যুক্তরাষ্ট্রে প্রতারণার দায়ে আদানির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা
- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ২২ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০৫
যুক্তরাষ্ট্রে প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত ভারতীয় ধনকুবের, বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ ধনী আদানি গ্রুপের চেয়ারপারসন গৌতম আদানি ও তার ভাতিজা সাগর আদানির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে মার্কিন আদালত। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল আদালত তাদের বিরুদ্ধে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের ঘুষ প্রকল্পে জড়িত থাকার অভিযোগে অভিযুক্ত করেন। কৌঁসুলিরা এসব গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বিদেশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে হস্তান্তরের পরিকল্পনা করছেন। সাগর আদানি গ্রুপের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আদানি গ্রিনের পরিচালক। তা ছাড়া বর্তমানে তিনি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানটির ‘কৌশলগত ও আর্থিক বিষয়গুলো’ তদারকি করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় কৌঁসুলিরা বলেছেন, আসামিরা ভারতীয় কর্মকর্তাদের প্রায় ২৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার ঘুষ দিতে সম্মত হয়েছিলেন। বিনিময়ে তাদের ২০ বছরের মেয়াদে এমন কিছু প্রকল্পের কাজ দেওয়ার কথা ছিল, যেখান থেকে প্রায় ২০০ কোটি ডলার মুনাফা হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। তা ছাড়া এসব ঘুষের বিনিময়ে আদানি গ্রুপকে ভারতে সর্ববৃহৎ সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরির কাজ দিতেও সম্মত হয়েছিলেন অভিযুক্ত ভারতীয় কর্মকর্তারা।
যুক্তরাষ্ট্রের আদালতের এ রায়ের পরপরই মুম্বই শেয়ারবাজারে আদানির শেয়ার ধস নামে প্রায় ১০ বিলিয়ন ডলারের। আদানি গ্রুপের বিভিন্ন শেয়ার ৫ থেকে ২০ শতাংশ পর্যন্ত দরপতন হয়। বিশেষ করে আদানি এন্টারপ্রাইজেস, আদানি গ্রিন এনার্জি ও আদানি পাওয়ারের শেয়ারগুলো বড় ধরনের পতনের মুখোমুখি হয়। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী আদানিকে গ্রেপ্তারের দাবি জানিয়ে বলেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি আদানিকে সুরক্ষা দিচ্ছেন।
আদানির অভিযুক্ত হওয়ার খবরটি আন্তর্জাতিক ও ভারতীয় মিডিয়াগুলো গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করেছে। সিএনএন, বিবিসি, আলজাজিরা শিরোনাম করে ‘প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত আদানি’। মার্কিন প্রসিকিউটররা বলছেন যে, আদানির পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি সংস্থাটি মিথ্যা এবং বিভ্রান্তিকর তথ্যের ভিত্তিতে এই সময়ের মধ্যে ৩ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি ঋণ এবং বন্ড সংগ্রহ করেছে। বুধবার নিউ ইয়র্কের আদালতে তার বিরুদ্ধে এ বিষয়ে ফৌজদারি মামলা করে মার্কিন বিচার বিভাগ। ৬২ বছর বয়সী আদানি ভারত তথা বিশ্বের শীর্ষ ধনীদের একজন। হীরার ব্যবসা দিয়ে শুরু করার পর তার ব্যাবসায়িক সাম্রাজ্য বন্দর, বিমানবন্দর থেকে পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি পর্যন্ত বিস্তৃত। অভিযোগ পত্রে প্রসিকিউটররা বলেছেন যে, ভারতীয় এই টাইকুন এবং তার অন্যান্য উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা তার জ্বালানি প্রতিষ্ঠানের জন্য চুক্তি নিশ্চিত করতে ভারতীয় কর্মকর্তাদের অর্থপ্রদানে সম্মত হয়েছেন যা ২০ বছরে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি লভ্যাংশ আয় করতে পারে। তবে আদানির পক্ষ থেকে এ অভিযোগ অস্বীকার করা হয়েছে। এর আগেও যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে ব্যবসার জন্য ঘুষ দেওয়ার অভিযোগ আদানি অস্বীকার করে আসছিলেন। এই ঘুষের তদন্তের রিপোর্ট কয়েক মাস ধরেই ঘুরছে।
আদানির বিরুদ্ধে ঘুষ প্রদানের অভিযোগ মার্কিন মুল্লুক পর্যন্ত গড়িয়েছে কারণ প্রসিকিউটররা বলছেন তারা যুক্তরাষ্ট্রের বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে তহবিল সংগ্রহের চেষ্টা করেছিল। অন্য পাঁচ ব্যক্তিকে সংশ্লিষ্ট অপরাধমূলক ষড়যন্ত্রের অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়। এরা হলেন অন্য একটি পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি কোম্পানির দুই নির্বাহী এবং একজন কানাডিয়ান প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীর তিনজন কর্মচারি।
প্রসিকিউটররা বলেছেন যে, আদানির প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ২০২২ সালে তদন্তে নামে যুক্তরাষ্ট্র। তবে বেশ কয়েকবার বাধা প্রাপ্ত হওয়ায় তাদের তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ করতে দেরি হয়। তদন্তকারীরা বলেছেন, প্রতিষ্ঠানটি সরাসরি ঘুষ গ্রহণের সঙ্গে জড়িত এবং নীতি সম্পর্কিত মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রকাশ করেছে। মার্কিন অ্যাটর্নি ব্রিয়ান পিস বলেছেন, অভিযুক্তরা বিলিয়ন ডলার মূল্যের চুক্তি সুরক্ষিত করতে ভারতীয় সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ দেওয়ার জন্য একটি বৃহৎ স্কিম সাজিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে মূলধন সংগ্রহ করার জন্য ঘুষের পরিকল্পনা সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিল আদানির গ্রুপ। যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতা পালাবদলের দুই সপ্তাহ পরেই আদানির বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ দায়ের করল মার্কিন প্রসিকিউটররা। প্রেসিডেন্ট-নির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ে তাকে অভিনন্দন জানিয়ে সোশাল মিডিয়াতে পোস্ট করেছিলেন গৌতম আদানি। যুক্তরাষ্ট্রে ১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগেরও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আদানি।
বাজারের প্রতিক্রিয়া : আদানির বিরুদ্ধে ঘুষ কেলেঙ্কারির মামলার পর ভারতীয় শেয়ারবাজারে ব্যাপক দরপতন হয়েছে। বুধবার (২০ নভেম্বর) অভিযোগ দাখিল করার পর একদিনে আদানি গ্রুপ ১ হাজার ২৩০ কোটি ডলারের বাজার মূলধন হারিয়েছে। আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থা হারানো ও আইনি ঝুঁকিকে পতনের প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। আদানি গ্রুপের ডলার বন্ডের দামও রেকর্ড ১৫ সেন্ট পর্যন্ত কমেছে। বাজার পর্যবেক্ষকদের মতে, এই সংকট আদানি গ্রুপের বৈশ্বিক অবস্থানে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। মামলা সম্পর্কে কোম্পানির পক্ষ থেকে এখনো কোনো মন্তব্য করা হয়নি। এই মুহূর্তে বিনিয়োগকারীদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং এজেন্সিগুলো ইতোমধ্যে আদানি গ্রুপের বেশ কিছু কোম্পানির রেটিং নি¤œগামী করার সতর্কতা দিয়েছে। তবে আদানি গ্রুপ এর আগে তাদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করেছে এবং বলেছে, তারা সব ধরনের নিয়ম মেনে ব্যবসা পরিচালনা করছে। গ্রুপের এক বিবৃতিতে বলা হয়, ‘আমাদের আর্থিক লেনদেন এবং করপোরেট গভর্ন্যান্সের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের অনিয়ম হয়নি। আমরা সব আইনি প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণ করব যে আমরা নির্দোষ।’
মার্কিনভিত্তিক সংস্থা হিন্ডেনবার্গ রিসার্চ আদানি গ্রুপের বিরুদ্ধে গত জানুয়ারিতে আর্থিক প্রতারণার অভিযোগ তোলে। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, আদানি গ্রুপ বহু বছর ধরে শেয়ারদরের কৃত্রিম বৃদ্ধি এবং আর্থিক লেনদেনে অনিয়ম করেছে। এরপর ভারতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ বোর্ড অব ইন্ডিয়া (সেবি) বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করে।
বিনিয়োগকারীদের উদ্বেগ : আদানি গ্রুপের শেয়ারের দরপতনের কারণে স্থানীয় ও বৈশ্বিক বিনিয়োগকারীদের মধ্যে নতুন করে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। ভারতীয় বাজারে এ ঘটনা শুধু আদানি গ্রুপ নয়, বরং পুরো শেয়ারবাজারকেই প্রভাবিত করছে। আদানি গ্রুপের সঙ্গে জড়িত ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতেও ঝুঁকি বেড়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের অভিযোগ দীর্ঘ মেয়াদে আদানি গ্রুপের ব্র্যান্ড এবং বিনিয়োগকারীদের আস্থার ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এর ফলে তারা বড় প্রকল্পের জন্য তহবিল সংগ্রহে সমস্যায় পড়তে পারে।
রাজনৈতিক হট্টগোল : কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী আদানির অভিযুক্ত হওয়ার বিষয়টি নিয়ে সাংবাদ সম্মেলন করে বলেন, ‘এটা এখন বেশ স্পষ্ট যে আদানি আমেরিকান আইন এবং ভারতীয় আইন উভয়ই ভঙ্গ করেছেন। তাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিযুক্ত করা হয়েছে এবং আমি ভাবছি কেন মিস্টার আদানিকে এখনও এই দেশে মুক্ত রাখা হয়েছে? আজই আদানিকে গ্রেফতার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা উচিত। কিন্তু আদানিজিকে গ্রেফতার করার ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর নেই। কারণ তাকে তো চালান আদানিই।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা