সেন্টমার্টিনে বছরে দেড় লাখের বেশি পর্যটক ভ্রমণ করে
- হুমায়ুন কবির জুশান উখিয়া (কক্সবাজার)
- ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:১২
দেশের অন্যতম শীর্ষ পর্যটন গন্তব্য সেন্টমার্টিন দ্বীপ। প্রতি বছর দেড় লাখেরও বেশি লোক এ দ্বীপে ভ্রমণ করেন। জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে দ্বীপটিকে পরিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করা হয়েছিল। সম্প্রতি এ দ্বীপকে কেন্দ্র করে বঙ্গোপসাগরের এক হাজার ৭৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা সেন্টমার্টিন মেরিন প্রটেক্টিভ এরিয়া ঘোষণা করা হয়। এমনিতেই সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে দ্বীপটি ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তার ওপর অধিক পর্যটকদের চাপ সেন্টমার্টিনের বিলুপ্তিকে ত্বরান্বিত করছে।
প্রশাসনিকভাবে সেন্টমার্টিন কক্সবাজার জেলার টেকনাফ উপজেলার একটি ইউনিয়ন। টেকনাফ থেকে ৯ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং মিয়ানমার উপকূল থেকে মাত্র ৪ কিলোমিটার পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের মাঝে নাফ নদীর মোহনায় সেন্টমার্টিন দ্বীপের অবস্থান। প্রায় পাঁচ হাজার বছর আগে এই দ্বীপ টেকনাফের মূল ভূখণ্ডের অংশ ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তা সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যায়। এরপর প্রায় ৪৫০ বছর আগে বর্তমান দ্বীপের দক্ষিণপাড়া জেগে ওঠে। তার ১০০ বছর পর দ্বীপের উত্তরপাড়া এবং পরবর্তী ১০০ বছরে এর বাকি অংশ সমুদ্রের উপরে ওঠে আসে। জীববৈচিত্র্যের দিক থেকে সেন্টমার্টিন পৃথিবীতে অনন্য। কিন্তু বর্তমানে এই দ্বীপের পরিবেশ বিপন্নপ্রায়।
গবেষণা থেকে জানা যায়, ১৯৮০ সালে সেন্টমার্টিনে প্রায় ১৪১ প্রজাতির প্রবাল ছিল। মাত্র চার দশকে ১০১ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়েছে। বর্তমানে মাত্র ৪০ প্রজাতির প্রবাল দ্বীপে টিকে আছে। ১৯৮০ সালে এই দ্বীপের চার দিকে প্রায় ১ দশমিক তিন-দুই বর্গকিলোমিটার প্রবাল আচ্ছাদন ছিল। বর্তমানে রয়েছে মাত্র ০.৩৯ বর্গকিলোমিটার। মাত্র ৪০ বছরের ব্যবধানে তিন ভাগের এক ভাগ প্রবালও নেই। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা না নিলে ২০৪৫ সালের মধ্যে সেন্টমার্টিন সম্পূর্ণ প্রবালশূন্য হয়ে যাবে। ১৯৬১ সালে সেন্টমার্টিনের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ৭৫০ জন। বর্তমানে এই দ্বীপের জনসংখ্যা ১০ হাজারেরও বেশি। দুই দশকের চেয়ে কম সময়ে সেন্টমার্টিন বাংলাদেশের শীর্ষ পর্যটন গন্তব্যে পরিণত হয়েছে। ১৯৯৬ সালের দিকে প্রতি বছর সেন্টমার্টিনে পর্যটক আসত মাত্র ১৫০ থেকে ২০০ জন। আর বর্তমানে প্রতি বছর দেড় লাখেরও বেশি লোক এই দ্বীপে ভ্রমণ করে। পর্যটন মৌসুমে এই দ্বীপে প্রতিদিন ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার ভ্রমণপিপাসু এই দ্বীপে ভ্রমণে আসে। সে কারণে সেন্টমার্টিনে বহু হোটেল রিসোর্ট গড়ে উঠেছে। ২০১২ সালে দ্বীপে মাত্র ১৭টি হোটেল ছিল। আর বর্তমানে হোটেল-মোটেল ও রিসোর্টের সংখ্যা দেড় শ’র কাছাকাছি। এসব অবকাঠামো গড়ে তুলতে অবাধে চলছে বৃক্ষনিধন। ৪০ বছর আগে দ্বীপে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা ছিল সাড়ে চার বর্গকিলোমিটার। আর বর্তমানে বৃক্ষ আচ্ছাদিত এলাকা মাত্র তিন বর্গকিলোমিটারেরও কম। শুধু তা-ই নয়, সৈকতসংলগ্ন এলাকায় হোটেল-মোটেল রেস্টুরেন্ট, দোকান নির্মাণের জন্য কেয়াবন ও প্রাকৃতিক ঝোপঝাড় ধ্বংস করা হচ্ছে। পর্যটকরা যে পরিমাণ বর্জ্য এই দ্বীপে ফেলে যায়, তা সরাসরি সাগরে গিয়ে পড়ে। ফলে দ্বীপের আশপাশে সাগর চরমমাত্রায় দূষিত হয়ে পড়েছে। সেই কারণে কয়েক বছর আগে পরিবেশ অধিদফতরের মহাপরিচালক বলেছিলেন, দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন দ্বীপ ডুবে যেতে আর বেশি দিন লাগবে না। যদি দ্রুততম সময়ের মধ্যে সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করা না হয় তাহলে প্রবাল দ্বীপটি সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যাবে।
সেন্টমাটিন প্রতিবেশ সঙ্কটাপন্ন দ্বীপ। বাংলায় পরিবেশ ও প্রতিবেশ শব্দের মধ্যে পার্থক্য আছে। প্রতিবেশ হলো পরিবেশরই অংশ। পরিবেশের অন্তর্ভূক্ত যেসব উপাদান প্রত্যক্ষভাবে পরিবেশকে প্রভাবিত করে তাকে বলে প্রতিবেশ। সেন্টমার্টিনে প্রতিবেশ ধ্বংস হওয়ার আশঙ্কা থেকে ১৯৯৯ সালে বাংলাদেশ সরকার পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী সেন্টমার্টিনকে প্রতিবেশগত সঙ্কটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করেছে। দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ এবং ভ্রমণ সীমিতকরণের প্রস্তাব প্রত্যাহার করে দ্বীপবাসীর জীবন-জীবিকার পথ খুলে না দিলে কোনো পর্যটককে দ্বীপে প্রবেশ করতে দেবে না বলে ইতোমধ্যেই ঘোষণা দিয়েছেন দ্বীপের বাসিন্দারা। এরই মধ্যে পর্যটকদের যাতায়াত ও অবস্থান সীমিত করার সরকারি সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে বিক্ষোভ ও মানববন্ধনও করে দ্বীপের লোকজন। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষার নামে পর্যটন শিল্প ধ্বংস করার পাঁয়তারা করছে বলে মনে করছেন দ্বীপবাসী। তাই তারা কোনো পর্যটককে আর দ্বীপে প্রবেশ করতে দেবে না। সেন্টমার্টিনের বাসিন্দা মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, সেন্টমার্টিন নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে। পরিবেশের দোহাই দিয়ে দ্বীপবাসীদের মারার ফাঁদ তৈরি করা হয়েছে। সেন্টমার্টিনে পর্যটকদের রাত্রিযাপন নিষিদ্ধ এবং ভ্রমণ সীমিতকরণের প্রস্তাব প্রত্যাহার না করলে কোনো পর্যটককে সেন্টমার্টিনে প্রবেশ করতে দেয়া হবে না। সম্প্রতি নাফ নদীতে ডুবোচর জেগে ওঠার কারণে নাব্য সঙ্কট এবং মিয়ানমার সীমান্তে গোলাগুলির কারণে নিরাপত্তার অভাবে আপাতত টেকনাফ থেকে জাহাজ চলাচলের অনুমতি দেয়া হচ্ছে না। শুধু কক্সবাজার শহর থেকে জাহাজ চলাচল করবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা