জ্বালানির মূল্য ওঠানামা অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে : সানেম
- বিশেষ সংবাদদাতা
- ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৯
দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত দীর্ঘদিন ধরে সমস্যাগ্রস্ত। তাই জ্বালানিমূল্য ওঠানামা দীর্ঘমেয়াদে সামষ্টিক অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে। এমতাবস্থায় সরকারি নীতিতে পরিবর্তন আনা প্রয়োজন, যাতে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে, নবায়নযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব শক্তির দিকে এগিয়ে যাওয়া যায়। নবায়নযোগ্য জ্বালানিকে প্রাধান্য দেয়া এবং দেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানির রূপান্তর ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে একটি সমন্বিত ও স্বচ্ছ নীতিগত কাঠামো গ্রহণ করা জরুরি। পাশাপাশি সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ উন্নয়নে প্রয়োজনীয় বিনিয়োগের পরিমাণ নির্ধারণ এবং প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ সংগ্রহে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব, সবুজ বন্ড (গ্রিন বন্ড), আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে অর্থায়ন এবং একটি বিশেষায়িত নবায়নযোগ্য জ্বালানি তহবিল গঠনের সুপারিশ করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)।
গতকাল শনিবার রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইন-এ দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত নিয়ে ‘এক্সপ্লোরিং এ সাসটেইনেবল পাথওয়ে ফর বাংলাদেশ’স এনার্জি ট্রান্সফর্মেশন টুয়ার্ডস গ্রিন অ্যান্ড ক্লিন এনার্জি’ শীর্ষক এক জাতীয় সংলাপে এমন অভিমত ও সুপারিশ ব্যক্ত করেছে সানেম। সংলাপে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত সম্পর্কিত তিনটি পৃথক গবেষণার ফলাফল ও সুপারিশ তুলে ধরা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান সংলাপে সভাপতিত্ব করেন। সংলাপে গবেষণালব্ধ ফলাফল উপস্থাপনা করেন সানেমের জ্যেষ্ঠ গবেষণা সহযোগী মো: তুহিন আহমেদ ও গবেষণা সহযোগী একরামুল হাসান।
সানেম জানায়, সংলাপে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত সম্পর্কিত তিনটি পৃথক গবেষণার ফলাফল ও সুপারিশ তুলে ধরা হয়েছে।
সংলাপে দেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত সম্পর্কিত তিনটি পৃথক গবেষণার ফলাফল ও সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে ‘জ্বালানি মূল্য ওঠানামার সামষ্টিক অর্থনৈতিক প্রভাব : বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট’ শীর্ষক প্রথম গবেষণায় বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর জীবাশ্ম জ্বালানির বৈশ্বিক মূল্য ওঠানামার প্রভাব বিশ্লেষণ করে বলা হয়েছে, জ্বালানি মূল্য ওঠানামা দীর্ঘমেয়াদে সামষ্টিক অর্থনীতিকে অস্থিতিশীল করে তুলতে পারে, যা সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে বড় বাধা সৃষ্টি করতে পারে। তবে জ্বালানি মূল্যের হ্রাস-বৃদ্ধি সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর কোনো উল্লেখযোগ্য সমকালীন প্রভাব নেই। এমতাবস্থায় সরকারি নীতিতে পরিবর্তন এনে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরশীলতা কমানো, নবায়নযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব শক্তির ওপর গুরুত্বারোপের সুপারিশ করা হয়েছে গবেষণায়।
গবেষণায় বলা হয়েছে, কয়লা ও এলএনজির (লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস) মূল্যবৃদ্ধি সমকালীনভাবে ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই)-এর ওপর একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। উভয়ই সিপিআই মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে তোলে। উদাহরণ হিসেবে বলা হয়, যদি কয়লার দাম ১০% বৃদ্ধি পায়, তবে সিপিআই মুদ্রাস্ফীতি ০.৩% বৃদ্ধি পায়। আবার, এলএনজিএর দাম ১০% বৃদ্ধি পেলে সিপিআই মুদ্রাস্ফীতি ০.২% বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়।
গবেষণায় বলা হয়, অপরোশোধিত তেল ও কয়লার বাজারে অস্থিরতা একই সময়ে বিনিময় হারের ওপরও উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলে। যদি অপরোশোধিত তেলের দাম ১০% বৃদ্ধি পায়, তবে বিনিময় হার ০.১৬% বৃদ্ধি পায় (অথবা মুদ্রার অবমূল্যমান হবে)। অন্য দিকে, যদি এলএনজি দাম ১০% বৃদ্ধি পায়, বিনিময় হারও একইভাবে ০.১৫% বৃদ্ধি পেতে দেখা যায়। এ ছাড়া অপরিশোধিত তেল, এলএনজি ও কয়লার বাজারে অস্থিরতা নেট রফতানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
‘বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য শক্তি রূপান্তরের প্রেক্ষাপটে বিদ্যুৎ ও শক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানের গুণমান এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির গতিবিধির মূল্যায়ন’ শীর্ষক দ্বিতীয় গবেষণায় বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের প্রাতিষ্ঠানিক মান এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির গতিশীলতা মূল্যায়ন করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে প্রাতিষ্ঠানিক মানের দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক অর্থনীতির বিভিন্ন সমস্যা স্পষ্ট। সব প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানির ভবিষ্যৎ নিয়ে যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। তবে একক কোনো সংস্থা দেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানি লক্ষ্য অর্জন করতে পারবে না, তাই প্রযুক্তিগত, আর্থিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্মিলিত প্রচেষ্টা অপরিহার্য। বাংলাদেশের নবায়নযোগ্য জ্বালানির রূপান্তর ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে একটি সমন্বিত ও স্বচ্ছ নীতিগত কাঠামো গ্রহণ করা জরুরি।
গবেষণায় বলা হয়, ২০১০ সালের ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহ দ্রুত বৃদ্ধির (বিশেষ বিধান) আইন’ (২০২১ সালে সংশোধিত) প্রতিযোগিতামূলক বিডিং উপেক্ষা করে উচ্চ বিদ্যুৎমূল্য নির্ধারণ করে এবং ২০০৬ সালের পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইনকে অগ্রাহ্য করে, যা বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ড (বিপিডিবি)-এর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা দুর্বল করেছে। ২০২৩ সালের বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন সংশোধনের মাধ্যমে সরকার বিশেষ পরিস্থিতিতে একতরফাভাবে জ্বালানি ও বিদ্যুতের মূল্য নির্ধারণ করতে পারে, যা জনশুনানি বাদ দিয়ে অস্বচ্ছ বাজার সৃষ্টি করেছে। সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে দুর্বল সমন্বয় নীতিগত সামঞ্জস্যের অভাবকে নির্দেশ করে এবং দীর্ঘমেয়াদে নীতির কার্যকারিতা ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (স্রেডা)-এর ক্ষমতা সীমিত এবং বিপিডিবি’র নবায়নযোগ্য জ্বালানি শাখা সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রাধান্য বিস্তার করায় নবায়নযোগ্য জ্বালানি রূপান্তরের প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কেন্দ্রীভূত বাজার কাঠামোর ফলে বিপিডিবি একক ক্রেতা হিসেবে কাজ করে এবং রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বিদ্যুৎ বিতরণ নিয়ন্ত্রণ করায় বেসরকারি খাতের অংশগ্রহণ সীমিত হচ্ছে। ২০২৫ সালে এ জ্বালানি খাতের ভর্তুকির ৮০% (৩২,০০০ কোটি টাকা) ক্যাপাসিটি চার্জে বরাদ্দ, যা স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলোর সুবিধা নিশ্চিত করেছে।
সংলাপে উপস্থাপিত ‘বাংলাদেশে ২০৪১ সালের মাঝে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজনীয়তার মূল্যায়ন’ শীর্ষক তৃতীয় গবেষণায় শক্তি সংরক্ষণ ব্যবস্থার সংযুক্তির সম্ভাব্যতা মূল্যায়ন এবং নবায়নযোগ্য জ্বালানির লক্ষ্য অর্জনে বিভিন্ন অর্থায়ন প্রক্রিয়ার উল্লেখ করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের বর্তমান নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন ক্ষমতা ১২১৯.২৪ মেগাওয়াট, যা মোট বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাত্র ৪.১৬%। এ খাতে ভবিষ্যৎ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের প্রয়োজন। গবেষণায় ২০২৫ থেকে ২০৪১ সাল পর্যন্ত প্রতিটি পরিস্থিতির জন্য বছরে বছরে বিনিয়োগ পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে, যা জিডিপির তুলনায় ন্যূনতম। তবে উচ্চ প্রাথমিক খরচ, বিশেষত শক্তি সঞ্চয়ের জন্য, একটি বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। যদিও বৈশ্বিকভাবে ব্যাটারির খরচ কমার পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে, বাংলাদেশের জন্য শক্তি সঞ্চয় ব্যবস্থা বর্তমানে ব্যয়বহুল।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা