০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ অগ্রহায়ন ১৪৩১,
`
বিবিসির বিশ্লেষণ

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক কি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যাচ্ছে

-


ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে অবস্থায় পৌঁছেছে।। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়ার পর থেকে চিন্ময় কৃষ্ণের গ্রেফতার পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় দুই দেশের সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৩ বছরের মধ্যে ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক এত খারাপ হয়নি কখনো। বিশেষ করে চিন্ময়কে গ্রেফতারের পর ভারতে বাংলাদেশের দূতাবাসগুলোর সামনে বিক্ষোভ এবং আগরতলা সহ হাইকমিশনে হামলা-ভাঙচুরের পর উত্তেজনা তুঙ্গে। ভারতের হাইকমিশনারকে তলব করে ব্যাখ্যাও চেয়েছে বাংলাদেশ, যা এক বিরল ঘটনা।

ব্রিটিশ মিডিয়া বিবিসি মনে করছে, ভারতে শেখ হাসিনার অবস্থান বাংলাদেশের সঙ্গে দেশটির সম্পর্কে বড় ধরনের ফাটল সৃষ্টি করেছে। দুই দেশের মধ্যে কথার লড়াই এখন নিত্যদিনের ঘটনা। অবস্থা খারাপ হতে হতে কি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে? এমন আশঙ্কা ক্রমেই বাড়ছে। উভয় দেশের বিশেষজ্ঞ মতামত বিশ্লেষণ করে বিবিসি এক প্রতিবেদন তৈরি করেছে। তাতে বলা হয়েছে, ধর্মীয় উত্তেজনা এই অঞ্চলে নতুন নয়। তবে দুই দেশের মধ্যে যে উত্তেজক বক্তৃতা চলছে তা অব্যাহত থাকলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। উভয় দেশেই ক্রমবর্ধমান বিক্ষোভ পরিবেশের অবনতি ঘটাতে পারে।

বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন যে, ভারত এবং বাংলাদেশ এমন প্রতিবেশী দুই দেশ যাদের একে অপরের প্রয়োজন। কিন্তু এই বিক্ষোভগুলো সাধারণ মানুষদেরও প্রভাবিত করেছে যারা ব্যবসা, পর্যটন বা চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ থেকে ভারতে যান। এরই মধ্যে ভারতের অনেক স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য রফতানি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। মুহাম্মদ ইনায়েতুল্লাহ যখন তার বন্ধুদের সাথে দেখা করতে এই সপ্তাহের শুরুতে ভারতে প্রবেশ করছিলেন, তখন তিনি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের পেট্রাপোল সীমান্তে হিন্দু কর্মীদের একটি বিক্ষোভ দেখেন। ইনায়েতুল্লাহ বলেন, ‘আপনি যখন সীমান্ত অতিক্রম করেন তখন লোকদের আপনার দেশের বিরুদ্ধে সেøাগান দিতে শুনতে ভালো লাগার কথা না।’

গত সপ্তাহে বাংলাদেশে একজন সনাতন হিন্দুকে গ্রেফতার করা হলে ভারতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভারতীয় জনতা পার্টিসহ (বিজেপি) উগ্রবাদী হিন্দু সংগঠনের কর্মী এবং রাজনীতিবিদরা এ গ্রেফতারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করেছে। ভারতের জন্য বিব্রতকর অবস্থা তৈরি হয় যখন কয়েক ডজন বিক্ষোভকারী উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শহর আগরতলায় বাংলাদেশের কনস্যুলেট ভবনে প্রবেশ করে এবং তা ভাঙচুর করে। এর কয়েক ঘণ্টা পর কনস্যুলেটে হামলার প্রতিবাদে ঢাকায় কয়েকশ’ শিক্ষার্থী ও নেতাকর্মী বিক্ষোভ করে। অবশ্য ভারত সরকার এই হামলাকে ‘গভীরভাবে দুঃখজনক’ বলে অভিহিত করেছে। ভারতে বাংলাদেশের কূটনৈতিক ভবনগুলোর নিরাপত্তা জোরদার করা হয়েছে। এ ঘটনায় সাতজনকে আটক করেছে পুলিশ।

বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই হামলাকে ‘জঘন্য’ বলে বর্ণনা করেছে এবং দিল্লিকে একটি পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত এবং ‘বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনের বিরুদ্ধে আর কোনো সহিংসতা প্রতিরোধ করার’ আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, ‘এটি অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক এবং এটি একটি অগ্রহণযোগ্য পরিস্থিতি। হিন্দু চরমপন্থীরা চত্বরে ঢুকে পড়ে, পতাকা স্ট্যান্ডকে টেনে নামিয়ে দেয় এবং [বাংলাদেশের] পতাকাকে অপমান করে। আমাদের কর্মকর্তা ও কর্মীরা অত্যন্ত ভীত ছিল।’

বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন যে ভারতে বিক্ষোভ- সীমান্তের কাছে ঘটেছে- বেশ কয়েকটি ভারতীয় মিডিয়া আউটলেটের ইস্যুটির বিভ্রান্তি এবং উত্তপ্ত কভারেজের কারণে শুরু হয়েছে। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘দুর্ভাগ্যবশত, ভারতীয় মিডিয়া এই ইস্যুতে নির্বিকার হয়ে গেছে। তারা বাংলাদেশকে সম্ভাব্য অন্ধকারে তুলে ধরার চেষ্টা করছে। আমি জানি না কেন তারা এটা করছে এবং এতে বাংলাদেশ বা ভারত উভয়েরই কি উপকার হবে, আমি বুঝতে ব্যর্থ।
ভারতের বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, বাংলাদেশের পরিস্থিতির প্রভাব প্রতিবেশী দেশটিতে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। বাংলাদেশে ভারতের সাবেক হাইকমিশনার পিনাক রঞ্জন চক্রবর্তী বলেছেন, ভারতের কাছে বাংলাদেশ শুধু প্রতিবেশী দেশ নয়, বরং কৌশলগত অংশীদার এবং ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মিত্র, বিশেষ করে উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে। দুই দেশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত সম্পর্কও রয়েছে।

বাংলাদেশের ১৭০ মিলিয়ন জনসংখ্যার প্রায় ১০% হিন্দু। তাদের নেতারা দীর্ঘদিন ধরে ইসলামপন্থী এবং কিছু রাজনৈতিক দল তাদের বিরুদ্ধে বৈষম্য এবং ঘৃণামূলক আচরণ নজরে আসছে বলে দাবি করে আসছেন। গত আগস্টে গণবিপ্লবে হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তার অনেক সমর্থককে লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছিল, যাদের মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুও থাকতে পারে। কারণ ঐতিহ্যগতভাবে তাদেরকে হাসিনার দল আওয়ামী লীগের সমর্থনকারী হিসেবে দেখা যায়। সপ্তাহ খানেক শান্ত থাকার পর হিন্দু নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেফতারের পর পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। অক্টোবর মাসে চট্টগ্রামে সংখ্যালঘু অধিকারের দাবিতে বিক্ষোভ করার পর তাকে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। সেখানে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা অবমাননার অভিযোগ আনা হয়।

গত সপ্তাহে, চট্টগ্রামের একটি আদালত তার জামিন আবেদন নাকচ করে দেয়ার পরে হিন্দুদের বিক্ষোভ পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে রূপ নিলে একজন মুসলিম আইনজীবীর মৃত্যু হয়। অভিযোগ রয়েছে ওই আইনজীবীকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ওই সহিংসতার ঘটনায় কয়েক ডজন লোককে গ্রেফতার করা হয়েছে।
মঙ্গলবার কোনো আইনজীবী তার পক্ষে না আসায় চিন্ময় দাসের জামিন শুনানি ২ জানুয়ারি পর্যন্ত পিছিয়ে দেয়া হয়। চিন্ময় দাস এর আগে ধর্মীয় সংগঠন ইসকনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে ঢাকার ইসকনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হৃষিকেশ গৌরাঙ্গ দাস বিবিসিকে বলেছেন, এই বছরের শুরুতে শৃঙ্খলাভঙ্গের কারণে চিন্ময়কে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। তিনি বলেন, কিছু ছাত্র অভিযোগ করেছে যে, চিন্ময় দাস তাদের সাথে অবৈধ আচরণ করেছেন। তাই বিষয়টি তদন্তে সহযোগিতা চেয়ে চিঠি পাঠানো হলে তিনি সহযোগিতা করতে অস্বীকার করেন। কারাগারে থাকা চিন্ময় দাসের একজন সমর্থক বিবিসিকে বলেছেন যে, অভিযোগগুলো মিথ্যা এবং ঢাকা ও চট্টগ্রামের ইসকন নেতাদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব থেকে এ পরিস্থিতি উদ্ভূত হয়েছে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার বলেছে যে তারা পরিস্থিতির স্পর্শকাতরতা সম্পর্কে সচেতন এবং তারা সব সম্প্রদায়ের প্রতি সমান আচরণ করে। ড. ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, আমরা ইসকন, হিন্দু মন্দির এবং যেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বাস করে সেখানে নিরাপত্তা দেয়ার জন্য অতিরিক্ত বাহিনী মোতায়েন করেছি। সেখানে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা থাকতে পারে কিন্তু সংখ্যালঘুদের ওপর কোনো সাজানো হামলা বা মামলা নেই।


আরো সংবাদ



premium cement