‘বাংলাদেশের ২০২৪ সালের বন্যা মোকাবেলা করেছে তরুণ সমাজ’
- শাহ আলম বাকু, আজারবাইজানের থেকে
- ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০২:০০
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বলেছে, একদিকে যেমন বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে তার সাথে তাল মিলিয়ে বাড়ছে প্রযুক্তির ব্যবহার। প্রযুক্তির বর্জ্য সবুজ বিপ্লবের জন্য হুমকিস্বরূপ। সবুজ বিশ্ব করার জন্য প্রযুক্তির বর্জ্যকে অপসারণ নিশ্চিত করতে হবে। তা করতে না পারলে সবুজ বিপ্লবের যে আন্দোলন তা বাস্তবায়ন সম্ভব হবে না। এজন্য ধনী দেশগুলোকে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে। কারণ তারা তাদের উৎপাদিত বর্জ্য গরিব দেশগুলোতে আবার পাঠিয়ে দিচ্ছে এজন্য সবুজ বিপ্লবের জন্য ধনী দেশগুলোকে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে হবে।
কপ২৯ এর সভাপতি এবং আজারবাইজানের পরিবেশ ও প্রাকৃতিক সম্পদমন্ত্রী মুখতার বাবায়েভের বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ‘ডিজিটাল প্রযুক্তিগুলো জলবায়ু পর্যবেক্ষণ, প্রারম্ভিক সতর্কতা ব্যবস্থা, শক্তিদক্ষতার উন্নতি এবং শক্তিশালি অর্থনীতির ভিত্তির জন্য শক্তিশালী ডিজিটাল প্রযুক্তির সরঞ্জাম সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। একই সময়ে, ডিজিটাল প্রযুক্তি বিস্তারের সাথে, আমাদের একই সাথে পরিবেশগত বিষয়টি জানতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে বর্ধিত শক্তি খরচ, নির্গমন এবং ই-বর্জ্যরে ক্রমবর্ধমান সমস্যা।
এ দিকে বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে বর্তমানে বৈশ্বিক দূষণ নির্গমনের প্রায় চার শতাংশের জন্য দায়ী তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি খাত। আমাদের এই প্রভাব কমানোর জন্য কাজ করতে হবে। এদিকে, আজারবাইজানের ডিজিটাল উন্নয়ন ও পরিবহনমন্ত্রী, রাশাদ নাবিয়েভ বলেছেন যে ডিজিটাল প্রযুক্তি ২০৩০ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে জলবায়ু পর্যবেক্ষণ, প্রাথমিক সতর্কতা ব্যবস্থা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের স্থিতিস্থাপকতা তৈরির ক্ষেত্রে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করতে পারে।
‘ডেটা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অন্যান্য ডিজিটাল টুলস ব্যবহার করার ক্ষমতা জলবায়ু পরিবর্তনের অভিযোজন এবং প্রশমনের জন্য অভূতপূর্ব সুযোগ তৈরি করেছে। এই সুযোগগুলো আমাদের ডিজিটাল খাত সম্প্রসারণে কেবল টেকসই নয় বরং অন্তর্ভুক্তিমূলকও হতে হবে। এ বিষয় নিশ্চিত করার জন্য আমাদের দায়িত্ব পালন করতে হবে।
আমরা জানি, ডেটা প্রসেসিং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং সংযোগের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সাথে বিদ্যুতের ব্যবহার, উপাদান ব্যবহার এবং ই-বর্জ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের সেক্রেটারি জেনারেল, ডোরেন বোগদান-মার্টিন বলেন, সবুজ ডিজিটাল পদক্ষেপের ঘোষণা বাস্তবায়নে পূর্ণ সমর্থন প্রয়োজন রয়েছে। আমাদের সদস্য রাষ্ট্রগুলো উপলব্ধি করেছে যে ডিজিটাল রূপান্তর এবং স্থায়িত্ব অবশ্যই বাস্তবায়ন করতে হবে। এ কারণেই তারা ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) দুটি কৌশলগত উদ্দেশ্যের একটি টেকসই ডিজিটাল রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ব্যবহারের দিকে গুরত্ব দিচ্ছে এবং কিছু প্রতিষ্ঠান ইতোমধ্যে পুনর্নবীকরণযোগ্য উৎস থেকে সম্পূর্ণরূপে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। একই সময়ে, আইটিইউ-এর ‘গ্রিনিং ডিজিটাল কোম্পানি’ রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, সরঞ্জাম, নেটওয়ার্ক পরিষেবা এবং ডেটা স্টোরেজের জন্য বিশ্বব্যাপী চাহিদা বৃদ্ধির কারণে প্রযুক্তি সেক্টরের পরিবেশগত বিষয়ে ক্রমাগত গুরুত্ব বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এ দিকে অপর একটি অনুষ্ঠানে বক্তারা বলেছেন, ২০২৪ সালের আগস্টের বন্যার সময় বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ছিল সম্পূর্ণ নবীন, তাই সরকার বন্যাদুর্গতদের পাশে সেভাবে দাঁড়াতে পারেনি। এই বন্যার জন্য বিশ্ব মোড়লরা দায়ী থাকলেও বিশ্ববাসীও তাদের পাশে দাঁড়ায়নি। এ সময় বন্যা দুর্গতদের জীবন বাঁচাতে ও বন্যাপরবর্তী পুনর্বাসনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে দেশের তরুণ সমাজ। ভয়াবহ এই বন্যা মোকাবিলার মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে যে জলবায়ুজনিত দুর্যোগ মোকাবিলা ও পানির ন্যায্যতা নিশ্চিতে তরুণদের সম্পৃক্ত করার বিকল্প নেই। তাই জলবায়ু পরিবর্তন ঝুঁকি মোকাবিলায় জাতিসঙ্ঘের মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী তরুণদের ‘পেইড ভলেন্টিয়ার’ হিসেবে যুক্ত করার পরামর্শও দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
শুক্রবার গত আজারবাইজানের বাকুতে জলবায়ু সম্মেলনের ‘ওয়াটার ফর ক্লাইমেট’ প্যাভিলিয়নে আয়োজিত বিশ্ব সংলাপে বক্তারা এ কথা বলেন। যৌথভাবে এই সংলাপের আয়োজন করে মিশন গ্রিন বাংলাদেশ (এমজিবি), ইয়ুথ প্লাটফর্ম ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট (ওয়াইপিএসডি), বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস), ন্যাচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্ট (ন্যাকম) ও চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভ।
ক্যাপসের চেয়ারম্যান ড. আহমেদ কামারুজ্জামান মজুমদারের সভাপতিত্ব ও তরুণ জলবায়ুকর্মী ফারিয়া অমির সঞ্চালনায় এই সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ন্যাচার কনজারভেশন ম্যানেজমেন্টের (ন্যাকম) নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ সরকারের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ড. মনজুরুল হান্নান খান, মূল প্রবন্ধে তিনি আগস্টের বন্যার ভয়াবহতা, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও তরুণদের তৎপরতার চিত্র তুলে ধরেন।
সংলাপে প্যানেল আলোচক হিসেবে বক্তব্য রাখেন চেঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী এম জাকির হোসাইন খান, ওয়াটারকিপার্স সেনেগালের সমন্বয়ক এম্ব্যাক স্যাক, ক্লাইমেট ফরোয়ার্ড পাকিস্তানের শিশু ও যুববিষয়ক উপদেষ্টামণ্ডলীর চেয়ারপার্সন মাহনুর রশিদ, ইয়ুথ প্লাটফর্ম ফর সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট ওয়াইপিএসডি’র প্রধান সমন্বয়ক সাইদুল ইসলাম, জাতিসঙ্ঘ জলবায়ু কর্মসূচির পানি ও জলবায়ু গবেষক আসিফ ইকবাল, ওয়াটার এইডের প্রোগ্রাম অ্যান্ড পলিসি অ্যাডভোকেসি ডিরেক্টর পার্থ হেফাজ শেখ এবং মিশন গ্রীন বাংলাদেশের পরিচালক কেফায়েত শাকিল, আইক্যাডের যুব প্রতিনিধি আল মামুন রাকিব ও ফুটস্টেফ ফাউন্ডেশনের সভাপতি শাহ রেফায়েত চৌধুরী।
এম জাকির হোসাইন খান তার বক্তব্যে বলেন, পানির ন্যায্যতা হলো জলবায়ু ন্যায্যতার একটি বড় অংশ। প্রকৃতি কেন্দ্রিক বৈশ্বিক শাসনের জন্য জাতীয় এবং আন্তঃসীমান্তীয় পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনা জরুরি। বিশেষ করে তরুণদের জন্য এটা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
ড. আহমেদ কামারুজ্জামান মজুমদার বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক পরিসরে যতই ক্ষতিপূরণ চাইনা কেন, আমাদের মনঃস্তাত্তিক ক্ষয়ক্ষতি, পৈতৃক ঘর-বাড়ী হারানো, ধর্মীয় স্থাপনা হারানোর বেদনা আমরা কিভাবে কাভার করব?
তাই ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করার সময় মানসিক বিষয়গুলোও মাথায় রাখতে হবে। সেই সাথে শুধু ক্ষতিপূরণের দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে তরুণদের জলবায়ু, পানির ন্যায্যতাসহ সব পরিবেশ সমস্যায় সম্পৃক্ত করা জরুরি। অ্যাম্ব্যাক স্যাক বলেন, আমাদের সবারই উচিত তরুণদের জলবায়ু পরিবর্তন রোধ এবং পানি ন্যায্যতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে সম্পৃক্ত করা। কারণ তারাই পৃথিবীর আগামী।
মাহনুর রশিদ বলেন, পাকিস্তানের তরুণ স্বেচ্ছাসেবকরা বাংলাদেশী স্বেচ্ছাসেবকদের মতোই উত্তর পাকিস্তানে সাম্প্রতিক বন্যায় দুর্যোগ মোকাবেলায় উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টা চালিয়েছে। এটি বার্তা দিচ্ছে বিশ্বব্যাপী তরুণদের অবদানের ক্ষমতায়ন এবং স্বীকৃতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সাইদুল ইসলাম বলেন, ২০২৪ সালের ভয়াবহ বন্যা যখন দেশ ও বিশ্ব ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে তখন তরুণরা অগ্রণী ভূমিকা রেখে বন্যা মোকাবিলার মাধ্যমে স্পষ্ট করেছে যে, জলবায়ুজনিত দুর্যোগ মোকাবিলা ও পানির ন্যায্যতা নিশ্চিতে তরুণদের সম্পৃক্ত করার কোনো বিকল্প নেই। তাই আমরা চাই জাতিসঙ্ঘের দেশগুলোর মাধ্যমে তরুণদের পেইড ভলেন্টিয়ার হিসেবে যুক্ত করুক এবং দুর্যোগ মোকাবিলায় নেতৃত্ব দিক।
আসিফ ইকবাল বলেন, জরুরি প্রতিক্রিয়ার জন্য দুর্যোগপ্রবণ এলাকায় তরুণ স্বেচ্ছাসেবকদের তাদের সম্প্রদায়ের মধ্যে সব প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি সামগ্রীর অ্যাক্সেস রয়েছে তা নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এজন্য তাদের কর্মক্ষমতা বাড়াতে হবে এবং এর জন্য সরকার তাদের জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক প্রদত্ত বিভিন্ন প্রশিক্ষণ, কর্মশালার সাথে সংযুক্ত করতে পারে।
কেফায়েত শাকিল বলেন, ২০২৪ এর আগস্টে ফেনীর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের মধ্যে আমি অন্যতম একজন। বন্যায় আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ক্ষতিপূরণ পাইনি, কবে পাব জানিও না। আমি মনে করি তরুণরা আমাদের তাৎক্ষণিক যে সহায়তা করেছে সেটিই আমাদের একমাত্র পাওয়া। তাই তরুণদের আরো সক্ষম করা, বিশেষ করে জল ও বায়ুর ন্যায্যতা নিশ্চিতে তরুণদের ক্ষমতায়ন প্রয়োজন বলে আমি মনে করি।