ব্যয়বহুল তদন্তেও শনাক্ত হয়নি লাশটি কার ‘রহস্যজনক’ কারণে নেয়া হয়নি ডিএনএ নমুনা
- জিলানী মিলটন ও এস এম মিন্টু
- ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:১৮
ঝিনাইদহের সাবেক এমপি আনার হত্যাকাণ্ড
- ডিএনএ রিপোর্ট ছাড়াই চার্জশিট দাখিল, আদালতে বিচারের অপেক্ষা : ভারতীয় সিআইডি
- তদন্ত শেষ পর্যায়ে, শিগগিরই চার্জশিট দেয়া হবে : বাংলাদেশের তদন্তকারী কর্মকর্তা
বহুল আলোচিত ঝিনাইদহের সাবেক এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার ‘হত্যাকাণ্ডের’ তদন্ত কার্যক্রম চলছে ধীরগতিতে। তদন্তের নামে বিপুল অর্থ খরচ করা চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সরাসরি জড়িতদের গ্রেফতার এবং তাদের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেয়া হলেও বাংলাদেশের পুলিশের তদন্তকাজ কার্যত থমকে গেছে। গ্রেফতার আসামিরা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিলেও ভারতে খুন হওয়া আনারের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য ‘ডিএনএ’ পরীক্ষার প্রয়োজনীয়তা থাকলেও রহস্যজনক কারণে তা করা হয়নি। তবে এই প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন না হওয়ার জন্য মূলত সাবেক এমপি আনারের মেয়েসহ পরিবারের অসহযোগিতা-অনীহাকেই দায়ী করছেন তদন্তসংশ্লিষ্টরা।
গত মে মাসের প্রথম দিকে দিনের পর দিন ব্রিফিং করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে লোমহর্ষক বর্ণনা দেয়া হয়েছে, যার মূলে ছিলেন তৎকালীন আলোচিত ডিএমপির ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ। অনেকটা সিনেমাটিক কায়দায় ‘খুনিদের’ বর্ণনাগুলো প্রচার করা হতো। তবে যেকোনো হত্যাকাণ্ডের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান কাজ থাকে লাশ চিহ্নিত বা শনাক্ত করা। আনারের লাশের যে সংবাদ পাওয়া গেছে তাতে কাগজেকলমে এই মৃত্যু নিশ্চিত হয়নি। গ্রেফতার আসামিদের নিয়ে ভারতের বেশ কয়েকটি জায়গায় অভিযান চালিয়ে হাড় ও মাংসের কিছু পচা টুকরা পেয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। দাবি করা হয়, এগুলো আনারের লাশের অংশবিশেষ। ছয় মাসের বেশি সময় মামলার তদন্তকাজ চললেও কাগজেকলমে এই মৃত্যু নিশ্চিত না হওয়ায় জনমনে প্রশ্ন রয়েই গেছে।
এ প্রসঙ্গে পুলিশের নবনিযুক্ত মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, এই মুহূর্তে প্রথম কাজ পুলিশকে জাগ্রত করা। পুরনো মামলাগুলোও দেখা হচ্ছে। আমাদের তদন্তকারী কর্মকর্তারা কাজ করছেন।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার তথা শেখ হাসিনা গণ-অভ্যুত্থানের মুখে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। একই সাথে তৎকালীন সরকারের পুলিশের মূল হাতিয়ার প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা হারুন অর রশীদের কোনো খোঁজ নেই। অভিযোগ রয়েছে, আনার হত্যাকাণ্ডের মামলার এক আসামিকে সীতাকুণ্ডের পাহাড় থেকে গ্রেফতারের জন্য হেলিকপ্টারে অভিযান চালানো হয়। তৎকালীন সময়ে এই অভিযানটি হারুনের ‘শুটিং’ বলে অনেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মন্তব্য করেন। এভাবে তদন্তের নামে প্রায় শত কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
অপর দিকে আনারের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বিভিন্ন সময় তার পিতার হত্যার বিচার চেয়ে বক্তব্য দেন। কিন্তু পিতা মারা যাওয়ার বিষয়ে শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার জন্য ডরিনকে ডিএনএ আলামত দিতে বারবার কলাকাতায় ডাকা হলেও তিনি অজ্ঞাত কারণে সাড়া দেননি বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন। আনারের পরিবারের অসহযোগিতার কারণেই কাগজেকলমে আনারের মৃত্যু নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না বলে মনে করেন তারা। কাগজেকলমে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত সন্দেহভাজন প্রধান আসামি আক্তারুজ্জামান শাহিনকে বিদেশ থেকে ফেরানোর পথও সুগম হচ্ছে না বলে জানান তদন্ত সংশ্লিষ্টরা।
অন্য দিকে ভারতীয় পুলিশ ডিএনএ প্রোফাইলিংয়ের জন্য চিঠি পাঠিয়ে আনারের পরিবারের সদস্যদের সাড়া না পেয়ে ডিএনএ রিপোর্ট ছাড়াই মামলার প্রাথমিক চার্জশিট আদালতে জমা দিয়েছে বলে জানান তদন্তকারী সিআইডি কর্মকর্তা কৌশিক। ওই প্রতিবেদনের ওপরই ভারতের আদালত বিচারকাজ শুরু করছে। ভারতের তদন্ত সূত্রে জানা যায়, চার্জশিটে সিআইডির হাতে গ্রেফতার কসাই জিহাদ হাওলাদার ও সিয়াম হোসেনের নাম আছে। তবে কী উদ্দেশে তাকে খুন করা হয়েছে সে বিষয়ে কিছু বলা হয়নি। এই মামলায় প্রধান অভিযুক্ত আক্তারুজ্জামান শাহিনকে এখনো ধরা সম্ভব হয়নি।
গতকাল ভারতের তদন্তকারী কর্মকর্তা কৌশিক নয়া দিগন্তকে বলেন, আমরা তদন্ত করে চার্জশিট দিয়েছি। এখন বিচারকাজ সম্পন্ন করবে আদালত। তিনি বলেন, আসামিদের গ্রেফতার করার পর তারা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছে। লাশ শনাক্ত ও ডিএনএ ছাড়া কিভাবে নিশ্চিত হলেন তিনিই আনার- প্রশ্নের জবাবে কৌশিক বলেন, আসলে আমরা বারবার চেষ্টা করেও আনারের মেয়ে ডরিন ও তার পরিবারের লোকজনকে আনতে পারিনি। যেহেতু ৯০ দিনের মধ্যে আদালতের নির্দেশ আছে তদন্তকাজ শেষ করার, তাই আমরা চার্জশিট দিয়েছি। যদিও এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি আনারের লাশের। তবে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা স্বীকার করেছে একজনকে তারা হত্যা করেছে। যে হোটেল লবিতে ছিলেন সে স্থানে হত্যাকাণ্ডের আলামত পাওয়া গেছে। আনার সেখানেই ছিলেন।
জনমনে প্রশ্ন উঠেছে, ঝিনাইদহ-৪ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার কি সত্যিই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন নাকি তাকে আড়ালে রেখে অন্য কোনো পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হয়েছে?
এ প্রসঙ্গে কৌশিক বলেন, ‘ডিএনএ ছাড়া শনাক্ত করা কঠিন। তিনি বলেন, আগস্ট মাসের শেষের দিকেও ডরিনকে ভারতে আসার বিষয়ে বলা হয়েছিল, আসব আসব বলছে, কিন্তু আসেননি। আমরা গত ১৭ আগস্ট প্রাথমিক চার্জশিট দিয়ে দিয়েছি। আদালত সেটা গ্রহণ করেছে এবং বিচারও শুরু করে দিয়েছে।
ডিবি ওয়ারী বিভাগের সহকারী উপকমিশনার (এসি) তানভীর হাসান নয়া দিগন্তকে বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর তদন্ত কাজে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটলেও আমরা চেষ্টা করছি মামলাটির চার্জশিট দেয়ার জন্য। তিনি বলেন, তদন্তকাজ প্রায় সম্পন্ন। গ্রেফতার আসামিরাও আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দী দিয়েছেন। আমরা শিগগিরই চার্জশিট দিতে পারব। এখনো ডিএনএ নমুনা নেয়া হয়নি, লাশ শনাক্ত ছাড়া চার্জশিট কতটা গ্রহণযোগ্য হবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিষয়টি সত্যিই জটিল। তবে আমরা চেষ্টা করছি সব তদন্তকাজ শেষ করে চার্জশিট দেয়ার।
এ দিকে আনার কন্যা ডরিনকে একাধিকবার কল করা হলেও তার সাড়া পাওয়া যায়নি। আনারের পিএস আবদুর রউফ গত ৩১ জুলাই বলেছিলেন, আমরা কার কাছে যাব, কোথায় যাব, কী করব- এসব কিছু তদারকির জন্য ডিবির একটা প্রতিনিধি দলের যাওয়ার কথা ছিল। আমাদের জুলাই মাসেই যাওয়ার কথা ছিল। একে তো দেশের এই অবস্থা, তা ছাড়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ডিবির একজন প্রতিনিধির জিও করা লাগবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও আমরা জিওর বিষয়ে অনুরোধ করেছিলাম। সেটা এখনো হয়নি। ডিবি ডাকলেও আপনারা সাড়া দিচ্ছেন না- এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। উত্তরে তিনি বলেন, এ রকম বিষয় না। বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে কেউ। সাড়া না দেয়ার তো কিছু নেই।
ডিবি জানায়, ভারত থেকে গত ১৬ জুলাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার হয়ে ঝিনাইদহের এসপি বরাবর চিঠি যায়। চিঠির একটা অনুলিপি পাঠানো হয় ডিবি বরাবর। চিঠিতে ডিএনএ দেয়ার জন্য ডরিন, তার চাচা ও মাকে ভারতে যেতে বলা হয়েছে। তবে তারা সাড়া দেননি বলে অভিযোগ রয়েছে। আরেকটি সূত্র জানায়, ডরিনের বয়স ২৫ হতে এখনো কয়েক মাস বাকি। বাবার মৃত্যু হওয়ায় এলাকায় উপনির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, যার কারণে তারা কেউ ভারতে যেতে চাননি - এমন অভিযোগও রয়েছে। এরপর গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর পুরো সংসদই ভেঙে দেয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক গতকাল নয়া দিগন্তকে বলেন, এটি একটি আন্তঃদেশীয় অপরাধ। দুই বাংলায়ই তদন্ত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে দুই দেশ বা আলাদা আলাদা একটা সুপারভাইজিং কমিটি করা যেতে পারত। ডিএনএ স্যাম্পলিংয়ে পরিবার সাহায্য না করলে তদন্ত দীর্ঘমেয়াদি হবে। দীর্ঘমেয়াদি হলে আলামত নষ্ট হবে। আর তারা ভারতে ডিএনএ দিতে না গেলে তখন মানুষের মনে নানা প্রশ্ন জাগবে। শুধু একজন পুলিশ সদস্যকে দায়িত্ব দিলে তার পক্ষে এই মামলার কূলকিনারা খুঁজে বের করা কঠিন।
প্রসঙ্গত, গত ১২ মে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় এক বন্ধুর বাড়িতে ওঠেন তৎকালীন এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার। ১৮ মে তার পরিবারের সদস্যরা জানান, তারা আনারের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না। পরে ২২ মে ভারত ও বাংলাদেশের পুলিশ জানায়, এমপি আনারকে কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনের একটি ফ্ল্যাটে হত্যা করা হয়েছে। এই ঘটনায় ভারতে হয় হত্যা মামলা এবং বাংলাদেশে হয় অপহরণ মামলা। ভারত, বাংলাদেশ ও নেপাল মিলিয়ে মোট ৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়। বর্তমানে ভারতের কারাগারে দু’জন ও বাংলাদেশের কারাগারে সাতজন আসামি রয়েছেন। এই সাতজনের মধ্যে ছয়জন আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও দিয়েছেন।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা