০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৭ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

রিজার্ভে হাত না দিয়েও ৩ মাসে ৫ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ

-


ব্যয়বহুল বেসরকারি খাতের বিদেশী ঋণ কমতে শুরু করেছে। স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদি বিদেশী ঋণ ব্যাপকভাবে পরিশোধ শুরু করা হয়েছে। মাত্র তিন মাসেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে হাত না দিয়েও এমন পাঁচ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এর মধ্যে স্বল্পমেয়াদি দুই বিলিয়ন ও দীর্ঘমেয়াদি তিন বিলিয়ন ডলার রয়েছে। ফলে শুধু বেসরকারি খাতেই বিদেশী ঋণ কমেছে ১২১ কোটি ডলার, যা শতকরা হিসেবে প্রায় ১১ ভাগ।
জানা গেছে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের দেড় দশকে ব্যবসায়ীদের বিদেশী ঋণ সংগ্রহে অনেকটা অবারিত করা হয়। বায়ার্স ও সাপ্লাইয়ার্স ক্রেডিটের মাধ্যমে সংগ্রহ করা বেশির ভাগ ঋণই বিদেশে পাচার করা হয় বলে অভিযোগ রয়েছে। এসব ঋণ স্বল্প মেয়াদে আনায় একদিকে বেশি সুদ পরিশোধ করতে হয়, অপরদিকে ঋণ পরিশোধেও চাপ থাকে। এরপরও দেদার বেসরকারি খাতে ঋণ আনার অনুমোদন দেয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ২০১৩ সালের আগে বেসরকারি খাতে ঋণ অনুমোদন দেয়া হতো খুবই সীমিত আকারে। কিন্তু ২০১৩ সাল থেকে ঢালাওভাবে বেসরকারি খাতে ঋণ অনুমোদন দেয়া শুরু হয়। বেসরকারি খাতে বৈদেশিক মুদ্রায় দায় ২০১৫ সালে বেড়ে হয় ৮০০ কোটি ডলার। এরপর প্রতি বছরই বাড়তে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী এক পর্যায়ে বেসরকরি খাতে বিদেশী ঋণ বেড়ে হয় প্রায় ২৬ বিলিয়ন ডলার, যার মধ্যে ১৮ বিলিয়নই স্বল্পমেয়াদি।

অর্থনীতিবিদরা ওই সময় নানাভাবে সতর্ক করেছিলেন। বলা হয়েছিল দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়ে যাবে। কারণ হিসেবে তারা জানিয়েছিলেন, প্রথমত যাকে বা যে শিল্প গ্রুপকে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ আনার অনুমোদন দেয়া হবে, ওই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের ঋণ ফেরত দেয়ার সক্ষমতা কতটুকু রয়েছে সেটা আগে যাচাই করতে হবে। কী উদ্দেশ্যে ঋণ নেয়া হবে, সেটা বৈদেশিক মুদ্রা আয় বর্ধক খাত কি না তা আগে দেখতে হবে। যদি ঋণ ফেরত দেয়ার সক্ষমতা না থাকে, বা যে উদ্দেশ্যে ঋণের অনুমোদন দেয়া হচ্ছে সেটা থেকে যদি বৈদেশিক মুদ্রা আয় না হয় তাহলে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ ফেরত দিতে পারবে না। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বেড়ে যাবে। দ্বিতীয়ত, ডলারের সাথে বিনিময় মূল্যের ঝুঁকি বেড়ে যায়। কারণ, যখন ঋণ অনুমোদন দেয়া হচ্ছে তখন প্রতি ডলার ছিল ৭৭ টাকা। এখন প্রতি ডলার ১২০ টাকা। ফলে মুদ্রার বিনিময়জনিত ঝুঁকি বেড়ে গেছে। তৃতীয় ঝুঁকি হলো বৈদেশিক মুদ্রা পাচার হওয়ার আশঙ্কা। অনেকেই বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে প্রকৃত পণ্য না কিনে অথবা কম দামের পণ্য এনে বেশি দাম দেখিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করেন। এরকম কয়েকটি ব্যাংকের বিরুদ্ধে এমন ঘটনা উদঘাটন করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এ কারণে এক্ষেত্রে অত্যন্ত সতর্ক থাকতে হয় নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে। আবার অনেকেই বৈদেশিক মুদ্রায় যে উদ্দেশ্যে ঋণ আনেন ওই কাজে আর ব্যবহার করেন না। কেউবা স্থানীয় ঋণ পরিশোধ করেন বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ নিয়ে। এভাবে বৈদেশিক মুদ্রায় বেসরকারি খাতে ঋণঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।

ব্যাংকাররা জানিয়েছেন, কিছু বড় ব্যবসায়ী গ্রুপ সাপ্লাইয়ার্স ও বায়ার্স ক্রেডিমের মাধ্যমে যে পরিমাণ বিদেশী ঋণ সংগ্রহ করেছে তার বেশির ভাগই পাচার করেছে। ফলে দেশের ওপর ঋণের দায় সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু বৈদেশিক মুদ্রা দেশে আসেনি। এক পর্যায়ে বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ শুরু হয়। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের শেষের দুই বছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন থেকে ২০ বিলিয়নের নিচে নেমে যায়। তবে, আইএমএফের হিসাবে তা ১৫ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গিয়েছিল।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার পর অন্তর্বর্তী সরকার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। এ সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে, কমেছে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার। পাশাপাশি রফতানি আয়ও বাড়ছে। এছাড়া বৈদেশিক অনুদান কমার প্রবণতাও কমেছে। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ বাড়ছে। এ কারণে চলতি ব্যয় মেটানোর পাশাপাশি এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক আগের বকেয়া ঋণ পরিশোধের পাশাপাশি নিয়মিত ঋণের কিস্তিও সময়মতো পরিশোধ করছে। এতে ঋণের স্থিতিও কমেছে। তবে সরকারি খাতে মেয়াদি ঋণের স্থিতি কিছুটা বেড়েছে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বেড়ে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বেড়ে এক হাজার ৬৪২ কোটি ডলারে উঠেছিল। এরপর থেকে ঋণ পরিশোধ বাড়ায় ঋণের স্থিতি কমতে শুরু করে। গত সরকার জুলাইয়ে ঋণের স্থিতি রেখে গিয়েছিল এক হাজার ১৩২ কোটি ডলার। আগস্টে তা আরো কমে এক হাজার ১২০ কোটি ডলার ও সেপ্টেম্বরে এক হাজার ৭৩ কোটি ডলারে নেমে যায়। গত অক্টোবরে তা আরো কমে দাঁড়ায় এক হাজার ১১ কোটি ডলারে। গত জুলাই থেকে অক্টোবর পর্যন্ত এ খাতে ঋণের স্থিতি কমেছে ১২১ কোটি ডলার বা প্রায় ১১ শতাংশ। আলোচ্য সময়ে আগের সরকারের আমলে বকেয়া বা স্থগিত করা বৈদেশিক ঋণের স্থিতিও কমতে শুরু করেছে। কারণ এসব ঋণও কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিশোধ করছে। গত আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সরকার আগের স্থগিত করা স্বল্পমেয়াদি ঋণের মধ্যে প্রায় ২০০ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ঋণ শোধ করেছে প্রায় ৩০০ কোটি ডলার। দুই খাতে ৫০০ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়েছে। এসব ঋণ পরিশোধ করতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে হাত দিতে হয়নি। রিজার্ভে হাত দেয়া ছাড়াই কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিজস্ব উৎস থেকে এসব ঋণ পরিশোধ করেছে। এতে সামগ্রিক স্থিতিশীলতা আবারো ফিরে আসছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।


আরো সংবাদ



premium cement