উজানে যৌথ নদীর পানি প্রত্যাহারে দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয়
সেমিনারে অভিমত- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৫৯
উজানে যৌথ নদীর পানি প্রত্যাহারে দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঘটছে। উজানে নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর কারণে সাম্প্রতিক দশকগুলোতে সব যৌথ নদীর প্রবাহ বর্ষা ও শুকনো উভয় মওসুমে মারাত্মকভাবে হ্রাস পেয়েছে। ভরা মৌসুমে স্বাভাবিকের চেয়ে কম পানি প্রবাহের কারণে প্লাবনভূমির বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ এলাকার বড় একটি অংশ স্বাভাবিক বর্ষা মৌসুমের প্লাবন থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে প্লাবনভূমি শুকনো অংশ, জলজ উদ্ভিদ, প্রাণী উৎপাদন ও দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রজনন ক্ষেত্র থেকে হারিয়ে গেছে। গুরুতরভাবে তাদের জীবৈচিত্র্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। গতকাল জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত সেমিনারে বক্তারা এ কথা বলেন।
‘উজানে যৌথ নদীর পানি প্রত্যাহার : বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয়’ শীর্ষক এ সেমিনারের আয়োজন করে আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটি। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন বর্তমান সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ। মূল প্রবন্ধ পাঠ করেন, লেখক অনলাইন দৈনিক গ্রিনওয়াচ সম্পাদক এবং আন্তর্জাতিক ফারাক্কা কমিটির সমন্বয়ক মোস্তফা কামাল মজুমদার।
বক্তব্য রাখেন সংগঠনের চেয়ারম্যান সৈয়দ টিপু সুলতান, সভাপতি অধ্যাপক জসিম উদ্দিন আহমাদ। বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, সাবেক মহাপরিচালক ওয়ারপো, প্রকৌশলী ইনামুল হক।
সেমিনারে বলা হয়, হিমালয়ের চারটি প্রধান নদী প্রবাহের মধ্যে তিনটি গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা, যার মোট অববাহিকার পরিমাণ ১.৭২ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার। এই বিরাট অববাহিকার মাত্র ৭ শতাংশ রয়েছে বাংলাদেশে। বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত পানির প্রায় ৭০ শতাংশ আসে ৫৭টি যৌথ নদী থেকে, কিন্তু নদীগুলোর প্রবাহ ব্যবস্থাপনায় আমাদের খুব কমই নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। এই নদীগুলোর মধ্যে ৫৪টি ভারত হয়ে এবং তিনটি ছোট পাহাড়ি নদী মিয়ানমার থেকে এসেছে।
উজানের প্রতিবেশী, ভারত সব যৌথ নদীতে প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ কাঠামো তৈরি করেছে। ফলে এই নদীগুলো থেকে বাংলাদেশে আসা পানির পরিমাণ ভারতের পানি- সম্প্রদায়গুলোর চাহিদা পূরণের পর প্রবাহ ছাড়ার ওপর নির্ভরশীল। যখনই উজানে ভারী বৃষ্টিপাত হয় তখনই নদীর অত্যধিক পানি বাংলাদেশে ছেড়ে দেয়া হয়, ফলে বিধ্বংসী বন্যা হয়, যা ফসলের ক্ষতি করে এবং বসতবাড়িগুলোকে প্লাবিত করে।
এতে বল হয়, গত আগস্টে ভারী বৃষ্টিপাত এবং দুর্বল মনিটরিংয়ের কারণে ত্রিপুরার গোমতী নদীতে নির্মিত ডম্বুর জলাধার থেকে আকস্মিকভাবে পানি ছেড়ে দেয়ায় ফেনী ও কুমিল্লায় ৪০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ বন্যা হয়। এ বন্যায় ফসল, বাড়িঘর ও অবকাঠামোর ক্ষতির পরিমাণ প্রাথমিক সরকারি অনুমানে দাঁড়িয়েছে ১৪০ বিলিয়ন টাকা।
অপর দিকে শুষ্ক মৌসুমে পানির স্বল্প প্রবাহের কারণে শত শত ছোট নদী শুকিয়ে যায় যা কৃষি, শিল্প, মৎস্য, বন, নদী-যোগাযোগ, সার্বিক পরিবেশ ও জীবজাগতিক ভারসাম্যের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। ভূ-উপরিস্থ পানির ঘাটতির কারণে বাংলাদেশের কৃষকরা ক্রমেই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। সেচের জন্য ভূগর্ভস্থ পানির অধিকতর ব্যবহার আর্সেনিক সমস্যা সৃষ্টি করেছে, যা বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় পরিবেশগত বিপর্যয়ের মধ্যে একটি।
অন্য দিকে শুধু গঙ্গার পানি বণ্টন নিয়ে ভারতের সাথে বাংলাদেশের চুক্তি আছে। ৩০ বছর মেয়াদি এই চুক্তি ২০২৬ সালে শেষ হবে। চুক্তিটি ত্রুটিপূর্ণ, কারণ এতে ফারাক্কা ব্যারাজ পয়েন্টে বয়ে আসা পানি বণ্টনের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এই চুক্তি ব্যারাজের উজানে পানি ব্যবস্থাপনা কার্যক্রমের বিষয়ে নীরব। তার মানে, ফারাক্কার উজানের নদী ব্যবস্থাপনার বিষয়ে বাংলাদেশের কোনো বক্তব্য রাখার সুযোগ নেই, এমনকি যদি এর ফলে নদী শুকিয়েও যায়। সুতরাং অবাক হওয়ার কিছু নেই যে ১৯৯৭ সালে চুক্তিটি কার্যকর হওয়ার প্রথম বছরেই ৩০ হাজার কিউসেক সম্মত পরিমাণের বিপরীতে বাংলাদেশ পেয়েছিল মাত্র ছয় হাজার কিউসেক পানি। গঙ্গার স্বাভাবিক প্রবাহের অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশের এক-তৃতীয়াংশ নিয়ে গঠিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল মারাত্মক পরিবেশগত অবক্ষয়ের শিকার হয়েছে। গত পাঁচ দশকে গঙ্গার শাখা নদীগুলো মৃত নদীতে পরিণত হয়েছে। কৃষি, শিল্প, মৎস্য মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে এবং নদী-যোগাযোগ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। বদলে গেছে মানুষের পেশা, জীবন ও জীবিকা। সুন্দরবনে মিঠা পানির প্রবাহের অনুপস্থিতি সমুদ্র থেকে লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ বাড়িয়েছে এবং মানবজাতির একটি ঐতিহ্য ম্যানগ্রোভ বনকে ধ্বংসের মুখে ফেলেছে।
বিরাজমান অবস্থায় বাংলাদেশের উচিত এখন ভারত, নেপাল ও চীন অর্থাৎ সব অববাহিকাভুক্ত দেশ নিয়ে নদীটির যৌথ অববাহিকাভিত্তিক ব্যবস্থাপনার বিধানসহ গঙ্গা চুক্তি নবায়ন করা। একই সাথে পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখার স্বার্থে অন্য ৫৩টি অভিন্ন নদীর জন্য একটি ব্যাপক যৌথ পানি ব্যবস্থাপনা চুক্তি করা জরুরি হয়ে পড়েছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা