২১ নভেম্বর ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

আর্থিক গোয়েন্দা জালে ৩৪৩ প্রভাবশালী

-

- ৩ মাসে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকার ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ
- বিশেষ তদারকিতে ২০ প্রতিষ্ঠান
- দুদকে ও সিআইডিতে ২২৫ তদন্ত রিপোর্ট

বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের জালে আটকা পড়েছে দেশের আর্থিক খাতের ৩৪৩ প্রভাবশালী। এর মধ্যে রয়েছেন সাইফুল আলম মাসুদ ওরফে এস আলম, বেক্সিমকো গ্রুপ, নজরুল ইসলাম মজুমদারের নাসা গ্রুপ, সামিট গ্রুপসহ ৩৪৩ প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী-এমপি, আমলা ও ব্যবসায়ী। গত তিন মাসে (আগস্ট-অক্টোবর) তাদের অ্যাকাউন্টগুলো জব্দ করা হয়েছে। এসব অ্যাকাউন্টে পাওয়া গেছে সাড়ে ১৪ হাজার কোটি টাকা। অধিকতর তদন্ত করে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার জন্য এ সময়ে আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট থেকে ২২৫টি তদন্ত প্রতিবেদন দুদক ও সিআইডিতে পাঠানো হয়েছে। সংস্থাটি ২০টি বড় গ্রুপের বিদেশ তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি করেছে। চূড়ান্তভাবে এস আলম ও সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান জাভেদের দেশে-বিদেশে থাকা সম্পদ জব্দ করে ব্যাংকের অর্থ সমন্বয়ের জন্য বলা হয়েছে। বাকিদের বিষয়েও কাজ চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের এক দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্যে জানিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মুখে আওয়ামী দুঃশাসনের অবসান হয়েছে গত ৫ আগস্ট। এ সময় পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনা। কিন্তু রেখে গেছেন মহাদুর্নীতির ভয়াবহ ক্ষত। যে ব্যাংকেই হাত দেয়া হচ্ছে, বড় বড় দুর্নীতির চিত্র বের হয়ে আসছে। বিশেষ করে স্বৈরাচার শেখ হাসিনার অর্থের প্রধান যোগানদাতা এস আলম, নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদার, বেক্সিমকোর সালমান এফ রহমান, সামিটের আজিজ খান গংসহ বিভিন্ন ব্যবসায়ী গ্রুপের দুর্নীতির প্রমাণ প্রকাশ পাচ্ছে। দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণের নামে বের করে বিদেশে পাচার করার সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংকের আর্থিক গোয়েন্দ ইউনিটসহ বিভিন্ন সংস্থা। শুধু এস আলম চার ব্যাংক থেকেই ঋণের নামে বের করে নিয়েছে দেড় লাখ কোটি টাকা। এস আলমের চূড়ান্ত হিসাব এখনো সম্পন্ন হয়নি। বেক্সিমকো গ্রুপ দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে নামে বেনামে বের করেছে প্রায় ৬০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে পতিত সরকারের শেষ তিন বছরে আইএফআইসি থেকে বের করে নিয়েছে ১৪ হাজার কোটি টাকার ওপরে। নাসা গ্রুপ এক্সিম ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংকসহ বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বের করে নিয়েছে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। তাদের বিরুদ্ধে তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।

দেশের ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণের নামে কি পরিমাণ অর্থ বের করে নিয়েছে তা ৫ আগস্টের পরই তদন্তে নেমেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নানা প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট তদন্ত কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর দায়িত্ব নেয়ার দিনই সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, টাকা পাচারকারীদের কোনোভাবেই শান্তিতে থাকতে দেয়া হবে না। পৃথিবীর যে দেশেই টাকা পাচার করুক না কেন আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার ব্যবস্থা নেয়া হবে। এর পর থেকেই বাংলাদেশের আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট নড়েচড়ে বসে। বিএফআইইউ থেকে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের একটি অংশ বের করে দেয়া হয়েছে। এর পর থেকেই বিএফআইইউ এ কাজের গতি ফিরেছে। যদিও এখন বেশ কিছু কঠোর আওয়ামী লীগ সমর্থিত কর্মকর্তা রয়েছেন যাদের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে প্রশ্ন রয়েছে।

৫ আগস্টের পর বিএফআইইউ থেকে সাবেক মন্ত্রী-এমপি, গুরুত্বপূর্ণ সংস্থার শীর্ষ পদে থাকা ব্যক্তিদের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। সন্দেহজনক লেনদেন ও বিদেশে অর্থপাচারের অভিযোগে প্রতিদিনই শতাধিক ব্যাংক হিসাব জব্দ করছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। তবে ৫ আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বিএফথআইইউ, এনবিআর এবং দুদক যৌথ প্রচেষ্টায় ৩৪৩ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করেছে। তাদের অ্যাকাউন্টে ১৪ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাওয়া গেছে।
বিএফআইইউ সূত্রে জানা যায়, ইতোমধ্যে ২২৫টি তদন্ত রিপোর্ট সিআইডি এবং দুদকে পাঠানো হয়েছে। এরমধ্যে ২০ কেসের অডিট রিপোর্ট সম্পন্ন হয়েছে। সবাই বিগত সরকারের আমলে অবৈধ সুবিধা নেয়া ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান। শিগগিরই বাকিগুলোর অডিট সম্পন্ন করে প্রতিবেদন দুদক ও সিআইডিতে পাঠানো হবে বলে নিশ্চিত করেছে বিএফআইইউর এক কর্মকর্তা।

সূত্র আরো জানায়, আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা জোট এগমন্টের সাথে যুক্ত ১৭৭টি দেশ ছাড়াও একাধিক দেশের সাথে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি রয়েছে বিএফআইইউর। বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া সম্ভাব্য সব দেশে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আন্তর্জাতিক সহায়তায় পাচার হওয়া অর্থ ফেরতে সব রকম প্রচেষ্টা চালাচ্ছে সরকার।
পাচারের টাকা ফেরাতে প্রধান উপদেষ্টা ও অর্থ উপদেষ্টা কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সাথে বৈঠকের সময় পাচার হওয়া অর্থ ফেরাতে সহায়তা চেয়েছেন তারা। এ ছাড়া বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ) বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের নামে অর্থসম্পদ সম্পর্কে জানতে বিভিন্ন দেশে চিঠি দেয়া শুরু করেছে। সিআইডি, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), কাস্টমস, পরিবেশ অধিদফতর, বিএসইসি ও দুদক অর্থপাচার প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে কাজ করছে।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, যারা ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে পাচার করেছে তাদের সম্পদ দেশে ফেরত আনার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা উচিত। যেহেতু আমাদের দেশ থেকে পাচারের টাকা ফেরত নিয়ে যাওয়ার উদাহরণ আছে সুতরাং আমরা পারব না কেন? এগমন্টের দেশগুলো, যাদে সাথে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি আছে, নতুন চুক্তি সম্পাদন করে ও ইন্টারপোলের সাহায্যে এসব সম্পদ দেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার জন্য একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। তাদের হাত ধরে পাচার হওয়া অর্থ দেশে ফিরে আসুক সে বিষয়ে দৃঢ়প্রত্যাশা রাখি।

 


আরো সংবাদ



premium cement