চোরতন্ত্রে পরিণত হয় দেশ
সংবাদ সম্মেলনে শ্বেতপত্র কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয়- বিশেষ সংবাদদাতা
- ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:১০
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশকে ‘চামচা পুঁজিবাদ’ থেকে চোরতন্ত্রের দেশে পরিণত করা হয়েছে। আইনসভা, নির্বাহী বিভাগসহ সবাই গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে চুরির অংশ হয়ে গেছে। এটাই চোরতন্ত্র। এতে রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এবং উর্দি পরা কিংবা উর্দি ছাড়া আমলারা সহযোগী হন। এই চোরতন্ত্রের উৎস ২০১৮ সালের নির্বাচন। এমন মন্তব্য করেছেন অর্থনীতির অবস্থা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এ ছাড়া তিনি বলেন, আমি জাতিসঙ্ঘের বিভিন্ন দেশ নিয়ে কাজ করি। আমি বলতে চাই, বাংলাদেশ এলডিসি গ্রুপে থাকার মতো দেশ না। আমাদের সক্ষমতা, যোগ্যতা, স্থায়িত্ব ও কার্যকারিতা- এসব দিয়ে এলডিসি গ্রুপে থাকার মতো কারণ নেই।
শ্বেতপত্র প্রকাশ উপলক্ষে গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে পরিকল্পনা কমিশনের একনেক সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। এর আগে গত রোববার শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি তাদের প্রতিবেদন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেন।
এ উপলক্ষে গতকালের সংবাদ সম্মেলনে অন্যান্যের মধ্যে ড. জাহিদ হোসেন বলেন, হিসাবের গরমিলের কারণে বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়ে গেছে। আর ড. তামীম বলেন, আগের সরকারের সময় পলিসি করে দুর্নীতির পথ সুগম করা হয়েছে। এ সময় আরো বক্তব্য রাখেন, প্রণয়ন কমিটির সদস্য অধ্যাপক এ কে এনামুল হক, অধ্যাপক আবু ইউসুফ, ড. তাসনীম সিদ্দিকী, ইমরান মতিন প্রমুখ।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, আমাদের দুর্নীতির ক্ষেত্রে এক নম্বরে ব্যাংকিং খাত, এর পর অবকাঠামো খাত, তারপর জ্বালানি খাত এবং এর পরই আইসিটি খাত। ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ চুরি হয়েছে অবকাঠামো খাতের প্রকল্পে। আর আইসিটি খাতে প্রচুর টাকা গেছে। এখানে অভিনবভাবে চুরি হয়েছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ হিসেবে ফাঁদে পড়েছে। দেশে দারিদ্র্য নিরসনে যে অর্জন তা টোকা দিলেই ভেঙে পড়বে। বাংলাদেশের অবস্থা এলডিসি (লিস্ট ডেভেলপড কান্ট্রি বা স্বল্পোন্নত দেশ) গ্রুপে থাকার মতো না। বাংলাদেশ এখন মধ্যম আয়ের ফাঁদে আটকে গেছে। এর থেকে উত্তরণে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও যথাযথ সংস্কার প্রয়োজন।
চোরতন্ত্রের ব্যাপারে তিনি বলেন, গত তিনটি বিষবৃক্ষ নির্বাচন দেশকে চোরতন্ত্রে পরিণত করেছে। স্থানীয় সরকারকে দুর্বল করা হয়েছে। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক ও আইনশৃঙ্খলায় স্থিতিশীলতা না আনতে পারলে সামনে বিপদ হবে। আমাদেরকে মধ্যমেয়াদি পরিকল্পনা করতে হবে। সেটা না করলে আমরা বিদেশীদের সাথে কথা বলতে পারবো না। এটা দ্রুততর করতে হবে। পাশাপাশি অন্তর্বর্তী সরকারের দুই বছর মেয়াদি পরিকল্পনাও নিতে হবে। দেবপ্রিয় বলেন, কর্মসংস্থান হলো না, বিনিয়োগ হলো না, ভেলকির প্রবৃদ্ধি হলো। বর্তমান সরকারকে আগামী দুই বছরের কর্মপরিকল্পনা তৈরির পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, দেশের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা না গেলে দীর্ঘমেয়াদি সংস্কার কার্যক্রম করা যাবে না।
করণীয় বিষয়ে দেবপ্রিয় বলেন, আগামী ৬ মাস দেশ ও জাতির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ সময়। যতক্ষণ না নতুন বাজেট আসছে সে সময় পর্যন্ত আগামী ৬ মাস সরকার অর্থনীতিতে কী পরিকল্পনা নেয়, তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য কী, তার একটা চিত্র পরিকল্পনা জনগণকে দিতে হবে। যদি সংসদ থাকতো, তাহলে কিন্তু তারা এসব দিতে বাধ্য হতেন। যেহেতু সংসদ নেই তাই প্রত্যক্ষভাবে তাদেরকে জনগণের কাছে এটা দিতে হবে।
অনুষ্ঠানে সিপিডির সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মেগা প্রকল্পের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ পাচার করা হয়েছে। দুর্নীতির একটা বড় অংশ স্যাডো অর্থনীতিতে ছিল। তবে সব টাকা বাইরে নিয়ে যায়নি। দেশের সব ধরনের ক্ষতি করেই টাকা দেশের বাহিরে চলে গেছে। তিনি বলেন, মেগা প্রকল্পে যে লুটপাট হয়েছে তা কয়েক প্রজন্ম ধরে শোধ করতে হবে। তাই বৈদেশিক ঋণের সুদের হার, গ্রেস পিরিয়ড এগুলো নিয়ে বৈদেশিক উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারকে আলোচনা করতে হবে। ঋণ পুনর্বিবেচনার কোনো বিকল্প নেই। এ ব্যাপারে সরকারকে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। পাশাপাশি দেশের রাজস্ব বাড়াতে আয়কর আদায়ে জোর দিতে হবে।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, এত দিন ভেবেছিলাম, আমরা মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়ার শঙ্কায় আছি। এখন আমরা বলছি, আমরা সেই ফাঁদে পড়ে গেছি। পরিসংখ্যান দিয়ে এত দিন উন্নয়ন দেখানো হয়েছে। বাস্তবে তা হয়নি। হিসাব গরমিলের কারণে মধ্যম আয়ের দেশের ফাঁদে পড়ে গেছি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের পদ্ধতিগত সংস্কার দরকার। হিসাব-নিকাশ, তথ্য-উপাত্তে উপরের পর্যায়ে যে হস্তক্ষেপের সংস্কৃতি সেটির সব ক’টি দরজা বন্ধ করে দিতে হবে।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ম তামীম বলেন, সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিদ্যুতের চাহিদার অতি উচ্চ লক্ষ্য নির্ধারণ করে ব্যাপকভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রের অনুমতি দেয়া হয়। একদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অতিরিক্ত সক্ষমতা (ওভার ক্যাপাসিটি) তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে ক্যাপাসিটি পেমেন্টও বেড়েছে। সব মিলিয়ে অতিরিক্ত ৩ বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি ডলার ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিয়েছে সরকার। তিনি বলেন, কাগজে-কলমে প্রমাণ রেখে কেউ চুরি করেনি। সে কারণে চুরির সঠিক পরিমাণ হিসাব করা কঠিন কাজ। তবে আমরা তথ্য-উপাত্ত থেকে যেটা দেখি, যা শ্বেতপত্র প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছে। এ পর্যন্ত ৩০ থেকে ৩৩ বিলিয়ন বা ৩ হাজার থেকে ৩ হাজার ৩০০ কোটি ডলার বিদ্যুৎ উৎপাদনে (জেনারেশনে) বিনিয়োগ হয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১০ শতাংশ দুর্নীতি হয়েছে বলে ধরে নেয়া যায়। সে হিসাবে এসব প্রকল্প দেয়ার ক্ষেত্রে অন্তত ৩ বিলিয়ন বা ৩০০ কোটি ডলার হাতবদল হয়েছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা ছাড়া প্রকল্প দেয়া হয়েছে উল্লেখ করে ম তামিম বলেন, প্রতিযোগিতার মাধ্যমে দেয়া হলেও যিনি প্রকল্প পেয়েছেন, তার কাছ থেকে টাকা নেয়া হয়েছে। প্রকল্পগুলো দ্রুত বিদ্যুৎ সরবরাহ আইনের মাধ্যমে দেয়া হয়েছে এবং সেগুলো রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক লেনদেনের মাধ্যমেই দেয়া হয়েছে। হাতেনাতে প্রমাণ নেই; কিন্তু অনেক জায়গা থেকে সম্পর্কিত নথিপত্রের প্রমাণ পাওয়া গেছে।
আলোচনায় ড. এ কে এনামুল হক বলেন, উন্নয়ন কর্মসূচি বা সরকারি ব্যয়ের ৪০ শতাংশই তসরুপ হয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শারমিন্দ নিলোর্মী বলেন, বুদ্ধিভিত্তিক দুর্নীতির একটা সংস্কৃতি প্রকাশ করা হয়েছে। টাকার বিচারের চেয়ে এটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
ড. তাসমীম সিদ্দিকী বলেন, জনশক্তি রফতানিতে ভিসা কেনার প্রক্রিয়ায় রিক্রুটিং এজেন্সির মাধ্যমে এক দশকে হুন্ডিতে ১৩ লাখ ৪০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এ পরিমাণ অর্থ দিয়ে ঢাকায় উত্তরা-মতিঝিল রুটের মতো চারটি মেট্রোরেল নির্মাণের ব্যয় মেটানো যায়।
সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, দেশে পরপর তিনটি নির্বাচন চরম ত্রুটিপূর্ণ হয়েছে। এর মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতির খাতগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। এই পরিস্থিতির উত্তরণে সংস্কার জরুরি। সংস্কার করা না হলে পুরনো দুর্নীতিবাজরা আবার প্রতিষ্ঠা পাবে। তিনি বলেন, আমরা চাই না, পুরনো দুর্নীতিবাজরা কোনোভাবে পুনর্বাসিত হোক, সে জন্য আগে সংস্কার জরুরি। অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার ও ব্যক্তি বিনিয়োগ বাড়াতে হলে সংস্কার দরকার।
আলোচনায় ইমরান মতিন বলেন, শীর্ষ ১০ শতাংশ আয়ের মানুষ দেশের ৮৫ শতাংশ সম্পদের কর্তৃত্ব করছে।
ব্যাংকের দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদ দিয়ে ১৪ মেট্রোরেল, ২৪টি পদ্মা সেতু সম্ভব : ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী দেশের ব্যাংক খাতের দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের পরিমাণ ছয় লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থ ১৪টি মেট্রোরেল, ২৪টি পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয়ের সমান। দেশের অর্থনীতি নিয়ে প্রকাশিত শ্বেতপত্রে এ তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা এই শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি বলছে, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ঋণ প্রদান প্রক্রিয়া ব্যাংকিং খাতকে আরো গভীর সঙ্কটে ফেলেছে। চলতি বছরের জুন মাস পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী ব্যাংকগুলোর দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদ দিয়ে ১৪টি মেট্রোরেল কাঠামো ও ২৪টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেত। কমিটি আরো জানায়, ব্যাংকিং খাতই সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত খাত। এরপরে রয়েছে ভৌত অবকাঠামো এবং জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত। একের পর এক ঋণখেলাপি এবং শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের কেলেঙ্কারির কারণে দেশের আর্থিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়েছে। উল্লেখ্য, খেলাপি ঋণ, ঋণ অবলোপন, ঋণ পুনঃতফসিল, ঋণ পুনর্গঠন এবং স্টে অর্ডার বা মামলায় আটকে থাকা ঋণকে একসাথে স্ট্রেসড অ্যাসেটস বা দুর্দশাগ্রস্ত ঋণ বলা হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভঙ্গুর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এসব অপরাধ করার বহু সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আর এ কারণেই ব্যাংকিং ব্যবস্থা দাঁড়াতে পারছিল না। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) খেলাপি ঋণ হিসাব করলে দুর্দশাগ্রস্ত সম্পদের পরিমাণ আরো বেশি। এসব কর্মকাণ্ডের জন্য দায়ীদের কথা উল্লেখ করে এতে আরো বলা হয়, ‘বিশেষ কিছু কারণ’ বা নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তি এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী। এর সাথে ব্যাংক খাতের কিছু শীর্ষ কর্মকর্তাও জড়িত।
বাংলাদেশে নির্মাণব্যয় ভারতের চেয়ে ৪ গুণ বেশি : শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে একটি চার লেনের শহুরে মহাসড়ক নির্মাণের খরচ ভারতের চেয়ে ৪ দশমিক ৪ গুণ এবং পাকিস্তানের চেয়ে ২ দশমিক ১৫ গুণ বেশি। ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা চার লেন মহাসড়ক প্রকল্পের কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ১১৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে নির্মাণ ব্যয় এই অঞ্চলের অন্য দেশগুলোর তুলনায় উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বেশি, অথচ অবকাঠামোর গুণগত মান তুলনামূলকভাবে নিম্ন। বাংলাদেশে একটি চার লেনের শহুরে মহাসড়ক নির্মাণের ব্যয় ভারতের চেয়ে ৪ দশমিক ৪ গুণ এবং পাকিস্তানের চেয়ে ২ দশমিক ১৫ গুণ বেশি। এতে বলা হয়, সুনির্দিষ্ট কিছু প্রকল্পের মাধ্যমে এই পার্থক্য স্পষ্ট বোঝা যায় : রংপুর-হাটিকুমরুল চার লেনের সড়ক নির্মাণ খরচ ছিল প্রতি কিলোমিটার ৬ দশমিক ৪৭ মিলিয়ন ডলার; ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে নির্মাণ খরচ ছিল প্রতি কিলোমিটার ৭ দশমিক ০৬ মিলিয়ন ডলার এবং ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা চার লেনের হাইওয়ে প্রকল্পের খরচ ছিল প্রতি কিলোমিটার ১১৩ দশমিক সাত কোটি টাকা।
১০টি ব্যাংক টেকনিক্যালি দেউলিয়া ও অচল : শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে দেশের ১০টি ব্যাংকের সবগুলোই টেকনিক্যালি দেউলিয়া ও অচল হয়ে পড়েছে। এতে বলা হয়েছে, ‘আমরা ১০টি দুর্বল ব্যাংককে তাদের সলভেন্সি ও তারল্য পর্যালোচনা করার জন্য বেছে নিয়েছি। ১০টি ব্যাংকের মধ্যে দু’টি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক, যেগুলো গত দশকে কেলেঙ্কারির শিকার হয়েছে। বাকি আটটি অত্যন্ত দুর্বল শরিয়াহভিত্তিক ব্যাংক ও প্রচলিত বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক।’
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গোপনীয়তা রক্ষা করার জন্য ব্যাংকগুলোর নাম প্রকাশ করা হয়নি। তবে, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, গণমাধ্যম ও জনসাধারণের কাছে এই ১০টি ব্যাংকই ‘দুর্বল’ হিসেবে আগেই চিহ্নিত হয়েছে। এই ১০টি ব্যাংকের সমন্বিত ঋণ ও আমানত মোট ঋণের ৩৩ শতাংশ এবং ব্যাংক খাতের মোট আমানতের ৩২ শতাংশ। এতে বলা হয়, সম্পদের সম্মিলিত সমন্বয়কৃত মূল্য ছিল প্রদর্শিত মূল্যের ৫২ শতাংশ। ফলে, নিট মূল্য ঋণাত্মক।
তরল সম্পদের সাথে মোট বাস্তব সম্পদের অনুপাতের মাধ্যমে পরিমাপ করা তারল্য অনুযায়ী জানা যায়, ১০টির মধ্যে ৮টি ব্যাংকই তারল্য বা নগদ সঙ্কটে রয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, সবগুলো ব্যাংককেই ‘অতি দুর্বল’ হিসেবে রেটিং দেয়া হয়েছে।
শেয়ার বাজার থেকে ১ লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ : ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে শেয়ারবাজার থেকে এক ট্রিলিয়ন বা এক লাখ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে। শ্বেতপত্রে বলা হয়েছে, প্রতারণা, কারসাজিসহ প্লেসমেন্ট শেয়ার এবং আইপিও বা প্রাথমিক গণপ্রস্তাবে জালিয়াতির মাধ্যমে শেয়ারবাজার থেকে এই টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, শেয়ারবাজারে প্রভাবশালী উদ্যোক্তা গোষ্ঠী, ইস্যু ম্যানেজার, নিরীক্ষক ও বিনিয়োগকারীদের মধ্যে কারসাজির একটি বড় নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। বাজারের মধ্যস্থতাকারী দেউলিয়া হয়েছে, তাদের ইক্যুইটি ৩০ হাজার কোটি টাকা নেতিবাচক হয়েছে। যারা ব্যাংক খাতের অপরাধী, তারা শেয়ারবাজারে আস্থা নষ্ট করার পেছনেও ছিল বলে শ্বেতপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে।
রাজস্ব ফাঁকি ও আর্থিক ক্ষতি : কর ফাঁকি, কর ছাড়ের অপব্যবহার এবং দুর্বলভাবে পরিচালিত সরকারি অর্থ ব্যবস্থাপনা রাষ্ট্রকে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ থেকে বঞ্চিত করেছে, ফলে উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বড় আকারের সরকারি প্রকল্পে দুর্নীতির কারণে গড় ব্যয় ৭০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সময়সীমা পাঁচ বছরের বেশি পেরিয়ে গেছে। গত ১৫ বছরে এডিপি এবং উন্নয়ন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা ৬০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মধ্যে ১৪ থেকে ২৪ বিলিয়ন বা এক লাখ ৬১ হাজার থেকে দুই লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা দুর্নীতির কারণে নষ্ট হয়েছে। রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঘুষ এবং ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তৈরি বাজেটের কারণে সম্পদ হারিয়েছে। ভূমি অধিগ্রহণের সময় তহবিলের অপব্যবহার এবং পক্ষপাতদুষ্ট প্রকল্প পরিচালকদের নিয়োগ আরো বেশিসম্পদ সঙ্কট সৃষ্টি করেছে। যার ফলে অবকাঠামো ও সামাজিক বিনিয়োগ থেকে সম্ভাব্য সুফল হ্রাস পেয়েছে।
খাদ্যপণ্যের সরবরাহ চেইন ধ্বংস : গৃহস্থালির উৎপাদন পরিসংখ্যান বিকৃত করা এবং চাহিদা কম দেখানো হয়েছে। বিশেষ করে চাল, ভোজ্যতেল এবং গমের মতো প্রধান পণ্যের ক্ষেত্রে এমন চিত্র দেখা গেছে। যা বাজারকে অস্থিতিশীল করেছে। এলোমেলো ও রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ক্রয় নীতিমালা শক্তিশালী ব্যবসায়িক গোষ্ঠীগুলোকে সুবিধা দিয়েছে এবং সাধারণ ভোক্তাদের দুর্ভোগ বাড়িয়েছে। নিয়মিত মজুদ পর্যবেক্ষণের অভাবে এই সমস্যাগুলোকে আরো জটিল করেছে।
শ্রম অভিবাসন : গত এক দশকে ১৩ লাখ চার হাজার কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো ভিসা ক্রয়ের জন্য ব্যয় করেছে। যা ঢাকা এমআরটি-৬ (উত্তরা-মতিঝিল) নির্মাণের খরচের চার গুণ। সিন্ডিকেট এবং শোষণমূলক রিক্রুটমেন্ট কার্যক্রম অভিবাসী শ্রমিকদের ন্যায্য চাকরির সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেছে। যার রেমিট্যান্স প্রবাহে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
সামাজিক সুরক্ষা নেট : সামাজিক সুরক্ষা প্রোগ্রামের মধ্যে তহবিলের অযথা ব্যয় লাখ লাখ মানুষকে বিপন্ন অবস্থায় ফেলে দিয়েছে। ২০২২ সালে ৭৩ শতাংশ সামাজিক সুরক্ষা সুবিধাভোগী গরিব হিসেবে শ্রেণিবদ্ধ হয়নি।
পরিবেশ ব্যবস্থাপনা : জলবায়ু অভিযোজন তহবিলের মধ্যে দুর্নীতি পরিবেশগত অবক্ষয়কে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত জলবায়ু সম্পদের অপব্যবস্থাপনা স্থায়িত্বমূলক উদ্যোগগুলোকে ব্যাহত করেছে এবং জলবায়ু-উদ্ভূত ঝুঁকির বিরুদ্ধে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা