১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পে চলছে লুটপাট
- মনির হোসেন
- ১৮ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০
বাংলাদেশ সরকারের (জিওবি) অর্থায়নে ও শরীয়তপুর সড়ক বিভাগের এডিপিভুক্ত শরীয়তপুর-জাজিরা-নাওডোবা (পদ্মা সেতু সংযোগ) মেগা উন্নয়ন প্রকল্পের অবস্থা অনেকটা বেহাল। ইতোমধ্যে এই প্রকল্পের নানা কাজে শত শত কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নতির লক্ষ্য ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এ মেগা প্রকল্পের কাজ ২০২০ সালে শুরু হলেও এখনো তা শেষ হয়নি। ফলে এটি স্থানীয়দের কাছে এখন আতঙ্কের সড়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ সড়ক ব্যবহারকারী ছোট-বড় যানবাহনের চালক এবং স্থানীয় বাসিন্দারা প্রতিনিয়ত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছেন। কখন কোন স্থানে কোন গাড়ি উল্টে যায় এমন আতঙ্ক নিয়েই তাদের চলতে হচ্ছে।
অভিযোগ রয়েছে, মেগা প্রকল্পের সাথে সংশ্লিষ্টরা আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক এমপি মন্ত্রী, সচিব থেকে শুরু করে সড়ক ও সেতু ভবন সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী, ঠিকাদার এবং শরীয়তপুর জেলা প্রসাশনের কিছু দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারী মেগা লুটপাট করে কোটি কোটি টাকা কমিশন কামিয়ে নিয়েছেন।
চলতি বছরের অক্টোবর মাসের হিসাব ও স্থানীয়দের মতে, মেগা প্রকল্পের কাজ এখন পর্যন্ত ৫০ শতাংশ শেষ হয়েছে। তবে গোপালগঞ্জ জোনের শরীয়তপুর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) শেখ নাবিল হোসেন দাবি করছেন, সড়কের জমি অধিগ্রহণ ও ঠিকাদারদের বালু ফেলার সাপ্লাই দেয়া নিয়ে ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাসংক্রান্ত কিছু জটিলতা থাকলেও ২০২৬ সালের নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই এই প্রকল্পের কাজ শেষ হবে।
গতকাল রোববার শরীয়তপুর সদর এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ তুষার ‘শরীয়তপুর-জাজিরা-নাওডোবা (পদ্মা সেতু সংযোগ) সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের’ বর্তমান ভঙাচোরা রাস্তার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে নয়া দিগন্তকে বলেন, আমি প্রতি সপ্তাহে দেশে যাই। এবার দেখলাম এখনো কিছু জায়গায় কাজ চলছে, বালু ফেলা হয়েছে। ঢাকা থেকে যাওয়ার সময় এক রাস্তা ব্যবহার করতে হয়। ফেরার সময় প্রকল্পের সড়ক দিয়ে আসা যায়।
তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এক লেনের রাস্তা দিয়ে চলাচল করা যায় না। বেশির ভাগ রাস্তার অবস্থা বেহাল, ভাঙাচোরা। গাড়ি কাত হয়ে পড়ে। একবার আমার শ্বশুরকে নিয়ে গিয়েছিলাম। পরিস্থিতি এতটাই খারাপ যে, দোয়া দরুদ পড়ে আমাদের এই রাস্তা অতিক্রম করতে হয়। এই বুঝি গাড়ি উল্টে যায় যায় অবস্থা। এভাবেই শরীয়তপুর-জাজিরা এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দাকে চলতে হচ্ছে।
তিনি আরো বলেন, এই মেগা প্রকল্পে জমি অধিগ্রহণের নামে ব্যাপক অনিয়ম, দুর্নীতি ও লুটপাট হয়েছে। যারা একটি ঘরের মালিক ছিলেন, কোনো কোনো এলাকায় তাদেরকে দু’টি ঘরের মালিক দেখিয়ে জেলা প্রশাসনের এলএ শাখা থেকে বিল পাস করানো হয়েছে। এসব অনিয়ম দিনের পর দিন হয়েছে। এসবের সাথে দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা কমিশনের কোটি কোটি টাকা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নিয়ে গেছেন।
এসবের সঠিক তদন্ত হওয়া উচিত বলে দাবি করে মহসীন ব্যাপারি নামে স্থানীয় একজন নয়া দিগন্তকে বলেন, আমাদের এই সড়কের অবস্থা বেহাল হলেও এই মেগা প্রকল্পের জড়িতরা রাতারাতি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে গেছেন। তাদের চালচলনে এসেছে পরিবর্তন। তবে অনেকে এখন গা ঢাকা দিয়েছেন।
গতকাল রোববার বিকেলে প্রকল্প পরিচালক মো: জাকির হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তার জায়গায় নতুন দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নিজের পরিচয় না দিয়ে নয়া দিগন্তকে বলেন, জাকির হোসেন সাহেব খুলনা জোনে বদলি হয়ে গেছেন। প্রকল্পের সার্বিক অবস্থা জানতে চাইলে তিনি নয়া দিগন্তকে বলেন, আমি এখন অন্য একটি কাজে ব্যস্ত আছি। তিনি নির্বাহী প্রকৌশলীর সাথে কথা বলার পরামর্শ দিয়ে তার মোবাইল নম্বর মেসেজ করে পাঠান। পরে শরীয়তপুর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী (চলতি দায়িত্ব) শেখ নাবিল হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সওজের ২০২৪-২০২৫ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিভুক্ত প্রকল্পের অনুকূলে জুলাই-২০২৪ পর্যন্ত বরাদ্দ ও ছাড় অনুযায়ী অগ্রগতির প্রতিবেদন (অক্টোবর-২০২৪) পাঠিয়ে নয়া দিগন্তকে বলেন, আশা করি মেগা এই প্রকল্পের কাজ ২০২৬ সালের জুন মাসের শুরুর দিকেই শেষ হয়ে যাবে। তিনি বলেন, বর্ষাকালের জন্য এত দিন কাজ ঠিকভাবে করা যাচ্ছিল না। এখন কাজ শুরু হয়ে যাবে। আবার কিছু জায়গায় জমি অধিগ্রহণের জন্য কাজ শুরু করা সম্ভব হচ্ছে না। ১-৩ পর্যন্ত প্যাকেজের কাজের মধ্যে জমি অধিগ্রহণ, সাপ্লাইয়ারের দু’টি গ্রুপের মধ্যে বালু সাপ্লাই দেয়ার ঘটনা নিয়ে আদালতে মামলা দায়ের এবং জমি থেকে দখলদার উচ্ছেদ করাসহ কিছু জটিলতার জন্য কাজে ব্যাঘাত ঘটছে। তবে এই অর্থবছরে ৭০ শতাংশ কাজ শেষ হয়ে যাবে। তার মতে, এখন পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ ৬০ ভাগ শেষ হয়েছে। তবে এক হাজার ৬৮২ কোটি ৫৪ লাখ টাকার কাজের মধ্যে এ পর্যন্ত কত ব্যয় হয়েছে তা তিনি তাৎক্ষণিক জানাতে পারেননি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকল্পের ২৭.০৯৫ কিলোমিটার সড়কটি হাড সোল্ডারসহ প্রশস্ত হবে ৩৪ ফুট। এরমধ্যে প্রেমতলায় ১৯০.২৭৬ মিটার ও কাজীরহাটে ১৪৯.১৫ মিটারের সেতু নির্মাণ করা হবে। বক্স কালভার্ট হবে ২৫৯.মিটারের ২৭টি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই মেগা প্রকল্পকে ঘিরে সাবেক আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি, সড়ক ও সেতু বিভাগের সচিব, প্রধান প্রকৌশলী, তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী থেকে শুরু করে সংশ্লিষ্টদের নগদ ১০-৩০ শতাংশ টাকা কমিশন দিয়েই ঠিকাদারদের কাজের বিল পাস করাতে হয়েছে। এরমধ্যে জেলা প্রশাসনের এল এ শাখার কর্মকর্তা কর্মচারীদের ৩০ থেকে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত কমিশন দিতে হয়েছে। সেই টাকা আন্ডারহ্যান্ডিলিং না হওয়া পর্যন্ত জমি মালিকরা ক্ষতিপূরণের চেক নিতে পারেননি। এসব বিষয়ে জড়িতদের বিরুদ্ধে দ্রুত তদন্ত করে যথাযথ শাস্তির ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা