মানবসম্পদ উন্নয়নে কাঠামোগত সংস্কার ও জাতীয় উদ্যোগ জরুরি
- রাশিদুল ইসলাম
- ২০ নভেম্বর ২০২৪, ০৩:৪৪
দেশের শ্রম, জনশক্তি ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় যেভাবে কাজ করছে তা সার্বিকভাবে মানবসম্পদ উন্নয়নে যুগোপযোগী সঠিক চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। এর ফলে দেশে এবং বিদেশে বাংলাদেশের জনশক্তিকে দক্ষভাবে ব্যবহার করা সম্ভব হচ্ছে না। এ খাত থেকে কাক্সিক্ষত আয় যেমন আসছে না তেমনি বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে বলে মনে করেন মানবসম্পদ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ ড. মুহাম্মদ শামসুদ্দীন। দীর্ঘদিন তিনি মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও ইউরোপে কাজ করে আসছেন। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর হয়ে মানবসম্পদ উন্নয়ন ব্যবস্থাপনায় তিনি কাজ করেছেন জর্ডান, ইরাক, মিসর, অ্যাঙ্গোলা, মোজাম্বিক, সোমালিয়া, সোমালিল্যান্ড ও লাইবেরিয়ায়। কাজ করেছেন সৌদি আরবের আরামকোতেও। ছুটিতে দেশে এসেছেন তিনি। নয়া দিগন্তকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. মুহাম্মদ শামসুদ্দীন বলেন, মানবসম্পদ উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা এখনো নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি। প্রশ্ন: কিন্তু সরকারি ও বেসরকারিভাবে তো অনেক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তাদের প্রশিক্ষণের পাশাপাশি দেশের পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট রয়েছে। তাহলে ঘাটতি কোথায়? ড. শামসুদ্দীন: হ্যাঁ, প্রশিক্ষণের পর এই শ্রমশক্তিকে কাঠামোগত ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে মানবসম্পদ উন্নয়ন ব্যবস্থাপনায় যুক্ত করা যাচ্ছে না। এতে দক্ষ শ্রমিক তৈরিতে অনেক পিছিয়ে আছে দেশ। আধা দক্ষ শ্রমিক দিয়ে চাহিদার সর্বোচ্চ পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিভিন্ন দেশে চাহিদামতো আমরা শ্রমশক্তি রফতানি করতে পারছি না।
এতে আমাদের ব্যয় হচ্ছে ঠিকই কিন্তু রেমিট্যান্স আসছে অন্য দেশের শ্রমশক্তির তুলনায় অনেক কম। কারণ তারা বিভিন্ন দেশের চাহিদা অনুযায়ী শ্রমশক্তিকে দক্ষ করে গড়ে তুলে তা রফতানি করছে। এতে একই খরচ ও সংখ্যার দিক থেকে বিচার করলে তাদের রেমিট্যান্স বাংলাদেশের তুলনায় অনেক বেশি আসছে। প্রশ্ন: প্রশিক্ষণের পর তো তারা ইন্টারভিউ দিয়ে যোগ্যতা প্রমাণ করেই বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে। ব্যাংক, বীমা, শিল্পকারখানাগুলো তো চলছে। ড. শামসুদ্দীন: বিভিন্ন দেশের তুলনায় আমাদের ব্যাংক, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও শিল্পকারখানাগুলোতে দেখবেন অনেক বেশি মানুষ কাজ করছে। বিদেশে একই ধরনের প্রতিষ্ঠানে এত বেশি মানুষ কাজ করছে না। সেখানে দেখবেন শ্রমশক্তিকে এত চমৎকারভাবে দক্ষ করে গড়ে তোলা হয়েছে যে একজন লোক বহুমুখী কাজের জোগান দিচ্ছে। বিদেশে এ ধরনের জনশক্তি অন্য দেশ থেকে গিয়ে বহুমুখী দক্ষতার কারণেই আমাদের শ্রমশক্তির চেয়ে বেশি আয় করছে। আবার প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বেশি লোক কাজ করায় শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। লোক গিজগিজ করছে, কাজের চেয়ে কথা বেশি হচ্ছে, কাজের শৃঙ্খলা থাকছে না। আবার কোনো প্রতিষ্ঠানে দেখবেন চাহিদা অনুযায়ী লোকই নেই। প্লাদারের জায়গায় হয়তো প্রকৌশলী কাজ করছে।
প্রশ্ন: মানবসম্পদ উন্নয়ন ব্যবস্থাপনার কাজ কিভাবে শুরু করা যায়? ড. শামসুদ্দীন: দক্ষ, আধাদক্ষ ও অদক্ষ সব ধরনের মানবসম্পদ উন্নয়নে জাতীয় উদ্যোগ নেয়া জরুরি। অবিলম্বে এ খাতে সংস্কারের জন্যে একটি জাতীয় কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। এ কমিটিতে বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা থাকবেন। এ ধরনের কমিটি ছয় মাসের মধ্যে মানবসম্পদ উন্নয়নে কাঠামোগত বিন্যাসের সাথে সাথে দিকনির্দেশনা দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রশিক্ষণের বিষয়টি নিশ্চিত করে দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়নে ভূমিকা রাখবে। এতে অর্থ ও লোকবলের অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে। বিদেশে একই শিক্ষাগত যোগ্যতার বাংলাদেশী শ্রমিক গিয়ে দক্ষতার অভাবে নিম্নমানের কাজ যেমন চা বানানো, গাড়ি ধোয়া বা ঘর মোছার কাজ করে অন্য দেশের নার্সের চেয়ে ১০ গুণ কম আয় করে হতাশ হয়ে পড়বে না। তার সময় ও অর্থের অপচয় রোধ করা সম্ভব হবে। প্রশ্ন: মানবসম্পদ উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা আনতে পারলে শ্রমশক্তি কিভাবে উপকৃত হতে পারে? ড. শামসুদ্দীন: সার্বিকভাবে প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ না থাকায় শ্রমশক্তির অন্তত ৩২ থেকে ৪০ শতাংশ অপচয় হচ্ছে। কারণ প্রয়োজনের তুলনায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত না হওয়ায় এরা চাহিদা অনুযায়ী কাজের সুযোগ পাচ্ছে না। অথচ চাহিদা থাকায় অন্য দেশের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মানবসম্পদ আমাদের শ্রমশক্তিকে অনায়াসে যোগ্যতার বিবেচনায় পরাস্ত করে কাজের সুযোগ করে নিচ্ছে। একই সাথে আমাদের শ্রমশক্তির ঠিকমতো দক্ষতা দেখাতে পারছে না। তাদের কোনো 'জব ডেসক্রিপশন' নেই। শ্রমশক্তি এ ধরনের ভারসাম্যহীন কাঠামোগত পরিস্থিতি অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়ক হয়ে উঠতে পারছে না। আমাদের শ্রমশক্তিকে ভারসাম্যপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে কাউন্সেলিং প্রয়োজন। তাদের ক্যারিয়ার অ্যাডভাইস দেয়া দরকার। প্রযুক্তির প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ও উন্নয়ন ছাড়াও বিশ্বের শ্রমশক্তি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করতে শুরু করছে অথচ আমরা আমাদের জনশক্তিকে সঠিকভাবে প্রশিক্ষণ ও বহুবিধ ব্যবহারে কাজে লাগাতে না পেরে মানবসম্পদের অপচয় করছি। কর্মসংস্থানের সুযোগ পূরণে তাদের দুর্বলতা থেকে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের সামনে যদি আধুনিক মেথাডোলজি থাকত কিংবা ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করতে তারা বাধ্য হতো তাহলে এই শ্রমশক্তিকে সুশৃঙ্খলভাবে গড়ে তুলে বাজারে কর্মসংস্থানে চাহিদাকে প্রতিযোগিতার সাথেই দেশে ও বিদেশে পূরণ করা সম্ভব হতো। তাদের ও জাতীয় আয় কয়েক ধাপ বেড়ে যেত। রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধি ঘটত সহজেই।
প্রশ্ন: শ্রমিকদের মধ্যে একধরনের অসন্তোষ বিরাজ করে। এটা কিভাবে দূর করা সম্ভব? ড. শামসুদ্দীন: প্রচলিত পদ্ধতি চলতে থাকলে শ্রমশক্তি কখনো দায়িত্বশীল হয়ে উঠতে পারবে না। এ শ্রমশক্তিকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো সম্ভব হচ্ছে না আবার ফি বছর নতুন যে শ্রমশক্তি বাজারে প্রবেশ করছে তাতে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হচ্ছে। তারা তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী বা সামর্থ অনুসারে পুরোপুরি দক্ষভাবে কাজের জোগান দিতে পারছে না। এতে তাদের ও জাতীয় জীবনে একধরনের হতাশা বিরাজ করছে। তাদের দক্ষতার ভীষণ অপচয় হচ্ছে। বিভিন্ন দেশে মানবসম্পদ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে ড. শামসুদ্দীন বলেন, আমাদের জমির পরিমাণ কম, ধনী দেশ নয়, সম্পদের পরিমাণ সীমিত অথচ ঘনবসতির দেশ হিসেবে সঠিকভাবে মানবসম্পদ উন্নয়ন ব্যবস্থাপনা করতে না পারায় শ্রমবাজারে সার্বিকভাবে এক নৈরাজ্যকর ও অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। হঠাৎ করে শ্রমিকরা রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ, বিক্ষোভ ও সংঘর্ষে জড়াচ্ছে। পরিকল্পিতভাবে তাদের মানবসম্পদে রূপান্তর করতে পারলে কখনো তারা কাজ বাদ দিয়ে রাস্তায় নেমে আসত না।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা