প্রশ্নের মুখে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা
এনসিটি-পিসিটির মাঝখানেই রাষ্ট্রীয় সব কৌশলগত স্থাপনা- নূরুল মোস্তফা কাজী চট্টগ্রাম ব্যুরো
- ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:০০
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর চ্যানেলকে ঘিরে গড়ে উঠেছে দেশের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত সব স্থাপনা। কিন্তু বন্দরের টার্মিনালগুলো বিদেশীদের হাতে তুলে দেয়ার ক্ষেত্রে সেটা বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে কি না সে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। বন্দর ব্যবহারকারী একাধিক সূত্র দাবি করেছে, এক দিকে পিসিটি (পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল) অন্য দিকে এনসিটি (নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল), আর এ দু’টির মধ্যে রয়েছে দেশের প্রধান প্রধান তেল স্থাপনা এবং নৌবাহিনীর ঘাঁটি। পিসিটি পতিত আওয়ামী সরকারের আমলে সৌদি অপারেটরের হাতে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অপর দিকে এনসিটি পরিচালনায় বর্তমান সরকারও পতিত সরকারের পথেই হাঁটছে বলে মন্তব্য বন্দর সংশ্লিষ্টদের। মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক টার্মিনাল অপারেটরগুলোর শীর্ষপদে আমাদের প্রতিবেশী একটি দেশের কর্মকর্তাদের প্রাধান্য। তাই এই দুই টার্মিনালের মাধ্যমে প্রকারান্তরে আমাদের কৌশলগত স্থাপনার ওপর প্রতিবেশী দেশটির নজরদারির সুযোগ অবারিত হচ্ছে কি না তা ভেবে দেখার দাবি রাখে। অর্থনেতিক লাভকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে রাষ্ট্রীয় কৌশলগত স্থাপনার নিরাপত্তাকে খাটো করে দেখা হচ্ছে কি না এমন প্রশ্নও উঠছে। একই সাথে দেশীয় অপারেটর নিয়োগ করার ক্ষেত্রেও একচেটিয়া প্রভাব বন্ধে গুরুত্বারোপ করেন বন্দর সংশ্লিষ্টরা।
বন্দর সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, সরকার পিপিপির (পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ) আওতায় চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) সৌদি আরবভিত্তিক রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালকে (আরএসজিটিআই) একটি কনসেশন চুক্তির আওতায় পরিচালনার দায়িত্ব দেয়। গত বছরের ৬ ডিসেম্বর ইকুইপ-অপারেট অ্যান্ড ট্রান্সফার ভিত্তিতে ২২ বছরের একটি কনসেশন চুক্তির ভিত্তিেিত পিসিটি পরিচালনা করছে আরএসজিটি বাংলাদেশ। চুক্তির পর চলতি বছরের ১০ জুন টার্মিনালটির অপারেশন কার্যক্রম শুরু করে আরএসজিটি বাংলাদেশ। প্রতিষ্ঠানটি সৌদি আরবভিত্তিক হলেও চট্টগ্রাম বন্দরে এই প্রতিষ্ঠান নিয়োজিত হয় অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে।
বন্দর সূত্র জানিয়েছে, পিসিটির টার্মিনাল অপারেটর নিয়োগে প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্রটির সরাসরি হস্তক্ষেপ ছিল। সূত্র মতে, সৌদি সরকারের মিনিস্ট্রি অব ইনভেস্টমেন্টের সাথে বাংলাদেশ সরকারের জি টু জি চুক্তির ভিত্তিতে পিপিপির আওতায় প্রাইভেট কোম্পানি রেড সি গেটওয়ে টার্মিনালকে (আরএসজিটি) মনোনীত করা হয়। ২০১৯ সালের ৩১ জুলাই আরএসজিটির সাথে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়।
জানা গেছে, আরএসজিটির মূল কোম্পানি হলো আরএসপিডি (রেড সি পোর্টস ডেভেলপমেন্ট) কোম্পানি। তাদের ইনভেস্টমেন্ট উইং হলো আরএসজিটি যার ৮০% শেয়ার সৌদি কোম্পানি জেনেল ইন্ডাস্ট্রিজ এবং সৌদি ইন্ডাাস্ট্রিয়াল সার্ভিস কোম্পানীর স্টক লিস্টেড। ২০% শেয়ার মালয়েশিয়ান মাইনিং কোম্পানির (এমএমসি)। এমএমসির ওই শেয়ার চায়নার কোম্পানি কসকোর ছিল বলে জানিয়ে সূত্র দাবি করেছে এতে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্রটির পক্ষ হতে আরএসজিটিকে কাজ দিতে মানা করা হয়।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে আরএসজিটি নতুন করে লন্ডনভিত্তিক নতুন একটি কোম্পানি গঠন করে যার নাম দেয় আরএসজিটিআই (রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল)।
জিটুজি ফ্রেমওয়ার্ক চুক্তি হয় সৌদি সরকারের মিনিস্ট্রি অব ইনভেস্টমেন্টের নমিনেটেড প্রাইভেট কোম্পানি রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল-আরএসজিটির সাথে। কিন্তু পিসিটি পরিচালনার জন্য আরএফপি (রিকুয়েস্ট ফর প্রপোজাল) জমা দেয় আরএসজিটিআই। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, আরএফপি জমা দেয়ার মাত্র অল্প দিন আগে কোম্পানিটি লন্ডনে তালিকাভুক্ত হয়।
সূত্র আরো জানায়, আরএসজিটিআই পরিচালনায় রয়েছে আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশীর কর্মকর্তারা। তা ছাড়া ২০০৯ সালে আরএসজিটি গঠিত হলেও আরএসজিটিআই গঠিত হয় ২০২২ সালের জুলাইয়ে। আর লন্ডনে তালিকাভুক্ত হয় ২০২৩ সালে। ফলে প্রতিষ্ঠানটির টার্মিনাল পরিচালনার অভিজ্ঞতা নিয়েও প্রশ্ন থেকে যায়। জিটুজি ফ্রেম ওয়ার্ক চুক্তির সময় যে প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বই ছিল না এমন প্রতিষ্ঠানকে টার্মিনাল তুলে দিতে হয়েছে প্রতিবেশী দেশের হস্তক্ষেপে।
চট্টগ্রাম বন্দরের সবচেয়ে সমৃদ্ধ টার্মিনাল নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) নির্মিত হয়েছিল চারদলীয় জোট সরকারের আমলে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া টার্মিনালটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলেন। ইতোমধ্যে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে এই টার্মিনালের পেছনে। সমৃদ্ধ এই টার্মিনালটিও পিপিপির আওতায় এনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের ডিপি ওয়ার্ল্ডকে টার্মিনাল অপারেটর নিয়োগ দিতে পতিত স্বৈরাচারী সরকারের শেষ সময়ে এসে বেশ তোড়জোড় চালানো হয়। কথিত আছে ওই প্রতিষ্ঠানটির সাথে পতিত সরকারের রাঘববোয়ালদের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। তা ছাড়া মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক মেরিটাইম সেবা সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ মূলত আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী দেশের কর্মকর্তাদের হাতে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগের সরকারের প্রাধিকার তালিকায় ছিল প্রতিবেশী বৃহৎ রাষ্ট্রের স্বার্থ সবার আগে, এখনো কি সেই ধারা বজায় থাকবে? কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাকে ঘিরে অবস্থান করা দুই টার্মিনালের একটি ইতোমধ্যে বিদেশীদের হাতে দেয়া হয়েছে। কাজেই অপরটিও বিদেশীদের হাতে দেয়ার আগে কৌশলগত স্থাপনার নিরাপত্তা হুমকির বিষয়টি সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়ার দাবি বন্দর ব্যবহারকারীদের।
এনসিটিতে বিদ্যমান টার্মিনাল অপারেটরের মেয়াদ আগামী ৭ জানুয়ারি শেষ হচ্ছে। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্র ছাড়া ডিপিএম পদ্ধতিতে নিয়োগ পাওয়া দেশীয় অপারেটর সাইফ পাওয়ারটেক এখন টার্মিনালটি পরিচালনা করছে। মেয়াদ পুর্তির আগেই এই গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনালের অপারেটর নিয়োগের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তাই একাধিক বন্দর ব্যবহারকারীর মত হচ্ছে, এনসিটির পুরো টার্মিনাল একটি অপারেটরকে না দিয়ে জেটিগুলোতে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে পৃথক পৃথক অপারেটর নিয়োগের মাধ্যমে পরিচালনায় দায়িত্ব দেয়া হোক। সে ক্ষেত্রে একচেটিয়া একক আধিপত্যের যেমনি অবসান হবে তেমনি প্রতিযোগিতাও বাড়বে বলে সংশ্লিষ্টদের মত।
এ দিকে চট্টগ্রাম বন্দরের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে পর্যালোচনার জন্য আজ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ সভা রয়েছে বলে জানা গেছে। বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো: ওমর ফারুক আজ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠেয় বৈঠকে থাকার কথা স্বীকার করেছেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা