২০ নভেম্বর ২০২৪, ৫ অগ্রহায়ন ১৪৩০, ১৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

বাতিল কারিকুলামে ৮২৮ কোটি টাকার নিষ্ফল প্রশিক্ষণ

-

২০২২ সালের পুরো কারিকুলামই ছিল বিতর্কিত। অথচ এই কারিকুলাম বাস্তবায়নে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার বাজেটের অনুমোদন দিয়েছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকার। দুই বছরের ব্যবধানে জেলা-উপজেলা পর্যায়ে বিষয়ভিত্তিক প্রায় সাড়ে ৬ লাখ শিক্ষক প্রশিক্ষণও নিয়েছেন। বিতর্কিত এই কারিকুলাম বাতিল হওয়ায় শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এখন কোনো কাজে আসছে না। যদিও প্রশিক্ষণ খাতে ইতোমধ্যে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে ব্যয় হয়ে গেছে ৮২৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। আর শিক্ষকদের এই প্রশিক্ষণ কার্যক্রমটি পরিচালিত হয়েছে ডিসেমিনেশন অব নিউ কারিকুলাম স্কিমের (ডিএনসিএস) আওতায়।
সূত্রমতে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকার শিক্ষা কারিকুলামে ভিনদেশী এজেন্ডা বাস্তবায়নের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের লক্ষ্য নিয়েই ২০২২ সাল থেকে বিতর্কিত কারিকুলাম চাপিয়ে দিয়েছিল। তারা প্রাথমিক থেকে শুরু করে মাধ্যমিক এবং উচ্চ শিক্ষার সব পর্যায়ে ধাপে ধাপে জাতিবিনাশী বিজাতীয় ভাবধারার কারিকুলাম বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিল। কিন্তু প্রথম থেকেই এই ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্তের বিরুদ্ধে এ দেশের সচেতন অভিভাবক ও শিক্ষকরা প্রতিবাদ শুরু করেন। তার পরও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কিছু অসাধু কর্মকর্তা এনজিওদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে যারপরনাই তৎপরতা শুরু করে। অনেকে আবার চাকরি-পরবর্তী অবসরে বিশেষ সুবিধায় এনজিওতে পরামর্শক হওয়ার লোভনীয় প্রস্তাবে রাজি হয়ে বিতর্কিত কারিকুলাম বাস্তবায়নে একজোট হয়ে কাজ করেন।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার আওয়ামী লীগের বিতর্কিত সেই কারিকুলাম বাতিল করে ২০২৫ সাল থেকেই পূর্বের ২০১২ সালের কারিকুলামে ফিরে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বাতিল কারিকুলামের উপরে শিক্ষকরা বিশাল বাজেটের অর্থ ব্যয় করে যে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন তা এখন নিষ্ফলে পরিণত হয়েছে। সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, শিক্ষক প্রশিক্ষণে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে এই স্কিমে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৬৫০ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রথম কিস্তিতে ১৬২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু কার্যক্রম বন্ধ থাকায় গত পাঁচ মাসে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৩০ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রশিক্ষণ খাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৭৮৫ কোটি ৭৮ লাখ টাকা, ব্যয় হয়েছিল ৫৭৩ কোটি ৭৭ লাখ টাকা । অর্থাৎ খরচের শতকরা হার ছিল ৭৩.০২ শতাংশ। প্রথম বছরে অর্থাৎ ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৩৬৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। ঐ বছর ব্যয় হয়েছিল ২৫৪ কোটি ২৭ লাখ টাকা। এখানে শতকরা হিসাবে ব্যয় হয়েছিল ৬৯.৭২ শতাংশ। সব মিলিয়ে নতুন কারিকুলামের উপর শিক্ষক প্রশিক্ষণের জন্য মোট বাজেট বরাদ্দ ছিল ১৮৫৫ কোটি ৮২ লাখ টাকা। এর মধ্যে ব্যয় করা হয়েছে ৮২৮ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ মোট খরচের শতকরা হার ছিল ৪৪.৬৩ শতাংশ।
শিক্ষার মান উন্নয়নের অপরিহার্য বিষয় হচ্ছে শিক্ষক প্রশিক্ষণ। যেকোনো স্তরের শিক্ষকদের কার্যকর প্রশিক্ষণ শিক্ষার্থীদের ধারাবাহিক মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কিন্তু বিতর্কিত কারিকুলাম বাতিল হওয়ার কারণে ডিএনসিএসের কার্যক্রমও বন্ধ রয়েছে। স্কিম সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কারিকুলাম একটি প্রবহমান বিষয়। সবসময় এর সংশোধন ও পরিমার্জন প্রয়োজন। তাই সংশোধিত ও পরিমার্জিত কারিকুলামকে এই স্কিমের মাধ্যমে কিভাবে সমন্বয় করা যায় সেসব বিষয়ে পরিকল্পনা করা দরকার।

এ বিষয়ে ডিএনসিএস’র পরিচালক প্রফেসর সৈয়দ মাহফুজ আলী নয়া দিগন্তকে জানান, কারিকুলাম বাতিল হলেও শিক্ষকদের বেসিক প্রশিক্ষণ চালু রাখা জরুরি। কেননা বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যয়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) এর মাধ্যমে ইতোমধ্যে প্রায় লক্ষাধিক শিক্ষক নিয়োগ পেয়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত এসব শিক্ষক ২০১২ কারিকুলামে অনুসরণকৃত ‘পেডাগোজি’ প্রশিক্ষণ পাননি। স্কিমের মাধ্যমে এসব শিক্ষককে প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে।
তিনি আরও বলেন, ২০১২ সালের কারিকুলাম অনুযায়ী এসএসসির সিলেবাস বিভাগভিত্তিক দুই বছরের। কিন্তু চলতি বছরের নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থীরা পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের গৃহীত নতুন কারিকুলামে ইতোমধ্যে এক বছরের পড়া শেষ করে বার্ষিক পরীক্ষায় অংশ নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এসব শিক্ষার্থী ২০২৫ শিক্ষাবর্ষে দশম শ্রেণীতে উন্নীত হবে। এখন আবার দশম শ্রেণীর এসব শিক্ষার্থীকে বিভাগভিত্তিক দুই বছরের পড়া এক বছরে শেষ করতে হবে। তাই দুই বছরের পাঠ্যসূচি থেকে এসব শিক্ষার্থীর জন্য বিষয়ভিত্তিক মূল ( বেসিক) পাঠ্যসূচি নিরূপণ করে এক বছরের মধ্যে সম্পাদনযোগ্য সিলেবাস তৈরি করতে হবে। তারপর এই সংক্ষিপ্ত সিলেবাস শ্রেণিকক্ষে বাস্তবায়নের জন্য শিক্ষকদের যথাযথ শিখন-শেখানো কার্যাবলি অনুসরণ করা উচিত। স্কিমের মাধ্যমে শিক্ষকদেরও এই প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এর ফলে স্কিমের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গতিশীল হওয়ার পাশাপাশি বিরাটসংখ্যক শিক্ষকের মূল ( বেসিক) প্রশিক্ষণও সম্পাদন করা সম্ভব হবে।
গত দুই বছরে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকদের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ২০২২ সাল থেকে শুরু হওয়া এ স্কিমে ক্রমপুঞ্জিত (সংশোধিত স্কিম অনুসারে) অর্থ বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে জেলা-উপজেলা পর্যায়ের প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, বিষয়ভিত্তিক শ্রেণী শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ, প্রতিষ্ঠান প্রধানদের প্রশিক্ষণ, মাঠপর্যায়ের শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্মর্তাদের প্রশিক্ষণ, অষ্টম-নবম শ্রেণীতে নতুন কারিকুলাম বিস্তরণ বিষয়ে শিক্ষক প্রশিক্ষণ, শিক্ষাসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কারিকুলাম বিস্তরণ, মনিটরিং এবং মেন্টরিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ, ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রোগ্রামিং ও নেটওয়ার্কিং বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। যেহেতু শিক্ষকরা ২০২২ সালের কারিকুলামের উপরেই এই প্রশিক্ষণ নিয়েছেন কাজেই তাদের প্রশিক্ষণ এখন আর কাজে আসবে না।


আরো সংবাদ



premium cement