২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ন ১৪৩১, ২৩ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন সংশোধনে নতুন বিধান

ভুক্তভোগী, আসামি ও সাক্ষীদের অধিকার সংরক্ষণ, ক্ষতিপূরণ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অপরাধের বিচারের বিধান থাকছে
-


জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধ এবং বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে হওয়া গুম-খুনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের সংশোধনীর গেজেট প্রকাশ করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধন করে রোববার অধ্যাদেশের গেজেট প্রকাশ করেছে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়। এ অধ্যাদেশে ভুক্তভোগী, আসামি ও সাক্ষীদের অধিকার সংরক্ষণ, ক্ষতিপূরণ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপরাধের বিরুদ্ধে বিচারের বিধান থাকলেও, রাজনৈতিক দলের বিচারের বিধান রাখা হয়নি।
অন্যদিকে ট্রাইব্যুনালের অন্তর্বর্তী আদেশের বিরুদ্ধে, যেমন আদালত অবমাননার ক্ষেত্রে কেউ চাইলে আপিল বিভাগে যেতে পারবে। আগে আইনে ছিল ‘সশস্ত্র বাহিনীর’ কথা, এখন বলা হয়েছে ‘শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য’; এর মধ্যে রয়েছে তিন বাহিনী, সাথে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি এবং যে কোনো গোয়েন্দা সংস্থাসহ আনসার বাহিনীকেও এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে।

এ ছাড়া এই আইনের সেকশন ১২তে ডিফেন্স কাউন্সিলকে অধিকার দেয়া হয়েছে, সেকশন ১৭তে অভিযুক্তদের অধিকার দেয়া হয়েছে। সেকশন ৯এ শুনানির ব্যাপারে আসামিদের আগে তিন সপ্তাহ সময় দেয়া হতো, এখন ছয় সপ্তাহ সময় দেয়া হয়েছে।
আগে অনুমতি নিয়ে সীমিত নথি দিতে পারত, এখন ডিফেন্স চাইলে অনুমতি নিয়ে যে কোনো সময় নথিপত্র জমা দিতে পারবে।
সংশোধিত আইনে যেসব পরিবর্তন আনা হয়েছে- (১) সেকশন ১ এ পূর্বে এখতিয়ার ছিল শুধু বাংলাদেশে। এখন এখতিয়ার বাংলাদেশসহ বাংলাদেশের বাহিরেও। অর্থাৎ আগে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে এ আইনের অপরাধ করলে তার বিচার করা যেত; এখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কিংবা বিদেশে থেকেও এ আইনের অপরাধ করলে তার বিচার করা যাবে। আবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকে যদি কোনো বিদেশীও এ অপরাধ করে থাকে তার বিচার করা যাবে।
(২) সেকশন ২ এ নতুন রূপে ডিসিপ্লিনড ফোর্স বলতে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশ র‌্যাব, বিজিবি, কোস্ট গার্ড আনসার বা আইনের দ্বারা সৃষ্ট অন্য কোনো ফোর্সকে বুঝাবে।
(৩) সেকশন ৩ (২) এর ক্লজ এ তে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলতে নতুন কিছু যোগ হয়েছে যেমন- জনসংখ্যার জোরপূর্বক স্থানান্তর, যৌন শোষণ, জোরপূর্বক গুম, মানব পাচার, যৌন দাসত্ব, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি, জোরপূর্বক গর্ভধারণ, জোরপূর্বক বন্ধ্যাকরণ।
গণহত্যার অর্থ থেকে পলিটিক্যাল গ্রুপ বাদ গেছে। উক্ত সেকশনের ২ এর (জি) তে উসকানি শব্দটি যুক্ত হয়েছে (৪) সেকশন ৪ এ অপরাধের দায় বিস্তৃত ব্যাখ্যা করা হয়েছে।
(৫) নতুন সেকশন ৯ এ যুক্ত করা হয়েছে। ট্রাইব্যুনাল ইচ্ছা করলে অডিও ভিজুয়াল শুনানির ব্যবস্থা করতে পারেন।

(৬) নতুন সেকশন ১০ বি যুক্ত হয়েছে। সেখানে বিদেশী পর্যবেক্ষকদের থাকার অনুমতি দেয়া হয়েছে।
(৭) সেকশন ১১ এর নতুন উপধারা ৭ ও ৮ সৃষ্টি করা হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে অনিবার্য পরিস্থিতিতে এর জন্য ট্রাইব্যুনাল সন্তুষ্ট হলে ক্ষতিগ্রস্ত এবং সাক্ষীদের ভার্চুয়াল হেয়ারিং নিতে পারবেন।
(৮) সেকশন ১৯ (১) এর পরিবর্তে বিস্তারিত ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সেখানে অডিও ভিডিও ডিভিডি সিসিটিভি হার্ডওয়ার সফটওয়্যার অথবা অন্য কোনো ডিজিটাল ডিভাইস সম্পর্কে বলা হয়েছে যেগুলো ট্রাইব্যুনালে উপস্থাপন করা যাবে।
(৯) অন্তর্বর্তী আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে শুধু ট্রাইব্যুনাল অবমাননার শাস্তির বিরুদ্ধে। আপিল বিভাগে আবেদন পেন্ডিং থাকলে ট্রাইব্যুনাল মামলা চালিয়ে যাবেন সে কথাও বলা হয়েছে।
সোমবার ট্রাইব্যুনাল প্রাঙ্গণে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে এক ব্রিফিং-এ অধ্যাদেশের বিষয়বস্তু তুলে ধরা হয়।
এ বিষয়ে প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম জানান, দেশে আগে থেকেই পলিটিক্যাল পার্টির বিচারের জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় আইন করা আছে বলে রাজনৈতিক দলের বিচারের জন্য নতুন করে কোনো বিধান বর্তমান সংশোধনীর ফলে আসেনি। নতুন সংশোধনের মাধ্যমে ন্যায়বিচারের স্বার্থে আন্তর্জাতিক আইনের সাথে সামঞ্জস্য রেখে ভুক্তভোগী ও সাক্ষীর সুরক্ষার মানদণ্ড উন্নীত করার পাশাপাশি তাদের জন্য ক্ষতিপূরণের বিধান সংযুক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, ন্যায়বিচারের স্বার্থে ‘আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে এই সংশোধনীগুলো করা হয়েছে। এখন থেকে এই আইনের অধীনে অপরাধীর কিংবা রাষ্ট্রীয় সম্পদ থেকে সরকার ভুক্তভোগী, সাক্ষী কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিকে ক্ষতিপূরণ দিতে পারবেন।

তিনি জানান, বর্তমান সংশোধনীর ফলে ‘মেম্বার অব দ্যা ডিসিপ্লিনারি ফোর্স’ কথাটি সংযুক্ত করা হয়েছে, যার অধীনে থাকবে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী ছাড়াও পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি, গোয়েন্দা বাহিনী, আনসার বা আইনের দ্বারা সৃষ্ট অন্য কোনো ফোর্স। সেই সাথে সম্পূর্ণ নতুনভাবে গুম বা এনফোর্সড ডিসাপিয়ারেন্সের সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে। তিনি বলেন, আইনের সংশোধনীটি ৬ জানুয়ারি, ২০০৯ সাল থেকে কার্যকর হবে বলে মর্মে ধরে নেয়া হবে। সেই সাথে, এই আইনের অধীনে বিচারযোগ্য অপরাধগুলোর বিচারই কেবল এই আদালতে বিচার করা হবে। আর যদি কোনো অপরাধ এই আইনের অধীনে বিচার যোগ্য না হয়ে থাকে সে ক্ষেত্রে ট্রাইব্যুনাল আদেশ দিয়ে তা সংশ্লিষ্ট আদালতে পাঠাতে পারবে।
তিনি বলেন, এতে ডিফেন্স প্রস্তুতে আসামির প্রাপ্য সময় বৃদ্ধি করা হয়েছে ও ট্রাইব্যুনাল অবমাননার শাস্তির অন্তর্বর্তী আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার বিধান সংযোজিত হয়েছে বলে তিনি জানান।
এ বিষয়ে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর এ বি এম সুলতান মাহমুদ জানান, সংশোধনীতে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলতে নতুন কিছু বিষয় যোগ হয়েছে যেমন- জনসংখ্যার জোরপূর্বক স্থানান্তর, যৌন শোষণ, জোরপূর্বক গুম, মানব পাচার, যৌন দাসত্ব, জোরপূর্বক পতিতাবৃত্তি, জোরপূর্বক গর্ভধারণ, জোরপূর্বক বন্ধ্যত্বকরণ ইত্যাদি। এ ছাড়া, অপরাধের দায়ভারের বিষয়ে বিশদ ব্যাখ্যা করা হয়েছে। সুষ্ঠু ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় বদ্ধপরিকর ট্রাইব্যুনাল এ সংশোধনীর মাধ্যমে নিজের লক্ষ্যে আরো একধাপ এগিয়ে গেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
এর আগে গত বুধবার এ আইনের সংশোধনের খসড়ায় অনুমোদন দেয় উপদেষ্টা পরিষদ। আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ সংশোধন করে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৪ করা হয়েছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হয়। এ আন্দোলন দমনে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার যে হত্যাকণ্ড চালায়, তার বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে করার উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। পাশাপাশি এ আইনে বিগত আওয়ামী লীগ আমলে যে গুম, খুনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে, তারও বিচার করার উদ্যোগ রয়েছে। এমন প্রেক্ষাপটে আইনটি সংশোধন করল সরকার।


আরো সংবাদ



premium cement