় হামলা চালিয়ে আসছে ইসরাইলি বাহিনী। ৪৮ ঘণ্টায় এমন ৪৮০টি হামলা চালানোর খবর জানিয়েছে ইসরাইলি বাহিনী। হামলা হয়েছে রাজধানী দামেস্কে ও এর আশপাশে। দামেস্ক ছাড়াও সিরিয়ার হোমস, তারতাস, পালমিরা শহরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, হামলায় লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে সিরিয়ার বিমানঘাঁটি, সামরিক যান, নৌবহর, বিমানবিধ্বংসী অস্ত্র, অস্ত্রের উৎপাদনক্ষেত্র, গবেষণাকেন্দ্র, অস্ত্রাগারসহ বিভিন্ন অবকাঠামোকে। এসব হামলায় সিরিয়ার সামরিক সক্ষমতার প্রায় ৮০ শতাংশই বিধ্বস্ত হয়েছে বলে দাবি করেছে ইসরাইল। মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএন ও ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইসরাইলের রিপোর্ট থেকে এ তথ্য জানা গেছে।

সিএনএনের খবরে বলা হয়েছে, আসাদ সরকারের পতনের পর সিরিয়ায় ইসরাইল কঠোর সামরিক হামলা চালিয়েছে। সিরিয়ার সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে ইসরাইলে অন্তত ৪৮০টি বিমান হামলা চালিয়েছে এবং ৫০ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো দুই দেশের মধ্যকার বাফার জোন থেকে এগিয়ে সিরিয়ার অভ্যন্তরে ঢুকে স্থলবাহিনী মোতায়েন করেছে। ইসরাইলের সামরিক বাহিনী মঙ্গলবার জানিয়েছে, তারা গত দুই দিনে সিরিয়ার বিভিন্ন স্থানে প্রায় ৪৮০টি হামলা চালিয়েছে, যার মাধ্যমে সিরিয়ার বেশির ভাগ কৌশলগত অস্ত্র মজুদ ধ্বংস করা হয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরাইল কাটজ জানিয়েছেন, ইসরাইলি নৌবাহিনী রাতারাতি সিরিয়ার নৌবহর ধ্বংস করেছে এবং এই অভিযানকে ‘বড় সাফল্য’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

টাইমস অব ইসরাইলের খবরে বলা হয়েছে, ইসরাইলের সামরিক বাহিনী অনুমান করেছে যে, তারা আসাদ সরকারের কৌশলগত সামরিক সক্ষমতার ৭০-৮০ শতাংশ ধ্বংস করেছে। তবে বিষয়টি নিয়ে সিরিয়ার কর্তৃপক্ষ কোনো মন্তব্য করেনি। লন্ডনভিত্তিক যুদ্ধ পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান সিরিয়ান অবজারভেটরি ফর হিউম্যান রাইটস (এসওএইচআর) জানায়, ইসরাইলি হামলায় সিরিয়ার অতি গুরুত্বপূর্ণ সামরিক স্থাপনাগুলো ধ্বংস হয়েছে। এর মধ্যে বিমানবন্দর, ওয়্যারহাউজ, রাডার, সামরিক সিগন্যাল স্টেশন, বহু অস্ত্র-গোলাবারুদ রয়েছে। নিরাপত্তা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন সূত্রের বরাতে ইসরাইলি সংবাদমাধ্যম বলছে, বাশার আল-আসাদ সরকারের পতনের পর ইসরাইলের বিমানবাহিনীর ইতিহাসে সিরিয়ায় অন্যতম বড় হামলা চালানো হয়েছে। এর পাশাপাশি সোমবার রাতে জাহাজ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে সিরিয়ার আল বায়দা বন্দর ও লাতাকিয়া বন্দরে সিরিয়ার নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজগুলোতে আঘাত হানে ইসরাইল। এ সময় ওই দুই বন্দরে সিরিয়ার নৌবাহিনীর ১৫টি জাহাজ নোঙর করা ছিল। ইসরাইলি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিরিয়াজুড়ে চালানো এসব হামলার লক্ষ্য ছিল দেশটির কৌশলগত অস্ত্র ও সামরিক অবকাঠামোগুলো ধ্বংস করা, যেন আসাদকে ক্ষমতাচ্যুত করা বিদ্রোহীরা সেগুলো ব্যবহার করতে না পারে। এই বিদ্রোহীদের কিছু অংশের উৎপত্তি আলকায়েদা ও ইসলামিক স্টেটের (আইএস) মতো গোষ্ঠীগুলোর তৎপরতা থেকে হয়েছে।

ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, সিরিয়ার অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার উদ্দেশ্য নেই তাদের, কিন্তু নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যা করা দরকার তাই করছেন তারা। তিনি বলেন, “সিরিয়ার সেনাবাহিনীর রেখে যাওয়া কৌশলগত সামরিক সামর্থ্যে বোমাবর্ষণ করতে বিমান বাহিনীকে অনুমোদন দিয়েছি আমি, যেন সেগুলো জিহাদিদের হাতে গিয়ে না পড়ে।”
ইসরাইলের সামরিক মুখপাত্র লেফটেন্যান্ট কর্নেল নাদভ শোশানি দাবি করেছেন, তাদের সেনারা ইসরাইল-সিরিয়ার মধ্যবর্তী বাফার জোনেই আছে, তবে তারা এর কাছাকাছি ‘কয়েকটি অতিরিক্ত পয়েন্টেও’ অবস্থান নিয়েছে। সিরিয়ার এক কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানিয়েছিলেন, ইসরাইলি বাহিনী বাফার জোন ছেড়ে সিরিয়ার আরো ভেতরে ঢুকে পড়ে কাতানা শহরে উপস্থিত হয়েছে, যা বাফার জোন থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার ভেতরে এবং দামেস্ক বিমানবন্দর থেকে অল্প গাড়ি দূরত্বে অবস্থিত।
কিন্তু ইসরাইলি বাহিনী বাফার জোন ছেড়ে সিরিয়ার অনেকটা ভেতরে ঢুকে পড়েছে বলে যে অভিযোগ এসেছে শোশানি তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইসরাইলি সেনারা দামেস্কের দিকে অগ্রসর হচ্ছে না বলে দাবি করেছেন তিনি।

অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকারের আহ্বান যুক্তরাষ্ট্রের : সিরিয়ার বিদ্রোহী জোটের নেতৃত্ব দেয়া গোষ্ঠী হায়াত তাহরির আল-শামকে (এইচটিএস) সরাসরি দেশটির নেতৃত্ব গ্রহণ না করে তার বদলে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়া পরিচালনার মাধ্যমে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের আহ্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এইচটিএসের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম যোগাযোগের বিষয়ে অবহিত করে এসব কথা জানান বাইডেন প্রশাসনের দুই কর্মকর্তা ও মার্কিন কংগ্রেসের এক সহযোগী।
এইচটিএসের নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহীরা রোববার সিরিয়ার রাজধানী দামেস্ক দখল করে প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদের দীর্ঘদিনের শাসনের অবসান ঘটায়। রয়টার্স জানায়, তুরস্কসহ যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যের মিত্রদের মধ্যস্থতায় ওয়াশিংটনের সাথে এইচটিএসের যোগাযোগ হয়। এই হায়াত তাহরির আল-শাম গোষ্ঠীটি আগে আলকায়েদার সাথে জোটবদ্ধ ছিল আর একে যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসী সংগঠনের তকমা দিয়ে রেখেছে। ওই মার্কিন কর্মকর্তাদের মধ্যে একজন জানান, এই যোগাযোগের বিষয়ে বাইডেন প্রশাসন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের টিমকেও সবকিছু জানাচ্ছে।

গত কয়েক দিন ধরে এইচটিএসের সাথে ওয়াশিংটনের আলোচনা হয়েছে। হঠাৎ করে আসাদের পতন হওয়ায় সিরিয়ায় যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে তার মধ্যে দেশটির বিভিন্ন গোষ্ঠীর সাথে সমন্বয় করার বড় ধরনের প্রচেষ্টা শুরু করছে ওয়াশিংটন। এইচটিএসের সাথে আলোচনা সেই প্রচেষ্টারই অংশ। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই মার্কিন কর্মকর্তা জানান, গোষ্ঠীটিকে সিরিয়ার জন্য একটি আনুষ্ঠানিক শাসন কাঠামো প্রতিষ্ঠার প্রাথমিক প্রচেষ্টায় পথ দেখিয়ে সহায়তা করার বার্তা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এসব বার্তা সরাসরি দেয়া হয়েছে না মধ্যবর্তী কারো মাধ্যমে দেয়া হয়েছে তা জানাতে রাজি হননি তিনি। এই কর্মকর্তা জানান, আন্তর্বর্তী সরকারকে সিরিয়ার জনগণের আকাক্সক্ষার প্রতিনিধিত্ব করা উচিত বলে ওয়াশিংটন বিশ্বাস করে এবং আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে নতুন নেতা বেছে নেয়া ছাড়াই এইচটিএসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়াকে সমর্থন করবে না।

শান্তি-স্থিতিশীলতার ডাক অন্তর্বর্তী প্রধানমন্ত্রীর : অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হওয়ার পর মঙ্গলবার আলজাজিরা টেলিভিশনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে শান্তি ও স্থিতিশীলতার ডাক দিয়েছেন মোহাম্মাদ আল-বশির। দায়িত্ব নেয়ার পর এটি তার প্রথম সাক্ষাৎকার। বিদ্রোহীদের অভিযানে বাশার আল-আসাদের ক্ষমতাচ্যুতির দুই দিন পর আল-বশিরকে সিরিয়ার অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধানমন্ত্রী করা হয়। তিনি ২০২৫ সালের ১ মার্চ পর্যন্ত এই দায়িত্বে থাকবেন। আলজাজিরা টেলিভিশনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে আল-বশির বলেন, এখন সিরিয়ার জনগণের স্থিতিশীলতা ও শান্তি উপভোগ করার সময় এসেছে।

সিরিয়ার অখণ্ডতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি এরদোগানের : সিরিয়াকে কখনো ভেঙে ফেলতে দেয়া হবে না। কেউ যদি সিরীয় ভূখণ্ডের অখণ্ডতা নিয়ে আপস করতে চায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে তুরস্ক কঠোর ব্যবস্থা নেবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব এরদোগান। রাজধানী আঙ্কারায় মঙ্গলবার জাস্টিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (একে পার্টি) এক কনভেনশনে তিনি এই হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। আনাদোলু এজেন্সি জানায়, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট বলেন, আমরা সিরিয়াকে আর বিভক্ত হতে দিতে পারি না... সিরিয়ার জনগণের স্বাধীনতা, নতুন প্রশাসনের স্থিতিশীলতা এবং সিরীয় ভূমির অখণ্ডতার ওপর যেকোনো ধরনের হামলা হলে আমরা তার বিরুদ্ধে দাঁড়াব। এর আগে সিরিয়ার আঞ্চলিক অখণ্ডতার প্রতি তুরস্কের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করে গোলান মালভূমিতে জাতিসঙ্ঘের নির্ধারিত বাফার জোন এলাকায় ইসরাইলি সামরিক বাহিনীর প্রবেশের নিন্দা জানায় তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এক বিবৃতিতে তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, সিরিয়ার জনগণ বহু বছর ধরে যে শান্তি ও স্থিতিশীলতার আকাক্সক্ষা করে আসছে, বর্তমানে তা অর্জনের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। কিন্তু মর্মান্তিক বিষয় হলো স্পর্শকাতর এই সময়ে ইসরাইল আবার তার দখলদার মানসিকতা প্রদর্শন করছে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, সিরিয়াকে তার জনগণের শাসন করা উচিত। তুরস্ক একটি ঐক্যবদ্ধ এবং সন্ত্রাসমুক্ত সিরিয়া গঠনে সর্বাত্মক সহায়তা চালিয়ে যাবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement