সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি গড়ার আহ্বান প্রধান উপদেষ্টার
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০০, আপডেট: ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০১
সবার জন্য লাভজনক এমন অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এমন একটি অর্থনীতি গড়ার ওপর জোর দিয়েছেন তিনি যেখানে প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সুফল সবার মধ্যে ভাগ করে নেয়া যাবে। বিশ্বব্যাপী ‘চ্যালেঞ্জ ও জটিলতা’ মোকাবেলা করতে সবাইকে একযোগে কাজ করারও আহ্বান জানিয়েছেন।
গতকাল শনিবার সকালে রাজধানীর একটি হোটেলে তিন দিনব্যাপী বে অফ বেঙ্গল সংলাপের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
ড. ইউনূস বলেন, আসুন আমরা একে অপরকে চ্যালেঞ্জ করি, একে অপরের কথা শুনি এবং একটি নতুন পৃথিবী কল্পনার সাহস করি। যা পরিবেশগতভাবে নিরাপদ পৃথিবীর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং এমন একটি অর্থনীতি গড়ে তুলি যেখানে প্রযুক্তি ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফল সবার মধ্যে সমানভাবে ভাগ করা হবে, শুধু কিছু বিশেষ সুবিধাভোগীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। তিনি বলেন, আমি সব সময়ই একজন আশাবাদী মানুষ এবং উদ্ভাবনী ধারণা ও কল্পনার শক্তিতে বিশ্বাস করি। যদি আমরা একসঙ্গে কল্পনা করতে পারি, তাহলে সেটি অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে। আসুন আমরা এটি করি।
একটি নতুন সভ্যতা গড়ার জন্য সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বিদ্যমান সভ্যতা আমাদের ব্যর্থ করেছে। শুধু পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে এটি একটি আত্মধ্বংসী সভ্যতা হয়ে উঠেছে। আর্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে এটি সম্পদের চরম সঞ্চয়ের দিকে পরিচালিত করেছে।
প্রধান উপদেষ্টা কল্যাণমূলক দেশ গড়ে তুলতে তিন শূন্যের ধারণার ওপর ভিত্তি করে একটি পৃথিবী তৈরির ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এই ধারণা হলো-শূন্য কার্বন নির্গমন, শূন্য সম্পদের কেন্দ্রীকরণ এবং শূন্য বেকারত্ব। এর জন্য, তিনি সামাজিক ব্যবসা প্রচলনের কথা বলেন, যা মানুষের সমস্যার সমাধানে মনোযোগ দেয়, কেবল মুনাফা করা যার মূল উদ্দেশ্য নয়। একই সঙ্গে যুবকদের চাকরিপ্রার্থী না বানিয়ে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলার ওপরও জোর দেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি উপকূলীয় জনগোষ্ঠীকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য দ্রুত ঐক্যবদ্ধ পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানান এবং এমন একটি অর্থনীতি গড়ায় জোর দেন যেখানে সবাই উপকৃত হবে। তিনি বলেন, আমাদের অঞ্চল জলবায়ু পরিবর্তনের ফ্রন্টলাইনে রয়েছে। প্রতি বছর, আমাদের উপকূলীয় জনগোষ্ঠী বর্ধিত পানি এবং পরিবর্তিত আবহাওয়ার প্রভাবে জীবন, ঘরবাড়ি এবং জীবিকা হুমকির মুখে পড়ে। এই সঙ্কট এমন যা পরবর্তী সময়ের জন্য ফেলে রাখা যায় না; এটি অবিলম্বে এবং ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টার দাবি রাখে।
তরুণদের সম্ভাবনা নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমরা একই সঙ্গে অপরিসীম সম্ভাবনার একটি অঞ্চল। আমাদের দেশ তরুণদের দেশ। ১৭১ মিলিয়ন মানুষের মধ্যে অর্ধেকের বয়স ২৭ বছরের নিচে। এটি আমাদের দেশকে সৃজনশীলতায় অত্যন্ত শক্তিশালী করে তুলেছে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, যুবসমাজের মধ্যে টেকসই উন্নয়নে নেতৃত্ব দেয়ার এবং আমাদের পরিবেশ সুরক্ষা ও উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবুজ প্রবৃদ্ধির মডেল তৈরির ক্ষমতা রয়েছে। তবে এর জন্য প্রয়োজন সহযোগিতা, সাহস এবং অমিত ভবিষ্যতকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেয়ার প্রতি অটুট বিশ্বাস।
সম্মেলন আয়োজন করায় বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজ (সিজিএস) এর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এই সম্মেলন শুধু মতবিনিময়ের স্থান নয়; এটি আমাদের অভিন্ন সহনশীলতার প্রমাণ।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, বাংলাদেশ সবসময় স্বপ্ন, কঠোর পরিশ্রম এবং অবিচ্ছেদ্য ইচ্ছা পূরণের দেশ হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছে। এটি এখন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক, কারণ বিপ্লবের আকাক্সক্ষাগুলো এখনও সবার মনে সতেজ। তিনি বলেন, ‘এই আকাক্সক্ষা লাখো কণ্ঠের আওয়াজ, প্রায় পুরো জাতির আওয়াজ, তারা পরিবর্তনের দাবি তুলেছে। আমাদের সবাইকে মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এবং অন্তর্ভুক্তির ওপর ভিত্তি করে ভবিষ্যৎ গড়ার জন্য চাপ দিয়ে যাচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা উল্লেখ করেন, এ বছর সম্মেলনের বিষয়বস্তু, একটি বিভক্ত বিশ্ব, গভীরভাবে প্রাসঙ্গিক বলে মনে হয়েছে। কারণ আমরা এমন এক সময়ে বাস করছি যা চ্যালেঞ্জ ও জটিলতায় পরিপূর্ণ। তিনি বলেন, হোক তা অর্থনৈতিক বৈষম্য, সামাজিক অন্যায়, বা জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি, আমরা এমন সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি যা অত্যধিক। তবুও, বাংলাদেশে আমরা সহনশীলতা সম্পর্কে কিছু জানি, প্রতিকূলতার মুখোমুখি হওয়া এবং তা থেকে সুযোগ তৈরি করা সম্পর্কে কিছু জানি। এটি আমি কয়েক দশক আগে গ্রামবাসীদের সঙ্গে কাজ করার সময় শিখেছি, তাদের সাহস দেখে অনুপ্রাণিত হয়েছি।
অধ্যাপক ইউনূস যোগ করেন, এই অভিজ্ঞতাগুলো আমাকে শিখিয়েছে যে যদি আমাদের ধৈর্য থাকে সমস্যাকে গভীরভাবে বোঝার, চেষ্টা করার সাহস থাকে, এবং লেগে থাকার সঙ্কল্প থাকে, তবে প্রতিটি সমস্যার একটি সমাধান আছে। তিনি জানান, ১০০ দিন আগে প্রায় ১৫০০ ছাত্র, শ্রমিক ও অন্যান্য বিক্ষোভকারী স্বৈরশাসকের হাতে নিহত হয়েছেন এবং আহত হয়েছিলেন প্রায় ২০ হাজার। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, ‘এই বৈশ্বিক সংলাপের মাধ্যমে, আসুন আমরা সেই মানুষদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই, যারা তাদের জীবন উৎসর্গ করেছেন, যারা তাদের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, চোখ এবং অন্যান্য শারীরিক সক্ষমতা হারিয়েছেন, এবং যারা এখনও জীবন নিয়ে লড়াই করছেন।’
তরুণদের আঁকা গ্রাফিতি দেখার আহ্বান : অনুষ্ঠানে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ঢাকায় ‘বে অব বেঙ্গল’ সংলাপে অংশ নেয়া বিদেশী অতিথিদের বাংলাদেশের তরুণ বিপ্লবীদের আবেগ ও আকাক্সক্ষার প্রতীক গ্রাফিতি ও চিত্রকর্মগুলো ঘুরে দেখার আহ্বান জানান।
তিনি বলেন, বিদেশী অতিথিদের প্রতি আমার আহ্বান : ঢাকার রাস্তায় হাঁটার সময় দেয়ালে আঁকা বর্ণিল চিত্রকর্মগুলো দেখার ঐতিহাসিক সুযোগ আপনারা মিস করবেন না। এই চিত্রকর্মগুলো তরুণদের আবেগ ও আকাক্সক্ষার প্রকাশ, যা হত্যাযজ্ঞের সময় আঁকা হয়েছিল। তিনি আরো বলেন, এগুলো দেখলে যে কেউ বিস্মিত হবেন, কী গভীর শক্তিশালী চিত্রকর্ম হত্যার সময় তরুণরা তুলে ধরেছে।