২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
উপকূল এলাকায় জেটি নির্মাণ

সরকার পরিবর্তনে উঠে গেছে টেন্ডারের ‘কঠিন শর্ত’

একই প্রকল্পের একই ধরনের কাজে সময়ের ব্যবধানে দুই ধরনের শর্ত
-

আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায়ের কারণে উপকূলীয় এলাকায় জেটি নির্মাণ কাজের টেন্ডারের ‘কঠিন’ ও ‘বিশেষ’ শর্ত তুলে দিয়েছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। সম্প্রতি চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে জেটি নির্মাণ কাজের একটি টেন্ডার নোটিশ প্রকাশ করেছে সংস্থাটি। এ টেন্ডারে আগের মতো ‘কঠিন শর্ত’ রাখা হয়নি। অথচ গত বছরই সন্দ্বীপ উপজেলায় একই ধরনের জেটি নির্মাণের টেন্ডারে ওই বিশেষ শর্ত যুক্ত করেছিল। ওই টেন্ডারে কাজ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের ‘ই-ইঞ্জিনিয়ারিং’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের চাওয়া অনুযায়ী বিশেষ ওই শর্ত জুড়ে দেয় বিআইডব্লিউটিএ। তৃতীয় সর্বোচ্চ দরদাতা হওয়া সত্ত্বেও ওই প্রতিষ্ঠানকে ৩৫৬ কোটি টাকার কাজও দেয়া হয়। এখন ধীরগতিতে কাজ করছে ‘ই-ইঞ্জিনিয়ারিং’। সরকার পরিবর্তন হওয়ায় এবারের টেন্ডারে বিশেষ শর্ত যুক্তের চাপাচাপিও বন্ধ হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো এসব তথ্য জানিয়েছে।
সরকার বদলের সাথে রাতারাতি টেন্ডার প্রক্রিয়ায় এমন শর্ত পরিবর্তনে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় ও বিআইডব্লিউটিএর একাধিক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তারা বলেন, বিগত সরকারের আমলে বিআইডব্লিউটিএতে কী ধরনের টেন্ডার কারসাজি হতো- এর বড় প্রমাণ এটি। বিভিন্ন টেন্ডারে পছন্দের ঠিকাদারদের সুবিধা দিতে এভাবে নানান শর্ত যুক্ত করে আসছেন প্রকল্প পরিচালকরা। নৌপরিবহন উপদেষ্টা হিসেবে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব:) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন দায়িত্ব নেয়ার পর টেন্ডার কারসাজি বন্ধে কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন। তারা আরো জানান, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দায়িত্ব পালন করা বেশির ভাগ প্রকল্প পরিচালকই বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। পেয়েছেন ক্ষমতার আনুকূল্য।
জানা গেছে, চট্টগ্রামের মিরসরাই ও সন্দ্বীপ, কক্সবাজারের সোনাদিয়া দ্বীপ ও টেকনাফ (সাবরাং ও জালিয়ার দ্বীপ) অংশের জেটিসহ আনুষাঙ্গিক স্থাপনাদি নির্মাণ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিআইডব্লিউটিএ। প্রকল্পের আওতায় দেশের উপকূলীয় এলাকাগুলোতে ৪টি জেটি নির্মাণের কথা রয়েছে। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে ২০২৫ সালের ডিসেম্বরে। এ প্রকল্পের আওতায় দ্বিতীয় জেটি নির্মাণে সম্প্রতি টেন্ডার আহ্বান করেছে বিআইডব্লিউটিএ। এই জেটি নির্মাণ হবে চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে। এ টেন্ডারের শর্তগুলোর অন্যতম হচ্ছে- মূল ঠিকাদার বা সহকারী ঠিকাদার হিসেবে গত ৭ বছরে অন্তত ২১০ কোটি টাকা মূল্যের একটি কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। পানির নিচে পাইলিংসহ জেটি বা ব্রিজ নির্মাণ বা একই ধরনের অন্য কাজের অভিজ্ঞতাও থাকতে হবে। টেন্ডার জমার শেষ তারিখ আগামী ১১ ডিসেম্বর। বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা জানান, এবার টেন্ডারে যেসব শর্ত দেয়া হয়েছে, তাতে অনেক প্রতিষ্ঠানই অংশ নেয়ার যোগ্য হবে।

আরো জানা গেছে, গত বছর সন্দ্বীপে একই ধরনের জেটি নির্মাণের টেন্ডারে বিশেষ শর্ত যুক্ত করা হয়। রহস্যজনক কারণে ওই সময়ে দফায় দফায় টেন্ডারে শর্ত পরিবর্তনও করা হয়। সর্বশেষ ২০২৩ সালের ১৪ জুন প্রকাশিত টেন্ডারে পাঁচ বছরে অন্তত ২১০ কোটি টাকা মূল্যের একটি কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। পানির নিচে পাইলিংসহ জেটি বা ব্রিজ নির্মাণ বা একই ধরনের অন্য কাজের অভিজ্ঞতাও থাকতে হবে। এসব শর্তের পাশাপাশি সেখানে বিশেষ কিছু শর্ত যুক্ত ছিল। তার মধ্যে রয়েছে- ‘উপকূল’ এলাকার কাজের জেটি বা ব্রিজ বা বন্দর নির্মাণের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে এবং অন্তত ৬০০ মিলিমিটার আয়তনের পিএইচসি (প্রেস্টেসড হলৌ কনক্রিট) পাইল বা স্টিল পাইল স্থাপনের অভিজ্ঞতা থাকার শর্তও যুক্ত করা হয়। এখানেই শেষ নয়, গত বছরের ২৫ জুন বিআইডব্লিউটিএতে সংস্থাটির সদস্য (প্রকৌশল) ড. এ কে এম আজাদুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত টেন্ডার পূর্ব বৈঠকে ই-ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পক্ষ থেকে শুধু ৯০০ মিলিমিটার আয়তনের পিএইচসি (প্রেস্টেসড হলৌ কনক্রিট) পাইল স্থাপনের শর্ত দেয়ার জন্য বলা হয়। স্টিল পাইলের অভিজ্ঞতা বাদ দিতে বলা হয়। ওই সভার কার্যবিবরণীতে এ প্রতিষ্ঠানের চাওয়া অনুযায়ী স্টিল পাইলের অভিজ্ঞতার শর্ত বাদ দেয়া হয়। এই একটি শর্ত বাদ দেয়ায় ছিটকে পড়ে বেশির ভাগ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। একমাত্র কারিগরি যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হয় ই-ইঞ্জিনিয়ারিং নামক প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানটি তৃতীয় সর্বোচ্চ ৩৫৫ কোটি ৮৮ লাখ টাকা দর দিলেও তা গ্রহণ করেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা এবং তাদের প্রতিষ্ঠানটিকে তড়িঘড়ি করে কাজ দেয়া হয়। এমনকি পুন:টেন্ডারও করা হয়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিআইডব্লিউটিএর একাধিক প্রকৌশলী বলেন, সাম্প্রতিক টেন্ডারের শর্তই বলে দিচ্ছে, গত বছরের টেন্ডারে বিশেষ শর্ত যুক্ত করে একটি প্রতিষ্ঠানকে কাজ পেতে সহযোগিতা করা হয়। একই ধরনের কাজ হওয়ার পরও একই ধরনের কাজে দুই টেন্ডারে দুই ধরনের শর্ত দেখা যাচ্ছে, যা পিপিআর ও পিপিএর লঙ্ঘন। বিআইডব্লিউটিএতে দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের কাজ হয়ে আসলেও ওইসব ঘটনায় তদন্ত ও দায়িদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নজির কম।
সন্দ্বীপ ও মিরসরাইয়ে একই ধরনের জেটি নির্মাণে দুই ধরনের শর্ত যুক্তের বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক এ এস এম আশরাফুজ্জামান তা অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, শর্ত পরিবর্তন করা হয়নি। টেন্ডারে স্টিল পাইল ও পিএইচসি পাইল উভয় পাইলের কথা বলা হয়েছে। তৃতীয় সর্বনিম্ন দরদাতাকে কাজ দেয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, সর্বনিম্ন দরদাতা হলেই আমরা কাউকে কাজ দিতে পারি না। দরদাতা প্রতিষ্ঠান ব্লাকলিস্টেড কি না এবং দেশীয় প্রতিষ্ঠান কি না সেগুলো বিবেচনা করতে হয়।


আরো সংবাদ



premium cement