বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদী আদর্শের উত্থানে যেভাবে কাজ করছে বিজেপি
ডিপ্লোম্যাট বিশ্লেষণ- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ১২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০
মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশে যাতে ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রতীক ও স্লোগান জনপ্রিয়তা পায় সে টার্গেট নিয়ে কাজ করছে দেশটির ক্ষমতাসীন দল বিজেপি। মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেয়ার পর দিন গত ৯ আগস্ট, হিন্দু ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা, শাহবাগ চত্বরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় নেমে আসে। তারা ৫-৮ আগস্টে হিন্দুদের বাড়ি, ব্যবসা এবং উপাসনালয়কে লক্ষ্য করে কথিত আক্রমণের প্রতিবাদ জানায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক অনলাইন সংবাদমাধ্যম দি ডিপ্লোম্যাটের বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ এবং বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের মতো বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সংখ্যালঘু অধিকার সংগঠনগুলোর আহ্বানে সাড়া দিয়ে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় জড়ো হয়েছিল। নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচারের দাবিতে স্লোগান দেয়ার সময়, সেখানে কয়েকজন ছিল যারা ‘জয় শ্রী রাম’ (রামের বিজয়), ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদী শক্তির সাথে যুক্ত একটি বিতর্কিত স্লোগান উচ্চারণ করে।
১১ আগস্ট, বিক্ষোভের তৃতীয় দিনে, একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ হিন্দু জাগরণ মঞ্চ (বিএইচজেএম) গঠিত হয় এবং নীহার হালদার, জুয়েল আইচ আরকো, জয় রাজবংশী, রনি রাজবংশী এবং প্রদীপ কান্তি দে-এর সমন্বয়কারী এবং মূল মুখপাত্র হিসেবে আবির্ভূত হন। একই দিনে বিএইচজেএম-এর ফেসবুক গ্রুপ তৈরি করা হয়।
বাংলাদেশ হিন্দু জাগরণ মঞ্চ নামটি কৌতূহলজনকভাবে হিন্দু জাগরণ মঞ্চ (BHJM), ভারতের ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (BJP) এর আদর্শিক-সাংগঠনিক পিতা রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ (RSS) এর সহযোগী। অনেক (BHJM) নেতাও বিজেপিতে কাজ করেছেন। বিএইচজেএমই ছিল প্রথম ভারতীয় সংগঠন যারা বাংলাদেশে হিন্দুদের উপর নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। তারা ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী কলকাতায় একটি সমাবেশ করেছিল ইউনূসের শপথ নেয়ার আগেও।
বাংলাদেশে এর পরের সপ্তাহগুলোতে, ঐতিহ্যগত সংখ্যালঘু অধিকার সংগঠনগুলো পটভূমিতে ফিরে যায়, যখন নতুন প্ল্যাটফর্ম, ইঐঔগ, প্রাধান্য পায়। এর মূল সংগঠকরা সবাই বাংলাদেশ হিন্দু ছাত্র মহাজোট এবং হিন্দু যুব মহাজোটের সাথে জড়িত ছিল, যা বাংলাদেশ জয়তো হিন্দু মহাজোটের (বিজেএইচএম) ছাত্র ও যুব শাখা। BJHM হলো একটি হিন্দু অধিকার সংগঠন যেটি ঢাকায় ২০০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এই সংগঠনটিই বাংলাদেশে হিন্দুত্বের শিকড় খুঁজে বেড়ায়।
বিজেপি এবং বিএইচজেএমসহ আরএসএস এবং এর সহযোগী সংগঠনগুলোকে একত্রে সঙ্ঘ পরিবার বা আরএসএস পরিবার বলা হয়। তাদের স্বঘোষিত মতাদর্শ হলো হিন্দুত্ব, যাকে তারা ‘হিন্দু সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’ হিসাবে বর্ণনা করে। তারা একে জাতীয়তাবাদ বললেও তা ভারতীয় জাতির বর্তমান ভৌগোলিক সীমানায় সীমাবদ্ধ নয়। আফগানিস্তান থেকে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার, নেপাল ও তিব্বত থেকে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত বিস্তৃত একটি কল্পিত সত্তা অখণ্ড ভারত বা অবিভক্ত ভারতকে পুনরুদ্ধার করার ধারণাকে সঙ্ঘ পরিবার প্রচার করে।
একটি বিতর্কিত ভারত সফর : ১২ আগস্ট, পূজা পার্বণ নামে ৩৪ হাজার অনুসারীসহ একটি ফেসবুক পেজ, নিহার হালদার এবং প্রাক্তন ইসকন সন্ন্যাসী চিন্ময় দাসকে হিন্দুদের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য আহ্বান জানায়। পরের কয়েক সপ্তাহে, হালদার এবং দাস হিন্দু বিক্ষোভের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংগঠকদের মধ্যে আবির্ভূত হন। হালদার বিএইচজেএম-এ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে চলেছেন, যেটি ৮ সেপ্টেম্বর, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০ সেপ্টেম্বর এবং ২৭ সেপ্টেম্বরসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ধারাবাহিক বিক্ষোভ চালিয়েছিল। ২৭ সেপ্টেম্বর, বিএইচজেএম একটি সপ্তাহব্যাপী প্রতিবাদ ঘোষণা করেছিল। এ দিকে দাস, চট্টগ্রামে মূল মুখ হিসেবে আবির্ভূত হন, যেখানে সম্মিলিত সনাতনী ছাত্র সমাজের ব্যানারে বিক্ষোভ সংঘটিত হচ্ছিল।
যাই হোক, ৩০ সেপ্টেম্বর, বিএইচজেএম বিভক্ত হয়ে যায়, দৃশ্যত হাসিনার আওয়ামী লীগ (এএল) বা বিজেপিকে আন্দোলনে প্রভাব ফেলতে দেয়ার জন্য। হালদারের ভারত সফর প্রধান ইস্যু হয়ে ওঠে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি ভারতে যান হালদার। তিনি তার একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতাদের সাথে তার বৈঠকের ছবি শেয়ার করেন, যা পরে স্থগিত করা হয়েছিল।
অক্টোবর জুড়ে, বিএইচজেএম এবং বিএসজেএম উভয়ই পৃথকভাবে প্রতিবাদ সংঘটিত করেছিল, যদিও পরবর্তীটি আরও প্রাধান্য লাভ করেছিল। নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশে ফিরে আসার পর, হালদারের প্রথম জনসম্মুখে উপস্থিতি ছিল চিন্ময় দাসের সাথে, যিনি ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক ঝড়ের কেন্দ্রে আবির্ভূত হয়েছেন।
১৭ নভেম্বর, বিএসজেএম বাংলাদেশ সম্মিলিত সংখ্যালঘু জোটের সাথে একীভূত হয়, সেটি ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে গঠিত বিভিন্ন ঐতিহ্যবাহী হিন্দু সংগঠনের একটি প্ল্যাটফর্ম, বাংলাদেশ সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট নামে একটি নতুন প্ল্যাটফর্ম চালু করার জন্য এ উদ্যোগ নেয়া হয়, যার মুখপাত্র হচ্ছে চিন্ময় দাস। ২২ নভেম্বর, দাস যুক্তি দিয়ে বলেন, সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো দ্বারা উচ্চারিত হওয়া সত্ত্বেও যদি আল্লাহু আকবর একটি সন্ত্রাসী স্লোগান না হয় তবে জয় শ্রী রাম বিজেপি-আরএসএসের সাথেও বিশেষভাবে যুক্ত হতে পারে না। ভারতে বিজেপির সমালোচকরা যুক্তি দিয়েছেন যে জয় সিয়া রাম, হে রাম, রাম রাম, হরে কৃষ্ণ হরে রাম ঐতিহ্যগত উপায়ে ধর্মীয় হিন্দুরা রামের প্রশংসা করে, কিন্তু জয় শ্রী রাম একটি রাজনৈতিক স্লোগান।
বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদ : বাংলাদেশের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা ২০০৬ সালে বিজেএইচএম বা হিন্দু মহাজোটের ভিত্তির মধ্যে বাংলাদেশে হিন্দুত্ব মতাদর্শের মূলের সন্ধান করেন। এটি তাদের নেতাদের একটি অংশ যারা জয় শ্রী রামের মতো স্লোগান ব্যবহার করা শুরু করে। পরের বছর, তারা ছোট পরিসরে, রাম নবমী, একটি উৎসব যা ভারতের হিন্দু জাতীয়তাবাদীরা সক্রিয় হয়ে ওঠার আয়োজন করে। হিন্দু মহাজোট বিদেশে শাখা খুলেছে এবং আরএসএস-এর আরেকটি সহযোগী বিশ্ব হিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) সঙ্গে সাংগঠনিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে।
২০১৬ সালে, BJHM বিভক্ত হয়। তারা ২০২০ সালের শুরুতে আবার বিভক্ত হয়ে পড়ে, প্রভাস চন্দ্র রায় এবং পলাশ কান্তি দে-এর নেতৃত্বে একটি দল মহাসচিব গোবিন্দ প্রামাণিককে পুনরায় বহিষ্কার করে এবং প্রামাণিক অন্য উপদলকে বহিষ্কার করে। বিভক্তির কারণ ছিল প্রামাণিকের রাজনৈতিক অবস্থান তিনি আওয়ামী লীগকে ‘নিঃশর্ত সমর্থন’ করার হিন্দু কৌশলে আপত্তি করেছিলেন।
বিভক্তির পরে, রায়-দে উপদল এবং প্রামাণিক উপদল উভয়ই হিন্দুত্বকে তাদের আদর্শ হিসাবে দাবি করতে থাকে, যদিও প্রামাণিক হাসিনার বিরোধীদের, প্রধানত বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং জামায়াতে ইসলামী (জেআই) এর সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। রায়-দে উপদল বলেছে যে, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী শক্তির সঙ্গে কোনো ধরনের যোগসাজশ গ্রহণযোগ্য নয়।
হাসিনার পতনের পরে বিক্ষোভে, বিজেএইচএম-এর রায়-দে উপদলের ছাত্র এবং যুব কর্মীরা হিন্দু জাগরণ মঞ্চ এবং পরবর্তীকালে সনাতন জাগরণ মঞ্চ গঠনসহ হিন্দু দলগুলোর মধ্যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ডিপ্লোম্যাটকে একজন বিজেএইচএম সদস্য বলেছেন যে জয় শ্রী রাম স্লোগান, ক্রুদ্ধ হনুমানের চিত্র, রাম নবমীর মতো উৎসব এবং ইস্যুতে প্রচারণার মতো ভারতের হিন্দুত্বের প্রতীক ব্যবহার করা হয়েছে। ২০২১ সালের শেষের দিকে হিন্দুদের উপর আক্রমণ অনেককে কট্টর হিন্দুত্ব গ্রহণ করতে প্ররোচিত করেছিল, যেমনটি ভারতে আরএসএস অনুশীলন করে। তারা জয় শ্রী রামকে ইসলামিক মৌলবাদের বিরুদ্ধে হিন্দু প্রতিরোধের স্লোগান হিসেবে গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। বিশেষ করে যুবকরা, ভারতীয় ব্যবহারকারীদের আরএসএস-সংযুক্ত সোশ্যাল মিডিয়া আউটলেটগুলোকে ঘনিষ্ঠভাবে অনুসরণ করতে শুরু করেছে।
২০২২ সালে, BJHM-এর উভয় দলই রাম নবমী উদযাপনের আয়োজন করেছিল। আগস্ট ২০২২ সালে, জন্মাষ্টমীর সময়, ভগবান কৃষ্ণের সাথে যুক্ত একটি হিন্দু উৎসব, তাদের স্লোগান ছিল ‘জিনি-ই কৃষ্ণ তিন-ই রাম/ জয় শ্রী রাম, জয় শ্রী রাম’ (কৃষ্ণ এবং রাম একই/ রামের বিজয়)। তারা “জয় হিন্দুত্ব” (হিন্দুত্বের জয়) মতো স্লোগানও তুলেছিল।
২০২৩ সালে, জাতীয় হিন্দু ছাত্র মহাজোট নিজেকে বাংলাদেশের প্রথম হিন্দুত্ববাদী (হিন্দুত্ব-অনুসরণকারী) ছাত্র সংগঠন হিসেবে বর্ণনা করে যা হিন্দু এবং হিন্দুত্ব রক্ষায় নিবেদিত। রনি রাজবংশী, BHJM-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ২০২৩ সালে মহাকাল স্বয়ংসেবক ফাউন্ডেশন (MSF) প্রতিষ্ঠা করেন। স্বয়ংসেবক আবার RSS-এর সাথে যুক্ত একটি শব্দ। স্বেচ্ছাসেবকদের বোঝাতে শুধু আরএসএস-এর সাথে যুক্ত লোকেরা ভারতে এই শব্দটি ব্যবহার করে। বাংলাদেশে, এমএসএফও তাদের স্বেচ্ছাসেবকদের স্বয়ংসেবক বলে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা