এমন দেশ গড়তে চাই যেখানে জনগণই হবে সব ক্ষমতার মালিক
ঢাকা সেনানিবাসের অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা- বাসস
- ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০৫
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধারা বৈষম্যহীন, শোষণহীন, কল্যাণময় এবং মুক্ত বাতাসের যে স্বপ্ন নিয়ে রাষ্ট্রকে স্বাধীন করেছিলেন, আমি তাদের সেই স্বপ্ন পূরণে অঙ্গীকারাবদ্ধ। আমরা এখন থেকে বাংলাদেশকে এমনভাবে গড়তে চাই যেখানে সত্যিকার অর্থে জনগণই হবে সব ক্ষমতার মালিক। গতকাল বৃহস্পতিবার সশস্ত্রবাহিনী দিবস উপলক্ষে ঢাকা সেনানিবাসে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা এসব কথা বলেন।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে আমরা নতুন বাংলাদেশের সূচনা করেছি। এ নতুন দেশে আমাদের দায়িত্ব সব মানুষকে এক বৃহত্তর পরিবারের বন্ধনে আবদ্ধ করা। কেউ কারো ওপরে না, আবার কেউ কারো নিচেও না; এই ধারণা আমরা আমাদের জাতীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। বিশ্ব দরবারে মানবিক ও কল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে সমাদৃত বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে তিনি বলেন, ‘আমরা সকল দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখব। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির ভিত্তি হবে পারস্পরিক সম্মান, আস্থা, বিশ্বাস ও সহযোগিতা। জলবায়ু সঙ্কট মোকাবেলা এবং বৈশ্বিক শান্তি ও অর্থনীতি সুসংহতকরণে আমাদের একত্রে কাজ করতে হবে। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।’
মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ফলে পৃথিবীর মানচিত্রে বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা ও পরিচিতি লাভ করেছে। দেশ স্বাধীন করার মহান ব্রত নিয়ে ’৭১ এর ২৫ মার্চ কালরাত থেকে বাঙালি সেনারা সেনানিবাস ত্যাগ করে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েন। একই সাথে এই দেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র জনতা সাধারণ মানুষ সবাই যার যা কিছু আছে তাই নিয়েই যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি। পরবর্তীতে যা একটি জনযুদ্ধে রূপ নেয়। আমাদের মা বোনেরা মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থেকে প্রশিক্ষণ গ্রহণসহ বিভিন্নভাবে যুদ্ধে সহযোগিতা করেছেন।
সরকার প্রধান বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া সব বাহিনীকে ‘বাংলাদেশ ফোর্সেস’ নামে সাংগঠনিক রূপ দেয়া হয়। সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করে সশস্ত্রবাহিনীর নেতৃত্বে যুদ্ধ পরিচালিত হয়। মাত্র ২টি গান বোট ‘পদ্মা’ ও ‘পলাশ’ নিয়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী জলপথে যুদ্ধ শুরু করে। এ ছাড়াও পাকিস্তান নৌবাহিনীতে কর্মরত বাংলাদেশী সাবমেরিনার এবং নাবিকদের সমন্বয়ে গড়ে তোলা অকুতোভয় নৌকমান্ডো দল ‘অপারেশন জ্যাকপট’ নামক দুঃসাহসিক অভিযান পরিচালনা করে বিভিন্ন নদীবন্দরে খাদ্য ও রসদ বোঝাই শত্রু জাহাজ ডুবিয়ে দিতে সক্ষম হয়। প্রধান উপদেষ্টা আরো উল্লেখ করেন, বিমানবাহিনীর সদস্যদের সমন্বয়ে গঠিত ‘কিলো ফ্লাইট’ চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জের জ্বালানি ডিপোসহ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় সফল অভিযান পরিচালনা করে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ১৯৭১ সালের এই দিনে আমাদের সশস্ত্রবাহিনীর অকুতোভয় সদস্য এবং বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ সম্মিলিতভাবে দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সমন্বিত আক্রমণ সূচনা করে। সেই আক্রমণের ফলে আমাদের বিজয় ত্বরান্বিত হয় এবং ফলশ্রুতিতে আমরা স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ অর্জন করি। স্বাধীনতা যুদ্ধে শাহাদতবরণকারী বীর শহীদদের গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে তিনি বলেন, আমি আজ গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি স্বাধীনতা যুদ্ধে শাহাদতবরণকারী সব বীর শহীদদের এবং মহান আল্লাহর দরবারে আমি তাদের বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি। আমি সব শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্য এবং সম্মানিত যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাগণের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করছি। সশস্ত্রবাহিনী বিভাগের এই আয়োজনে আর্মি মাল্টিপারপাস কমপ্লেক্সে যেসব খেতাবপ্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের উত্তরাধিকারীগণ উপস্থিত আছেন তাদের জন্যও রইল আমার বিনীত শ্রদ্ধা। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বীর মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা চলমান রয়েছে। সময়ের আবর্তে অধিকাংশ বীর মুক্তিযোদ্ধা আজ বয়সের ভারে ভারাক্রান্ত। সশস্ত্রবাহিনী দিবস উদযাপনকালে দেশের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে থাকা বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মান জানানোর ক্ষেত্রে সশস্ত্রবাহিনী বিভাগ, সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী যে উদ্যোগ প্রতি বছর নিচ্ছে তা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। এ জন্য সশস্ত্রবাহিনীকে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। ড. ইউনূস বলেন, নতুন বাংলাদেশ গড়ার যে সুযোগ ছাত্র-জনতার সাহস ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে সম্প্রতি আমরা অর্জন করেছি, সেটাকে কাজে লাগিয়ে আমাদের সুন্দর ও সমৃদ্ধশালী ভবিষ্যৎ গড়তে হবে। বীর মুক্তিযোদ্ধা, শহীদ, আহত এবং জীবিত ছাত্র জনতার কাছে আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকতে চাই। যে সুযোগ তারা আমাদেরকে দিয়েছে তার মাধ্যমে আমাদের দেশকে পৃথিবীর সামনে একটি দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী দেশে পরিণত করতে আমরা শপথ নিয়েছি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং তাদের উত্তরাধিকারীদের কল্যাণার্থে যা কিছু প্রয়োজন তা করার জন্য আমরা দৃঢ়প্রত্যয়ী এবং এ ধারা অব্যাহত থাকবে।
এর আগে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস সশস্ত্রবাহিনী দিবস উপলক্ষে মহান মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী সব বীর শহীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। গতকাল সকাল ৮টা ৩০ মিনিটে ঢাকা সেনানিবাসে শিখা অনির্বাণের বেদিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে তিনি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং শহিদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। এ সময় সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর একটি চৌকস দল প্রধান উপদেষ্টাকে সালাম জানান। পরে তিনি সেখানে রাখা দর্শনার্থীদের বইয়েও স্বাক্ষর করেন। এর আগে শিখা অনির্বাণে পৌঁছলে তিন বাহিনীর প্রধানগণ এবং সশস্ত্রবাহিনী বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা অধ্যাপক ইউনূসকে স্বাগত জানান।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের এই দিনে সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনীর সমন্বয়ে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনী গঠিত হয় এবং তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ওপর সর্বাত্মক হামলা চালায়। স্বাধীনতার পর থেকে এই ঐতিহাসিক দিনটিকে প্রতি বছর সশস্ত্রবাহিনী দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
মিলনমেলা : সশস্ত্র বাহিনী দিবসের কর্মসূচির অংশ হিসেবে সেনাকুঞ্জে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, যাতে রাজনৈতিক নেতা, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, কূটনীতিক ও সাংবাদিকসহ বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার ব্যক্তিদের আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিকেল ৪টায় জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে সংবর্ধনা অনুষ্ঠান শুরু হয়। তারপর প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বক্তব্য দেন। এ সময় তিনি দীর্ঘদিনের অসুস্থতার পরও এই বিশেষ দিনে সবার সাথে শরিক হওয়ায় খালেদা জিয়াকে ধন্যবাদ জানিয়ে তার আশু রোগমুক্তি কামনা করেন। খালেদা জিয়ার বসার ব্যবস্থা হয়েছিল প্রধান উপদেষ্টার পাশের আসনে। বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতারা ছাড়াও অনুষ্ঠানে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান, গণফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ড. কামাল হোসেন, জেএসডির আ স ম আবদুর রবসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা অনুষ্ঠানে এসেছিলেন।
এ ছাড়া সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সশস্ত্র বাহিনীতে কর্মরত ও সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা সমবেত হয়েছিলেন। তাদের পরিবারের সদস্যদের সাথে নিয়ে অনুষ্ঠানটি এক মিলনমেলায় পরিণত হয়।
গাজীপুর জেলা প্রতিনিধি জানান, গাজীপুরের রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাসে যথাযথ মর্যাদায় উদযাপিত হয়েছে মহান সশস্ত্র বাহিনী দিবস। এ উপলক্ষে বৃহস্পতিবার বিকেলে বিপসট মাঠে আয়োজিত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিপসটের কমান্ড্যান্ট মেজর জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম।
অনুষ্ঠানে রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাসের স্টেশন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: মাহবুব করিম ও গাজীপুর জেলা প্রশাসক নাফিসা আরেফিনসহ বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তা ও গণ্যমান্য ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন।
কুমিল্লা প্রতিনিধি জানান, কুমিল্লা সেনানিবাসে সশস্ত্র বাহিনী দিবস উদযাপন করা হয়েছে। সেনানিবাসের মসজিদে দেশের কল্যাণ এবং সশস্ত্র বাহিনীর উত্তরোত্তর উন্নতি কামনায় বিশেষ মুনাজাতের মাধ্যমে দিবসটি শুরু হয়। এমআর চৌধুরী প্রাঙ্গণে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সেনাবাহিনীর বীর মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা ও সদস্যদের সম্মানে সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে ৮৪৭ জন মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে সংবর্ধনা দেয়া হয়।
বোয়ালমারী (ফরিদপুর) সংবাদদাতা জানান, যথাযথ মর্যাদা ও উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে ফরিদপুরের বোয়ালমারীতে ২১ নভেম্বর সশস্ত্র বাহিনী দিবস পালিত হয়েছে। দিবসটি উপলক্ষে র্যালি, আলোচনা সভা ও দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হয়। অবসরপ্রাপ্ত সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের অংশগ্রহণে একটি বর্ণাঢ্য র্যালি পৌর শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে বোয়ালমারী অডিটোরিয়াম হলরুমে আলোচনা সভায় মিলিত হয়। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পিএসসি, এমএসসি, এমবিএ-(আর) বীর মেজর আব্দুল্লাহ- আল ইমরান।
সিলেট ব্যুরো জানায়, সিলেটে নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সশস্ত্রবাহিনী দিবস উদযাপিত হয়েছে। এ উপলক্ষে দিনভর সিলেট সেনানিবাসে সমরাস্ত্র প্রদর্শনী, কেক কাটা ও মুক্তিযোদ্ধা সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে মুক্তিযোদ্ধা, তাদের পরিবারের সদস্যরা, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া যোদ্ধাদের পরিবারের সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
সিলেট সেনানিবাসে আগত অতিথিদের অভ্যর্থনা জানান সেনাবাহিনীর ১৭ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও সিলেট এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল আ স ম রিদওয়ানুর রহমান।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা