শেখ মুজিবের ছবির ব্যাপারে ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র বিষয় আছে
ডয়চে ভেলের সাথে সাক্ষাৎকারে রিজওয়ানা- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ০১:৫৯
জার্মান বার্তা সংস্থা ডয়চে ভেলে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে অন্তর্বর্তী সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, এই সরকার সংবিধানটাকে বাতিল করেনি, অস্বীকার করেনি, স্থগিত করেনি। কিন্তু গণ-অভ্যুত্থানের ফলে আসা একটা সরকারকে সংবিধানের প্রত্যেকটা অক্ষর যদি মেনেই চলতে হতো তাহলে তো গণ-অভ্যুত্থানটা হতো না, এই সরকারটাও হতো না। শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি নামানোর ব্যাপারে ‘ডকট্রিন অব নেসেসিটি’র একটা বিষয় আছে। গণ-অভ্যুত্থানের আকাক্সক্ষার একটা বিষয় আছে। গণ-অভ্যুত্থানের মূল্যবোধের একটা বিষয় আছে। এখানে ছবি নামানোটা মুখ্য নয়। এখানে হচ্ছে, যে জিনিসগুলোকে পুঁজি করে ফ্যাসিজমটা চলেছে সেই জিনিসের বিরুদ্ধে, সেই প্র্যাকটিসের বিরুদ্ধে একটা অবস্থান নেয়া। এটাকে সাংবিধানিক আলোকে দেখার সুযোগ আছে বলে মনে করছি না।
ডয়চে ভেলেকে উপদেষ্টা এই সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড ও সফলতা বা ব্যর্থতা নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। এই সরকার গত তিন মাসে বৈষম্যমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায় কতটা এগিয়েছে এমন প্রশ্নের উত্তরে রিজওয়ানা বলেন, গত তিন মাসে অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রগতি বেশ জোরেশোরেই হয়েছে। এই সরকার যখন যাত্রা শুরু করেছিল তখন প্রশাসনিক বলেন, আইনশৃঙ্খলা বলেন, বিচারই বলেন সবক্ষেত্রে যে ধরনের পরিস্থিতি ছিল, সেই পরিস্থিতি প্রাথমিকভাবে সামাল দিয়ে তারপর কাজ শুরু করতে হয়েছে। আপনি যদি দেখেন সবক্ষেত্রে বৈষম্যের কথা বলে যে আন্দোলনগুলো হয়েছে, প্রত্যেকটা আন্দোলনের সাথেই সরকার বসেছে। প্রত্যেকটা আন্দোলনের কথাই শুনেছে। তারপর একটা সিদ্ধান্ত দিয়েছে। সরকার যে সিদ্ধান্ত দিয়েছে সেটা যারা আন্দোলন করেছে তারা মেনে নিয়েছে। বৈষম্যহীন রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়তে কতগুলো জায়গাতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করতে হবে। বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করতে হবে, প্রশাসনকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করতে হবে, দুদককে শক্তিশালী করতে হবে, গণমাধ্যমকে শক্তিশালী করতে হবে, সবচেয়ে বড় কথা হলো জনগণকে ক্ষমতায়িত করতে হবে। আমাদের দেশে যে একটা ভিভিআইপি কালচার গড়ে উঠেছিল সেটাকে ভাঙতে হবে। এর প্রত্যেকটা ক্ষেত্রে সরকার তার কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে।
কোথায় কোথায় সংস্কার করলে আমরা বৈষম্যমুক্ত সমাজ পাবো, ভিভিআইপি সংস্কৃতি ভাঙতে পারবো সেই কাজগুলো হচ্ছে। প্রশ্নের শেষ উত্তরে আমি বলব, ক’দিন আগেই যদি আপনি দেখেন আমাদের যিনি সরকারপ্রধান তিনি এয়ারপোর্টে প্রবাসী শ্রমিক ভাই-বোনদের জন্য আলাদা একটা লাউঞ্জ করেছেন। এ যাবৎকাল আমরা ভিআইপি ও ভিভিআইপি কাউন্টার দেখেছি। এখন থেকে সেখানে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য আলাদা কাউন্টার দেখা যাবে। ফলে যাত্রাটা শুরু হয়েছে। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে হতাহতদের তালিকা তৈরি ও পুনর্বাসন সম্পর্কে উপদেষ্টা বলেন, যারা আন্দোলন করেছেন তাদের সঙ্গে যারা আন্দোলনে ছিলেন তারাও এই সরকারের অংশ। তারাও প্রতিনিয়ত বিক্ষোভ, দাবি সামাল দিচ্ছেন। আমরাও কিন্তু এই আন্দোলনে রাজপথে ছিলাম। ফলে আমাদের এটা অন্য কারো কাছ থেকে জানতে হবে না যে, কতটা রক্ত মানুষ ঝরিয়েছে। ওইটা সম্পূর্ণ সম্মান আমরা করি। আর সেটাকে ধারণ করি বলেই প্রথম থেকে আমরা বলে আসছি আমরা আসলে ক্ষমতা না, দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। অনেকেরই চিকিৎসা হচ্ছে না, এই কথাটা বলা ঠিক না। কারণ হচ্ছে, অনেকে যোগাযোগটা করতে পারেনি। অনেকে ঠিক আন্দোলনের সাথে ছিল বলে আহত হয়েছে তা না। হয়ত ওই দিক দিয়ে যাচ্ছিল বলে আহত হয়েছে। ওই যোগাযোগটা স্থাপন করতে সময় লেগেছে। যখনই আমরা খবর পাচ্ছি বা কোনো সূত্র থেকে জানতে পারছি কেউ আহত হয়েছিল এই আন্দোলনে তার সাথে যোগাযোগ হয়নি এমন একটাও দৃষ্টান্ত দেখাতে পারবেন না। তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আবার প্রথমদিকে যারা মারা গেছেন তাদের লাশ পোস্টমর্টেম না করেই পরিবার নিয়ে চলে গেছেন। ফলে সেখানে সরকারি সিস্টেমে ভেরিফিকেশনে সময় লেগেছে। তবে সেটাও চূড়ান্ত হয়ে গেছে। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ঢাকায়ও এন্ট্রি হয়েছে ঢাকার বাইরেও এন্ট্রি হয়েছে। সেগুলো ভেরিফিকেশনে সময় লাগছে। কিন্তু আমাদের নজরে আনা হয়েছে কিন্তু আমরা ব্যবস্থা নেইনি, এমন দৃষ্টান্ত আমার জানা নেই।
নানা ইস্যুতে ছাত্ররা রাজপথে নেমে সরকারের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করছে। এই আলোচনা তো টেবিলে হতে পারত। আপনাদের উপর চাপ তৈরি করতেই কি ছাত্ররা এমন করছে?
এ প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, রাজপথে যারা দাবি করছেন তারা আলোচনায় বসবেন না, এমন কথা তো বলেন নাই। সরকারের সকল সিদ্ধান্তে সকলে একমত হবেন এমন কথা নেই। সরকারের সিদ্ধান্তের ব্যাপারে কারো যদি আপত্তি থাকে, আমরা আহ্বান করি আমাদের আলোচনার দুয়ার সব সময়ই খোলা। রাজপথে যখন কোনো আন্দোলন হয়, তখন সেটা আমরা শুনি এবং ধর্তব্যে নেই, বিবেচনা করি। আপনি যদি খেয়াল করেন সরকারি চাকরিতে বয়সের যে বিষয়টা, সেখানে বয়স ৩৫ এবং তাদের দাবি ছিল অনেকবার পরীক্ষা দেয়ার। আমরা বললাম, বয়স ৩২ এবং পরীক্ষা দেয়া যাবে তিনবার। এরপর তারা আবার দাবি করল, তিনবার না, চারবার সুযোগ দিতে হবে। আমরা কিন্তু তাদের সেই দাবি শুনেছি। অনেকেই অনেক রকম দাবি তুলতে পারে, সরকার সবটাই শুনবে এবং সরকারের আলোচনার দুয়ার সবার জন্য খোলা।
ছাত্রলীগ তো নিষিদ্ধ করেছে সরকার। কিন্তু আওয়ামী লীগ তো নিষিদ্ধ না। তাদের মাঠের কর্মসূচিতে বাধা দেয়া হচ্ছে। আসলে তাদের ব্যাপারে সরকারের সিদ্ধান্ত কী?
এ প্রসঙ্গে উপদেষ্টা বলেন, শুরুতে যে প্রশ্নটা করেছিলেন অনেক মানুষের রক্তের বিনিময়ে এই সরকার গঠিত হয়েছে, সেই পরিপ্রেক্ষিতটা যদি মাথায় রাখেন তাহলে এই প্রশ্নের উত্তরটা খুঁজে পাওয়া আপনার জন্যও সহজ হবে। যারা রক্ত ঝরিয়েছে তাদের পক্ষ থেকে এই অবস্থানটা বারবার পরিষ্কার করা হয়েছে যে, ফ্যাসিজমের সাথে যারা জড়িত ছিল, যারা এই নৃশংস হত্যকা-ের জন্য দায়ী ছিল তাদের বিচার না হওয়া পর্যন্ত রাজনীতি হবে না। এটা তো তারা স্পষ্ট করেছে। রাজনীতির অধিকার কারোটাই নিষিদ্ধ করা হয়নি। কিন্তু যারা ফ্যাসিজমের সাথে জড়িত তাদের বিচারের প্রশ্নটা আগে মীমাংসিত হতে হবে। তারপর বাকি প্রশ্নের উত্তর দেয়া যাবে।
জাতীয় পার্টিকেও সমাবেশ করতে দেয়া হয়নি। তাদের সাথে তো শুরুতে প্রধান উপদেষ্টা বৈঠক করেছেন। এখন তাদের সাথে কি বৈষম্য করা হচ্ছে না?
এর জবাবে উপদেষ্টা বলেন, যারা রক্ত ঝরিয়েছে তারাও বলছে, তা ছাড়া দেশের অনেকেই তো দেখেছে জাতীয় পার্টির সমর্থনের কারণে বিনা ভোটের নির্বাচনগুলো বৈধতার সুযোগ পেয়েছে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল। কাজেই যারা রাস্তায় আন্দোলন করেছে তাদের স্পষ্ট দাবি হচ্ছে, ফ্যাসিস্ট, ফ্যাসিজমের দোসর যারা তাদের বিচার হতে হবে।
৪ নভেম্বর ও ৭ মার্চ তো বাংলাদেশের ইতিহাসের অংশ। এই দু’টি দিবস বাতিল করে কি সরকার বিতর্ক উসকে দিলো না?
এ প্রশ্নের জবাবে উপদেষ্টা বলেন, সরকারের অনেক কাজেই বিতর্ক হবে। বিতর্ক উসকানোর তো বিষয় না। মুক্ত আবহে যেকোনো বিষয়ে তর্কবিতর্ক করার সুযোগ আছে। কারো যদি মনে হয়, সরকারের এই সিদ্ধান্তটা ভুল তারা বলবে এটা ভুল।
সরকার কি ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে? নাকি সংস্কারের পক্ষে?
এ প্রশ্নের উত্তরে উপদেষ্টা বলেন, এই সরকার ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করবে এই ধরনের আলোচনা কোথাও কখনো হয়নি। এটা বরং ছাত্ররাই কথা বলে ঠিক করুক। সেখানে যদি সরকার মনে করে কোনো বক্তব্য দেয়া দরকার সেটা দেবে। কারণ ছাত্ররাই তো এই অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। ছাত্রদের বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন পরিপ্রেক্ষিত আছে। বুয়েটে ছাত্রদের পরিপ্রেক্ষিত এক রকম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিপ্রেক্ষিত এক রকম। এই দুইটা প্রতিষ্ঠানের কথা মনে এল তাই বললাম। ফলে এটা আমি ছাত্রদের উপরই ছেড়ে দিচ্ছি। ওরা মতামত দিক, তারপর বৃহত্তর সমাজের মতামত নেয়া হবে তারপর সরকার এটা নিয়ে কথা বলবে। এখন আগ বাড়িয়ে সরকার ছাত্র রাজনীতি বন্ধ বা বন্ধ না এই আলোচনা করছে না।
আপনারা কি আন্তর্জাতিক কোনো চাপ অনুভব করছেন?
এ বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, আন্তর্জাতিক কোনো চাপ সেই অর্থে অনুভব করছি না। বরং আন্তর্জাতিক বড় ক্ষেত্র আমাদের সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে, সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা দেখি, কোনো কোনো উত্তেজনা এখানে হয়ত সৃষ্টিই করা হয়, কোনো ঘটনা সেই অর্থে সাম্প্রদায়িক নয় সেগুলো বিদেশে নানাভাবে প্রচার করা হয়। সে ক্ষেত্রে আমাদের সতর্ক থাকতে হচ্ছে। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সমাজ আগেও ছিল না, এখনো নেই, ভবিষ্যতেও হবে না। আমার জন্মই তো এদেশে, অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও দেশ ছেড়ে চলে যাইনি। এ দেশেই আছি। ফলে মাঝেমধ্যে মনে হয়, আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এই সরকারের যে গ্রহণযোগ্যতা সেটাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে একটা সুসংগঠিত প্রচার চালানো হচ্ছে। যেটা অপপ্রচারেই শামিল। সেখানে আমাদের বাড়তি সময় দিতে হচ্ছে। ওই সময়টা যদি আমরা ওদিকে না দিয়ে দেশ গঠনের কাজে, বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের কাজে, প্রশাসনের সংস্কারের কাজে, বিচার বিভাগের সংস্কারের কাজে দিতে পারতাম- সেটা আমাদের জন্য ভালো হতো।