সব দলকে একজোট থাকতে হবে
রাজনীতিকদের সাথে বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:০০, আপডেট: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০:১৩
দেশের বর্তমান বাস্তবতা বিশ্বের কাছে প্রতিষ্ঠিত করতে সব দলকে একজোট থাকার আহ্বান জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল বুধবার রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে সংলাপের সূচনা বক্তব্যে তিনি এ আহ্বান জানান। যে ‘নতুন বাংলাদেশ’ গড়ে তোলার চেষ্টা চলছে সেটি ধামাচাপা দিয়ে ‘আরেক বাংলাদেশের’ কল্পকাহিনী রচনার অপচেষ্টা চালানোর কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, এটি যে শুধু এক দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ আছে, তাও নয়। বিশেষ বিশেষ বড় বড় দেশের মধ্যেও এটি ছড়িয়ে গেছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বিভিন্ন দিক থেকে তারা একটা কাল্পনিক বাংলাদেশ তৈরি করেছে দুনিয়ার সামনে, তাদের শক্তি এত বেশি। ক্রমে তারা মানুষকে এটিতে ভেড়াতে পারছে, নতুন কল্পকাহিনী তারা তৈরি করছে। তা নিয়ে অনেকে সন্দেহও প্রকাশ করেছে- এখানে কী ধরনের সরকার হয়েছে। তাদের কী আমরা বাধা দিয়েছি আসতে? আমরা তাদের বলেছি, আসেন দেখে যান। এখানে কোনো বাধা নেই। কিন্তু তারা ওখান থেকে কল্পকাহিনী বানিয়ে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের বিরাট অভ্যুত্থানটা তাদের পছন্দ হয়নি, তারা এটি মুছে দিতে চান, আড়াল করতে চান। এটিকে নতুন ভঙ্গিতে দুনিয়ার সামনে পেশ করতে চান যেন আমাদের এখানে ভয়ঙ্কর কাণ্ড হয়ে গিয়েছে, সেখান থেকে আমাদের রক্ষা করতে হবে।’
রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে ড. ইউনূস বলেন, সেটা মিথ্যা প্রমাণ করা, বাস্তবকে সেখানে প্রতিষ্ঠিত করতে আমাদের সবার একজোট হতে হবে। এটি কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদের কিছু না, জাতি হিসেবে আমাদের অস্তিত্বের বিষয়। অপপ্রচার ঠেকাতে সবাইকে একজোট হওয়ার পরামর্শ দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এখন আমাদের সারা দুনিয়াকে বলতে হবে আমরা এক। আমরা যে পেয়েছি তা একযোগে পেয়েছি। কোনো মতভেদের মধ্যে পাইনি। কাউকে ধাক্কাধাক্কি করে পাইনি। যারা আমাদের বুকের ওপর চেপেছিল তাদেরকে আমরা বের করে দিয়েছি। আমার নিজেরাই উন্মুক্ত হয়েছি। সে জিনিসটা সবার সামনে তুলে ধরা। কিভাবে তুলব এ ব্যাপারে পরামর্শ সবাই মিলে যেন আমরা এটি করতে পারি। তিনি বলেন, কারণ নতুন বাংলাদেশের যাত্রাপথে এটি একটি মস্তবড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, অস্তিত্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবাই একত্র হয়ে বললে একটি সমবেত শক্তি তৈরি হয়, এ সমবেত শক্তির জন্যই আপনাদের সাথে বসা।
ড. ইউনূস বলেন, আমরা কেন জানি মানুষের ক্রোধ থেকে মুক্ত হতে পারছি না। বিজয়ের মাসে আরো বেশি করে আনন্দ করার কথা আমাদের। কিন্তু আমাদের এই স্বাধীনতা অনেকের কাছে পছন্দ হচ্ছে না। ৫ আগস্টের পর থেকে কী হয়েছে, বাস্তবের পরিপ্রেক্ষিতে আপনারা তা দেখেছেন। আমরা এই পরিস্থিতিতে মনে করেছিলাম দুর্গাপূজা নিয়ে একটা হাঙ্গামা শুরু হবে। সেখানে আপনারা সবাই ঐক্যের মধ্যে শরিক হয়েছিলেন। দেশজুড়ে শান্তিপূর্ণভাবে পূজা পালিত হয়েছে। কোথাও কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা হয়নি। সেটিও অনেকের পছন্দ হয়নি। দেশকে নতুন করে অস্থির করার চেষ্টা চলছে। এখন যে চেষ্টা চলছে সেখানে বিশেষভাবে আমরা আপনাদের চাচ্ছি। তিনি বলেন, যে বাংলাদেশ আমরা গড়ে তোলার চেষ্টা করছি, সেটিকে ধামাচাপা দিয়ে তারা আগের বাংলাদেশের কাহিনী রচনা করে যাচ্ছে। সারাক্ষণ নানা রূপে তারা এটি করে যাচ্ছে। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি থেকে দেশকে রক্ষা করতে হবে। এখন সেগুলোকে মিথ্যা প্রমাণ করা বা বাস্তবতাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আমাদের সবাইকে একজোট হতে হবে। এটি কোনো বিশেষ রাজনৈতিক মতবাদের বিষয় না।
বাংলাদেশ নিয়ে ষড়যন্ত্রকারীদের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরি করলাম, তারা এটিকে মুছে দিয়ে আগেরটায় ফিরে যেতে চায়। মুখে বলছে না যে আগেরটা, কিন্তু ভঙ্গি হলো আগেরটা ভালো ছিল। তাদের শক্তি এত বেশি যে, তারা মানুষকে এর ভেতরে ভেড়াতে পারছে। তাদের কল্পকাহিনীতে মানুষ সন্দেহ প্রকাশ করছে যে এটি কী ধরনের সরকার হলো।
বাংলাদেশের মুক্তি ও স্বাধীনতা অনেকের কাছে পছন্দ হচ্ছে না মন্তব্য করে ড. ইউনূস বলেন, নানাভাবে নানা গতিতে এটিকে উল্টে দেয়ার চেষ্টা ৫ আগস্টের পর থেকে কত রকমভাবে যে এসেছে, সেটি আপনারা আমার চেয়ে ভালো জানেন। অভ্যুত্থান যাদের পছন্দ হয়নি, তারা এটি ‘মুছে দিতে চায়’ মন্তব্য করে তিনি রাজনৈতিক নেতাদের উদ্দেশে বলেন, তারা নতুন নতুন বেশে নতুন নতুনভাবে চেষ্টা করেই যাচ্ছে। এখন যে চেষ্টা চলছে, সেটির বিশেষ একটা রূপ আছে। সে জন্য বিশেষভাবে আপনাদের ডাকা।
সংলাপে অংশ নেয়া বিএনপির প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন। তার সাথে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও অধ্যাপক এ জেড এম জাহিদ হোসেন।
আমির ডা: শফিকুর রহমানের নেতৃত্বে জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিদলে ছিলেন নায়েবে আমির মজিবুর রহমান, সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম। এ ছাড়া নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাংলাদেশ জাসদ), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি), বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক মুভমেন্ট (এনডিএম), বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি (বিজেপি), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ও বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এ বি পার্টি), গণ অধিকার পরিষদ (জিওপি) নেতারাও সংলাপে যোগ দেন।
বাংলাদেশকে দুর্বল নতজানু শক্তিহীন ভাবার অবকাশ নেই : আসিফ নজরুল
বিশেষ সংবাদদাতা জানান, বাংলাদেশকে দুর্বল, নতজানু ও শক্তিহীন ভাবার কোনো অবকাশ নেই বলে জানিয়েছেন আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুল। তিনি বলেন, সবার উপরে দেশ, এটা থেকে আমরা কখনো বিচ্যুত হবো না। যেকোনো ধরনের অপপ্রচার এবং উসকানির বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব এবং আমাদের ঐক্য অটুট রাখব।
গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদের সাথে সংলাপ করেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন আইন উপদেষ্টা।
অধ্যাপক আসিফ নজরুল বলেন, বাংলাদেশবিরোধী বিভিন্ন তৎপরতা চলছে। হাইকমিশনে হামলা, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ, বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণা- এসবের তীব্র নিন্দা জানানো হয়েছে। ভারতের এসব পদক্ষেপের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকার যে আত্মমর্যাদাশীল সাহসী ভূমিকা রেখেছে তার প্রশংসা করেছেন রাজনীতিবিদরা। একই সাথে সরকারের সাথে সলিডারিটি (সংহতি) প্রকাশ করেছেন তারা। তিনি বলেন, ভারতের এসব প্রচারণার বিরুদ্ধে আরো শক্তিশালীভাবে এবং আরো বেগবানভাবে সেগুলো মোকাবেলার কথা বলা হয়েছে সংলাপে। এ জন্য আমাদের যারা প্রবাসী, বন্ধুরাষ্ট্রের সহযোগিতা এবং বিদেশী সাংবাদিকদের নিয়ে আসার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। আমাদের যোগাযোগ দক্ষতা এবং আইনি দক্ষতা বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে।
গত ১৫ বছরে ফ্যাসিস্ট (আওয়ামী লীগ) সরকারের সময়ে ভারতের সাথে যত চুক্তি হয়েছে সেগুলো প্রকাশের দাবি জানানো হয়েছে জানিয়ে আইন উপদেষ্টা বলেন, রামপালসহ বাংলাদেশের জন্য ক্ষতিকর যেসব চুক্তি রয়েছে সেগুলো বাতিল করার দাবি জানানো হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রতি ভারতের যে অর্থনৈতিক নিপীড়ন, সাংস্কৃতিক আধিপত্য, অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানোর চেষ্টা- এসবের নিন্দা জানানো হয়েছে। একই সাথে ভারতকে বাংলাদেশের প্রতি মর্যাদাশীল এবং সৎ প্রতিবেশী আচরণ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
অধ্যাপক আসিফ নজরুল আরো বলেন, ভারত বাংলাদেশবিরোধী যে অপপ্রচার চালাচ্ছে, এই পরিস্থিতি মোকাবেলায় সব সম্প্রদায়ের ভূমিকার প্রশংসা করা হয়েছে। একই সাথে যেকোনো উসকানির মুখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রাখার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, সবাই একটা কথা বলেছেন, আমাদের আর শক্তিহীন, দুর্বল, নতজানু ভাবার কোনো রকম অবকাশ নেই। যেকোনো ধরনের অপপ্রচার এবং উসকানির বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকব এবং আমাদের ঐক্য অটুট রাখব। আমরা সাজাগ থাকব ভবিষ্যতে যেকোনো প্রচারণা এলে, উসকানি এলে আমরা আমাদের ঐক্য আরো বেগবান রাখার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব। সংলাপে কিছু প্রস্তাব এসেছে জানিয়ে সরকারের এ উপদেষ্টা বলেন, গোটা জাতি ভারতের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে যে ঐক্যবদ্ধ আছে, সবাই মিলে একটা সমাবেশ করতে পারি কি না, সবাই মিলে পলিটিক্যাল একটা কাউন্সিল করতে পারে কি না, নিরাপত্তা কাউন্সিল করতে পারে কি না- এ জন্য প্রস্তাবনা এসেছে। মূল কথা ছিল, আমাদের মধ্যে মত, পথ, আদর্শের ভিন্নতা থাকবে, আমাদের রাজনৈতিক ভিন্নতা থাকবে, অবস্থার ভিন্নতা থাকবে; কিন্তু দেশ, সার্বভৌমত্ব এবং অস্তিত্বের প্রশ্নে আমরা সবাই এক।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা