তারেকসহ সকল অভিযুক্ত খালাস
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার বিচার অবৈধ ঘোষণা হাইকোর্টের- হাবিবুর রহমান
- ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২:০০
রাজধানীর বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় বিচারিক আদালতের রায়ে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন ও বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত সব আসামিকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। গতকাল বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে আদালত ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্রের ভিত্তিতে বিচারিক আদালতের বিচার অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করেছেন। বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধে ডেথ রেফারেন্স নাকচ করে এবং আসামিদের আপিল মঞ্জুর করে এ রায় ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর দ্রুত বিচার ট্রাইবুনাল ১-এর বিচারক শাহেদ নুরুদ্দিন এ মামলায় রায়ে মোট ৪৯ জনকে সাজা দিয়েছিলেন। রায়ে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এ ছাড়া বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন ও ১১ জনের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডের আদেশ দেন বিচারিক আদালত। হাইকোর্ট সবার আপিল মঞ্জুর করে রুল যথাযথ ঘোষণা করেছেন এবং সবাইকে এ মামলা থেকে খালাস দিয়েছেন। এর আগে ২১ নভেম্বর শুনানি শেষে রায় ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রেখেছিলেন হাইকোর্ট।
রায়ের পর্যবেক্ষণে যা বলেছেন আদালত : আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, মুফতি হান্নানের দ্বিতীয় স্বীকারোক্তির ওপর ভিত্তি করে যে তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করা হয়েছে তা সম্পূর্ণভাবে বেআইনি। বিচার চলা অবস্থায় আগের সমস্ত ঘটনার গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনে নতুন ঘটনার জন্ম দিয়ে দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী আইনসম্মত নয়।
আদালত বলেছেন, দ্বিতীয় যে তদন্ত রিপোর্ট সেটা জমা হয়েছে বিচারিক আদালতে। এটা জমা হওয়ার কথা ছিল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে। আইনে আছে আগে ম্যাজিস্ট্রেকে আমলে নিতে হবে। তারপর বিচারিক আদালতে পাঠাতে হবে। এই কারণে আমলে গ্রহণের আদেশ থেকে শুরু করে পরে যা হয়েছে তার সবই আইন বহির্ভূত।
আদালত আরো বলেছেন, আসামিদের যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দেয়া হয়েছে তা স্বেচ্ছায়ও না এবং সত্যও নয়। কারণ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী একটার সাথে আরেকটাকে সমর্থন করে না বা মিল নেই। এ ছাড়া আদালত বলেছেন, এই ঘটনার কোনো প্রত্যক্ষ সাক্ষী নেই। সে নাকি কাউকে গ্রেনেড নিক্ষেপ করতে দেখেছে। এখানে সাজা দেয়া হয়েছে ষড়যন্ত্র করার জন্য। সাক্ষ্য আইনের ১০ ধারা প্রয়োগ করে সাজা দেয়া হয়েছে ষড়যন্ত্র করার কারণে। এখানে উচ্চ আদালত দেছিয়েছেন ১০ ধারা প্রয়োগ করতে হলে ওই ষড়যন্ত্রে যারা অংশ নিয়েছে তাদের কারো সাক্ষ্য প্রয়োজন হবে। আদালত বলেছেন, এই ধরনের কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ এখানে নেই। এখানে আদালত মোবাইল কাদের ও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রেফারেন্স দিয়েছেন। ওই মামলাতেও সাক্ষ্য আইনের ১০ ধারা ব্যাখ্যা করে আদালত বলেন, ওই মামলাগুলোতেও আপিল বিভাগ কর্তৃক ঘোষিত রায়ে সহ ষড়যন্ত্রকারীদেরও সাজা দেয়া হয়নি।
আদালত আরো বলেছেন, যারা স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে তাদের সবাই কোনো না কোনো সময় টিএফআই (টাস্ক ফোর্স ইন্টেলিজেন্স) সেলে ছিল। কেউ ৬০ দিন, কেউ ২৬১ দিন ছিল। অথচ টিএফআই সেল গঠনের আইনগত ভিত্তি নেই। টিএফআই সেলে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে এই মর্মে কোনো আইন নেই। আদালত বলেছেন, শুধু স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর ওপর ভিত্তি করে অন্য আসামিদের সাজা দেয়া যায় না। একই সাথে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর ওপর ভিত্তি করে ষড়যন্ত্র প্রমাণ করা যায় না।
আদালত আরো বলেছেন, আসামিকে সাজা দিতে হলে দালিলিক সাক্ষ্য, মৌখিক সাক্ষ্য প্রয়োজন হবে এবং পারিপার্শিক সাক্ষ্য লাগবে। এই মামলায় এই তিন প্রকারের সাক্ষ্যের কোনো মানদণ্ড রক্ষা করা হয়নি। না মৌখিক সাক্ষ্য আছে, না ডকুমেন্টারি এভিডেন্স (দালিলিক সাক্ষ্য) বা পারিপার্শিক সাক্ষ্য আছে।
আইনে আছে ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তি করতে গিয়ে যদি দেখা যায় কোনো ব্যক্তি আপিল করেনি কিন্তু মামলায় আছে তারাও বেনিফিট পেতে পারেন, যদিও তারা আপিল না করেন। এ জন্য এই মামলায় তারেক রহমানসহ যারা আপিল করেননি তাদের সবাই খালাস পেয়েছেন বলে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা জানান। আদালতে আসামি পক্ষে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী এস এম শাহজাহান ও আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির।
বিচারিক আদালতের বিচারটা অবৈধ : আসামিপক্ষের আইনজীবী এস এম শাহজাহান বলেন, মুফতি হান্নানের প্রথম স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর ওপর ভিত্তি করে প্রথম চার্জশিট দেয়া হয়েছিল। সেখানেও জবানবন্দীর বাইরে আর কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি। দ্বিতীয় চার্জশিটে তারেক রহমান, লুৎফুজ্জামান বাবর, কাজী কায়কোবাদসহ অন্য যাদের আনা হয়েছিল তাদের বিষয়েও স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী ছাড়া আর কোনো সাক্ষ্য নাই। এই দুই জবানবন্দীই মুফতি হান্নান জীবদ্দশায় প্রত্যাহার করে গেছেন। ফলে প্রত্যাহার করা জবানবন্দী ও পরে যদি আর কোনো সাক্ষ্য না থাকে তাহলে সাজা দেয়া যায় না। যে আসামি জবানবন্দী দিয়েছেন, তিনি বেঁচে থাকলে তাকেও সাজা দেয়া যেত না।
রায় ঘোষণার পর সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ তিন আসামির আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেছেন, বিচারিক আদালতের বিচারটা অবৈধ বলা হয়েছে হাইকোর্টের রায়ে। বিচারিক আদালতে আইনের ভিত্তিতে বিচারটা হয়নি। কোনো সাক্ষীর সাথে কোনো সাক্ষীর বক্তব্যে মিল নেই। শোনা সাক্ষীর ওপর ভিত্তি করে রায় দেয়া হয়েছে। আপিল মঞ্জুর করে ডেথ রেফারেন্স খারিজ করে সবাইকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট।
শিশির মনির বলেন, তারেক রহমান, বাবরসহ সবাইকে এই মামলা থেকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। এ ধরনের মামলায় পরস্পর কেউ স্বচক্ষে দেখেছেন, এ মর্মে কোনো এভিডেন্স (প্রমাণ) নেই। যাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী নেয়া হয়েছে তা নির্যাতনের মাধ্যমে নেয়া হয়েছে। মুফতি হান্নান দু’টি জবানবন্দী দিয়েছেন। দ্বিতীয় স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে সাজা দেয়ার নজির নেই। এই স্বীকারোক্তি প্রত্যাহার করেন তিনি। এ জন্য এর আইনি মূল্য নেই। দ্বিতীয় অভিযোগপত্র দায়রা আদালতে দাখিল করা হয়। দায়রা আদালত এটি আমলে নিয়েছেন। আইন অনুযায়ী তিনি (দায়রা আদালত) এটা করতে পারেন না। এ জন্য এই অভিযোগ আমলে নেয়ার ভিত্তিতে যে সাজা দেয়া হয়েছে, তাকে অবৈধ বলেছেন হাইকোর্ট।
তিনি বলেন, এ মামলার ২২৫ জন সাক্ষীর কেউ বলেননি কে গ্রেনেড মেরেছে বা তারা কেউ মেরেছেন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এ মামলার বিচার করা হয়েছে। এ ঘটনার সাথে কে সংশ্লিষ্ট তা দেখাতে হবে। তিনি বলেন, একই ব্যক্তি একই মামলায় দ্বিতীয় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী এই ভারতীয় উপমাহাদেশে ৪০০ বছরের ইতিহাসে কোনো আদালত গ্রহণ করেনি। এই জন্য এই বিচারটা সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।
রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো: জসিম সরকার। রায়ের সময় হাইকোর্টে উপস্থিত ছিলেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, বিএনপির চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার এ এম মাহবুব উদ্দিন খোকন। বিএনপির আইন সম্পাদক ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের মহাসচিব ব্যারিস্টার কায়সার কামাল, আসামি পক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ আলী, মো: মাকসুদ উল্লাহ প্রমুখ। এ ছাড়া রায় ঘোষণার সময় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের স্ত্রী, আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই সুলতান সালাউদ্দিন টুকুও উপস্থিত ছিলেন।
যে প্রক্রিয়ায় আসামিরা মুক্তি পাবেন : এ মামলায় খালাস পাওয়া আসামিদের মুক্তি পাওয়ার বিষয়ে আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, প্রথমত. আদালত যদি আগাম আদেশ দেন যে, যাদের বিরুদ্ধে অন্য মামলা নেই তারা মুক্তি পেতে পারেন। এটা বেইল অর্ডারের মতো। চাইলে আজো দিতে পারেন। এ ছাড়া আদালতের পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর আসামিরা মুক্তি পাবেন।
রায় দেখে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত : অ্যাটর্নি জেনারেল
রাষ্ট্রপক্ষ হাইকোর্টের রায় দেখে ও নির্দেশনা নিয়ে তারপর আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বলেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মো: আসাদুজ্জামান। তিনি বলেন, রায়ের কারণ দেখে ও নির্দেশনা নিয়ে তারপর সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। আমি আপিল করা উচিত বলে মনে করি।
তারেক রহমানকে রাজনীতিতে নিষিদ্ধ করাই ছিল রায়ের উদ্দেশ্য : পরে জয়নুল আবেদীন বলেন, চার্জশিটে তারেক রহমানের নাম কোথাও ছিল না। পরে আব্দুল কাহহার আকন্দকে (সর্বশেষ তদন্ত কর্মকর্তা) দিয়ে তারেক রহমানকে এ মামলায় সম্পৃক্ত করে সাজা দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়। তিনি বলেন, সরাসরি সাক্ষ্য না থাকলে কাউকে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন সাজা দেয়া যায় না। সমস্ত দিক বিচার-বিশ্লেষণ করে আদালত মনে করেছেন এ মামলায় যারা আপিল করেছেন এবং যারা আপিল করতে পারেননি, প্রত্যেককে খালাস দেয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তারা চেয়েছিল তারেক রহমানকে এ মামলা দিয়ে চিরজীবন রাজনীতির বাইরে রাখবে। এমনকি তাকে মৃত্যুদণ্ডও দিতে চেয়েছিল। কিন্তু আদালত কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণই পাননি।
ব্যারিস্টার কায়সার কামাল বলেন, রাজনৈতিকভাবে এ মামলাটা পরিচালিত হয়েছে তারেক রহমান ও বিএনপির বিরুদ্ধে। যখন শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ১৬১ ধারায় (জবানবন্দী) দেন, সেখানেও তারেক রহমানের নাম ছিল না। পরে ক্ষমতায় এসে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধন করার জন্য তারেক রহমান সাহেবকে এ মামলায় সম্পৃক্ত করা হয়েছে। এ এ মামলার কোনো এভিডেন্স নেই, ১৬৪ ধারায় মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীর কোনো সাক্ষ্যমূল্য নেই। কোনো সাক্ষী তারেক রহমানের নাম বলেননি। সব বিবেচনা করে তারেক রহমানসহ সবাইকে খালাস দিয়েছেন আদালত। তিনি বলেন, তারেক রহমানের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য এ মামলায় সম্পৃক্ত করা হয়। তারেক রহমান এ মামলায় ন্যায়বিচার পেয়েছেন।
যা বললেন লুৎফুজ্জামান বাবরের স্ত্রী : রায় ঘোণার পর সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের স্ত্রী তাহমিনা জামান শ্রাবণী বলেছেন, ন্যায়বিচারের জন্য অপেক্ষা করেছি, আল্লাহ আমাকে ন্যায়বিচার দিয়েছেন। এটাই শুকরিয়া। আলহামদুলিল্লাহ।
এখনই মুক্তি পচ্ছেন না লুৎফুজ্জামান বাবর : ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর খালাস পেলেও তিনি এখনই কারামুক্তি পাচ্ছেন না। আইনজীবীরা জানিয়েছেন, তার বিরুদ্ধে এখনো ১১টি মামলা রয়েছে। এই মামলাগুলোর মধ্যে ছয়টিতে তিনি সাজাপ্রাপ্ত ও পাঁচটি বিচারাধীন।
এর আগে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর হাইকোর্টের অপর একটি দ্বৈত বেঞ্চে শুনানি হয়। গত ১৮ আগস্ট দ্বৈত বেঞ্চটি অবকাশ শেষে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত শুনানি মুলতবি করেন। গত ৮ সেপ্টেম্বর অবকাশ শুরু হয়। অবকাশ শেষে ২০ অক্টোবর আদালতের নিয়মিত কার্যক্রম শুরু হয়। অবকাশ শেষে খোলার পর ২৪ অক্টোবর দ্বৈত বেঞ্চ বসে। সেদিন বেঞ্চটি ডেথ রেফারেন্স ও আপিল কার্যতালিকা থেকে বাদ দেন। এরপর বিষয়টি উপস্থাপন করা হলে প্রধান বিচারপতি ডেথ রেফারেন্স শুনানি-নিষ্পত্তির জন্য বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন দ্বৈত বেঞ্চে পাঠান। এই বেঞ্চে ২৭ অক্টোবর মামলাটি পাঠানো হয়। পরদিন এই বেঞ্চের কার্যতালিকায় ডেথ রেফারেন্স ওঠে। এর ধারাবাহিকতায় পেপারবুক উপস্থাপনের মধ্য দিয়ে ৩১ অক্টোবর শুনানি শুরু হয়।
ঘটনার বিবরণ : ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলাটি চালানো হয়। অল্পের জন্য ওই হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। তবে হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক, সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন দলের তিন শতাধিক নেতাকর্মী। ঘটনার পরদিন মতিঝিল থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দু’টি মামলা হয়। তদন্ত শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১১ জুন দেয়া অভিযোগপত্রে বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন ও হুজি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়।
২০০৮ সালে ২২ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেয় সিআইডি। এতে বলা হয়, শেখ হাসিনাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বশূন্য করতে ওই হামলা চালিয়েছিল উগ্রবাদীরা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পর অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত। দুই বছর তদন্তের পর ২০১১ সালের ৩ জুলাই তারেক রহমানসহ ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এর ফলে এ মামলায় মোট আসামির সংখ্যা হয় ৫২। তাদের মধ্যে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও মুফতি হান্নান এবং তার সহযোগী শাহেদুল ইসলাম বিপুলের মৃত্যুদণ্ড অন্য মামলায় কার্যকর হয়। ফলে এ মামলার আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯ জনে।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ এই মামলার (হত্যা ও বিস্ফোরক মামলা) রায় দেন। বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন লুৎফুজ্জামান বাবর, আব্দুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন, হুজির সাবেক আমির ও ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক পার্টির আহ্বায়ক মাওলানা শেখ আবদুস সালাম (কারাগারে মারা যান), কাশ্মীরি উগ্রবাদী আব্দুল মাজেদ ভাট, আবদুল মালেক ওরফে গোলাম মোস্তফা, মাওলানা শওকত ওসমান, মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান, মাওলানা আবু সাঈদ ওরফে ডা: জাফর, আবুল কালাম আজাদ ওরফে বুলবুল, মো: জাহাঙ্গীর আলম, হাফেজ মাওলানা আবু তাহের, হোসাইন আহমেদ তামিম, মঈন উদ্দিন শেখ ওরফে মুফতি মঈন, মো: রফিকুল ইসলাম, মো: উজ্জ্বল, এনএসআইর সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল (অব:) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) আবদুর রহিম (কারাগারে মারা যান), হানিফ পরিবহনের মালিক বিএনপি নেতা মোহাম্মদ হানিফ।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন- বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক উপদেষ্টা হারিছ চৌধুরী, বিএনপি নেতা কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, হুজি সদস্য হাফেজ মাওলানা ইয়াহিয়া, শাহাদাৎ উল্লাহ ওরফে জুয়েল, মাওলানা আবদুর রউফ (কারাগারে মারা যান), মাওলানা সাব্বির আহমেদ, আরিফ হাসান ওরফে সুমন, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম মাওলাদার, মো: আরিফুল ইসলাম, মহিবুল মুত্তাকিন ওরফে মুত্তাকিন, আনিসুল মুরছালিন ওরফে মুরছালিন, মো: খলিল ওরফে খলিলুর রহমান, জাহাঙ্গীর আলম বদর, মো: ইকবাল ওরফে ইকবাল হোসেন, লিটন ওরফে মাওলানা লিটন, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আব্দুল হাই, রাতুল আহমেদ ওরফে রাতুল বাবু।
এ ছাড়া পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজি) মো: আশরাফুল হুদা ও শহুদুল হক, বিএনপি চেয়ারপারসন ও তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভাগনে লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (অব:) সাইফুল ইসলাম ডিউক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব:) সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, ডিজিএফআইর মেজর জেনারেল (অব:) এ টি এম আমিন, ডিএমপির সাবেক উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) খান সাঈদ হাসান, আরেক সাবেক উপ-কমিশনার (পূর্ব) ওবায়দুর রহমান খান, সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক খোদা বক্স চৌধুরী, সিআইডির সাবেক বিশেষ সুপার মো: রুহুল আমিন, সাবেক এএসপি আবদুর রশিদ, সাবেক এএসপি মুন্সি আতিকুর রহমানকে দুই বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো ছয় মাস করে সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।
আরেকটি ধারায় খোদা বক্স চৌধুরী, রুহুল আমিন, আবদুর রশিদ ও মুন্সি আতিকুর রহমানকে তিন বছর করে কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরো ছয় মাস করে কারাদণ্ড দেন আদালত। হাইকোর্টের রায়ে নি¤œ আদালতের সাজা দেয়া সব আসামিকে খালাস দিয়েছেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা