০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র কমিটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন হস্তান্তর

হাসিনার আমলে বছরে ১৬ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে

গরিবের রক্ত পানি করা টাকা লুট হয়েছে : প্রধান উপদেষ্টা
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে অর্থনীতির ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের নেতৃত্বে কমিটির প্রতিবেদন পেশ করা হয় : পিআইডি -


দুর্নীতিগ্রস্ত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনার শাসনামলের গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অবৈধভাবে পাচার হয়েছে। শ্বেতপত্র প্রণয়নে গঠিত কমিটি তিন মাসের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে এই তথ্য উঠে এসেছে। গতকাল রোববার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে তার তেজগাঁও কার্যালয়ে এই রিপোর্ট হস্তান্তর করেছে কমিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। কমিটি জানায়, শেখ হাসিনার শাসনামলের দুর্নীতি, লুণ্ঠন এবং ভয়ঙ্কর রকমের আর্থিক কারচুপির যে চিত্র রিপোর্টে পাওয়া গেছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এই যুগান্তকারী কাজের জন্য কমিটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, ‘চূড়ান্ত হওয়ার পর এটি জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করা উচিত এবং স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষার্থীদের পড়ানো উচিত।’
এ শ্বেতপাত্রকে একটি ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর অর্থনীতিকে যে ভঙ্গুর দশায় আমরা পেয়েছি তা এই রিপোর্টে উঠে এসেছে। জাতি এই নথি থেকে উপকৃত হবে।
প্রধান উপদেষ্টা আরো বলেন, ‘আমাদের গরিব মানুষের রক্ত পানি করা টাকা যেভাবে তারা লুণ্ঠন করেছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। দুঃখের বিষয় হলো, তারা প্রকাশ্যে এই লুটপাট চালিয়েছে। আমাদের বেশির ভাগ অংশই এর মোকাবেলা করার সাহস করতে পারেনি। পতিত স্বৈরাচারী শাসনামলে ভয়ের রাজত্ব এতটাই ছিল যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি পর্যবেক্ষণকারী বহুপক্ষীয় সংস্থাগুলোও এই লুণ্ঠনের ঘটনায় অনেকাংশে নীরব ছিল।’

সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই কমিটি স্বাধীনভাবে কাজ করেছে বলে জানান কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘সমস্যাটি আমরা যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়েও গভীর। এই ৩০ অধ্যায়ের ৪০০ পৃষ্ঠার দীর্ঘ শ্বেতপত্রে উঠে এসেছে কিভাবে চামচা পুঁজিবাদ অলিগার্কদের জন্ম দিয়েছে, কিভাবে তারা নীতি প্রণয়ন নিয়ন্ত্রণ করেছে।’
কমিটির সদস্য মুস্তাফিজুর রহমান জানান, তারা ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে সাতটি বড় প্রকল্প পরীক্ষা করে দেখেছেন প্রতিটিতে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। ২৯টি বড় প্রকল্পে মোট ব্যয় হয়েছে ৮৭ বিলিয়ন ডলার বা সাত লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা।
পরীক্ষা করা সাতটি প্রকল্পের আনুমানিক প্রাথমিক ব্যয় ছিল এক লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। অতিরিক্ত উপাদান যোগ করে, জমির দাম বেশি দেখিয়ে এবং ক্রয়ের ক্ষেত্রে হেরফের করে প্রকল্পের ব্যয় সংশোধিত করে এক লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা করা হয়। তিনি বলেন, ব্যয়ের সুবিধা বিশ্লেষণ না করেই প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৭০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।

অর্থ পাচারে জড়িত ব্যক্তিদের আইনের আওতায় আনতে বিচারকাজ শুরুর পরামর্শও দেন তিনি।
কমিটির আরেক সদস্য অধ্যাপক এ কে এনামুল হক বলেন, গত ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) সাত লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে এবং এর ৪০ শতাংশ অর্থ আমলারা লুটপাট করেছে। কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আবু ইউসুফ জানান, বিগত শাসনামলে কর অব্যাহতির পরিমাণ ছিল দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ। এটি অর্ধেকে নামিয়ে আনা গেলে শিক্ষা বাজেট দ্বিগুণ এবং স্বাস্থ্য বাজেট তিন গুণ করা যেতে পারত। কমিটির আরেক সদস্য এম তামিম বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে এবং ১০ শতাংশ যদি অবৈধ লেনদেন ধরা হয়, তাহলে পরিমাণ হবে কমপক্ষে ৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ সময় আরো উপস্থিত ছিলেন অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর, মুখ্য সচিব সিরাজ উদ্দিন সাথী, সিনিয়র সচিব লামিয়া মোর্শেদ।
প্রতিবেদনটি আজ সোমবার জনসাধারণের জন্য প্রকাশিত হবে বলে জানা গেছে। বিগত আওয়ামী লীগ সময়ে কিভাবে কোন চ্যানেলে দুর্নীতি হয়েছে তার একটি বিষদ বিবরণ উল্লেখ করা হয়েছে শ্বেতপত্র রিপোর্টে। ব্যাংকিং ঋণ কেলেঙ্কারি। অলীক ব্যাংক ঋণে প্রতারণামূলক অনুশীলন, অপব্যবহার ঋণ, ইত্যাদি। ব্যাংক টেকওভার। রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায় ব্যাংকের মালিকানা জোরপূর্বক দখল করা।

অবৈধ আর্থিক বহিঃপ্রবাহ। অবৈধভাবে অর্জিত অর্থ দেশ থেকে পাচার হয় বিপুল পরিমাণে। রাজনৈতিকভাবে অনুপ্রাণিত অলাভজনক প্রকল্প। অব্যর্থ প্রকল্পে সম্পদ নষ্ট হয়, সময়সীমা এবং মুদ্রাস্ফীতি ব্যয় দীর্ঘায়িত করা। স্ফীত প্রকল্প খরচ. তহবিলের জন্য পদ্ধতিগত ব্যয় অত্যধিক মূল্যায়ন।
অনুমোদনের পর প্রকল্পের খরচ বৃদ্ধি। প্রকল্পের পর খরচ কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হয় তহবিল সরানোর অনুমোদন। অ-প্রতিযোগিতামূলক টেন্ডার প্রক্রিয়া। তোষণনীতি এবং পক্ষপাতিত্ব ক্রয়কে প্রাধান্য দেয়, যা কিনা যোগ্য দরদাতা ব্যতীত।
অপ্রয়োজনীয় বা খারাপভাবে ডিজাইন করা প্রকল্প। দুর্বল সম্ভাব্যতার কারণে সম্পদ নষ্ট হচ্ছে। অধ্যয়ন, সময়রেখা দীর্ঘায়িত করা এবং খরচ বৃদ্ধি করা। নিয়োগে স্বজনপ্রীতি। প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে প্রকল্প পরিচালক, প্রায়ই হয় যোগ্যতার চেয়ে রাজনৈতিক সংযোগের ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। অবৈধ জমি এবং সম্পদ অধিগ্রহণ। জমি ও সম্পদ বাজেয়াপ্ত বা অধিগ্রহণ করা হয় অবৈধ উপায়। জমি অধিগ্রহণ তহবিলের অপব্যবহার। রাজনৈতিকভাবে দুর্বল জমির মালিকদের জোর করে চাপ দেয়া হয়।
অন্যায্য চুক্তি এবং জমি অধিগ্রহণের জন্য বরাদ্দকৃত তহবিল অপব্যবহার করা হয়। অতিরিক্ত মূল্যের চুক্তি প্রদান। চুক্তি প্রায়ই রাজনৈতিকভাবে সংযুক্ত করা হয়। স্ফীত মূল্যে ঠিকাদার এবং প্রতিযোগিতামূলক বিডিং ছাড়া দেওয়া। প্রকল্প সম্পদের অপব্যবহার। যানবাহন, ভ্রমণ বাজেট এবং অন্যান্য প্রকল্প সম্পদের অপব্যবহার ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক লাভের জন্য। পাবলিক ফান্ডের অপব্যবহার। উন্নয়নের জন্য নির্ধারিত তহবিল পরিবেশনের জন্য সরানো হয় নেতাদের রাজনৈতিক এবং/ অথবা ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য।

অভিজাতদের জন্য কর ছাড়। ট্যাক্স নীতিগুলো প্রভাবশালী গোষ্ঠীগুলোকে অসমভাবে উপকৃত করে। বিকৃত সাপ্লাই চেইন। ম্যানিপুলেটেড সাপ্লাই চেইন অন্যায্য মূল্য এবং বাজারের দিকে নিয়ে যায় অভ্যন্তরীণ তথ্য শেয়ার করা। আর্থিক লাভের জন্য নির্বাচনী গোষ্ঠীর কাছে নীতিগত সিদ্ধান্ত ফাঁস করা হয়।
যৌথ দুর্নীতি। পারস্পরিক জন্য সরকারি কর্মকর্তা এবং ব্যক্তিগত অভিনেতাদের মধ্যে সহযোগিতা। চাঁদাবাজিভিত্তিক দুর্নীতি। জবরদস্তি ঘুষ আহরণ বা অন্যায্য চুক্তি প্রয়োগ করতে ব্যবহৃত হয়। একচেটিয়া দুর্নীতি। বাজারের পরিস্থিতি নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের অনুকূলে চালিত করা। প্রি-এমপটিভ তথ্য শেয়ারিং দুর্নীতি। গুরুত্বপূর্ণ তথ্য প্রাথমিক অ্যাক্সেস তথ্য গোপন করা দুর্নীতি। বিভ্রান্ত করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আটকে রাখা ক্যারিয়ারের উন্নতির জন্য দুর্নীতি। ঘুষ এবং সংযোগ সুরক্ষিত করতে পদোন্নতি বা প্রভাবশালী পদ।
কমিশন শেয়ারিং দুর্নীতি। উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা কমিশনের ভাগ দাবি করেন। রাজনৈতিক সুবিধার জন্য দুর্নীতি। সম্পদ এবং সিদ্ধান্তগুলোকে সুরক্ষিত করার জন্য ব্যবহার করা হয় আইনি ম্যানিপুলেশন দুর্নীতি। আইন এবং নীতিগুলো নিহিত পরিবেশনের জন্য তৈরি করা হয়েছে, শ্বেতপত্রের পর্যালোচনায় ব্যাংকিং খাতকে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি-বিধ্বস্তের শীর্ষে রাখে। তারপরে ভৌত অবকাঠামো এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি। কমিউনিকেশন টেকনোলজি (আইসিটি) সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিতে আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত কার শ্বেতপত্রে।


আরো সংবাদ



premium cement