২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিজরি
`

জুলাই-আগস্টে বিচার বহির্ভূত হত্যা ১৫৮১ জন

-

অধিকারের প্রতিবেদন
-আহত ১৮ হাজারের বেশি
-৫৫০ জনের চোখ নষ্ট

গত জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত দেশে এক হাজার ৫৮১টি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এতে আহত হয়েছে ১৮ হাজারের বেশি। তাদের মধ্যে চোখ নষ্ট হয়ে গেছে ৫৫০ জনের। গতকাল শুক্রবার মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের এক প্রতিবেদনে এমন তথ্য দেয়া হয়েছে। তারা বলছে, এটি ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে আন্দোলন দমনের নামে সবচেয়ে বড় হত্যাযজ্ঞ। হত্যাকাণ্ডের পাশাপাশি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা গুম, গ্রেফতার এবং গ্রেফতারের পর নির্যাতন চালানো হয় অসংখ্য আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার ওপর।
প্রতিবেদনে বলা হয়, কর্তৃত্ববাদী হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার জুলাই-আগস্ট আন্দোলন বাংলাদেশের একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এই আন্দোলনকে বিগত সরকার কঠোর হাতে দমন করার নামে তার সহযোগী সংগঠন ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগকে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়। শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ আন্দোলন দমন করতে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহার করা হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করার জন্য ব্যবহার করা হয় জাতিসঙ্ঘের নামযুক্ত সাঁজোয়া যানও। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য এবং ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা এই সময় আন্দোলনরত ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি ছোড়ে। এতে শিশুসহ ১৫৮১ জন নিহত, ১৮ হাজারের বেশি আহত হন। তাদের মধ্যে ৫৫০ জনের চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। ধারণা করা হচ্ছে এই সংখ্যা আরো বেশি।

২০২৪ সালের ৫ জুন সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের একটি বেঞ্চ সরকারি দফতর, স্বায়ত্তশাসিত ও আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন করপোরেশনের চাকরিতে সরাসরি নিয়োগের ক্ষেত্রে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড) মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। ৬ জুন থেকে কোটা পদ্ধতি পুনর্বহালসংক্রান্ত হাইকোর্টের রায়ের প্রতিবাদ জানিয়ে এবং চাকরিতে মেধাভিত্তিক নিয়োগ বহাল রাখার দাবিতে শিক্ষার্থীরা ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীবৃন্দ এর ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশ করে।
১ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা বাতিলের পরিপত্র পুনর্বহালের দাবিতে ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সময় আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফরমটি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন নাম ধারণ করে। ৪ জুলাই সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের রায় স্থগিত না করায় কোটা বহাল থাকে। এই সময় থেকে সারা দেশে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। স্বতঃস্ফূর্তভাবে শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলনে যোগ দিতে থাকেন এবং ধর্মঘটের ডাক দেয়। ৬ জুলাই থেকে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিক্ষোভ প্রদর্শন ও পরীক্ষা বর্জন করা হয়। ৭ জুলাই সারা দেশে সড়ক-মহাসড়ক অবরোধ করা হয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ১০ জুলাই সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা বাংলা ব্লকেড ঘোষণা করে। ১১ জুলাই দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং টিয়ার শেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করলে কমপক্ষে ৪০ জন আহত হন। ১৪ জুলাই গণভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের (সরকার সমর্থিত) এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধাদের নাতি-পুতিরা কোটায় চাকরি পাবে না, তাহলে কি রাজাকারের নাতি-পুতিরা কোটায় চাকরি পাবে?’ এই দিন মধ্যরাতে আন্দোলনকারীদের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অপমান করেছেন বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন আবাসিক হল ও ক্যাম্পাসে ছাত্ররা বিক্ষোভ করে এবং ‘তুমি কে আমি কে- রাজাকার রাজাকার’, ‘চেয়েছিলাম অধিকার, হয়ে গেলাম রাজাকার’সহ বিভিন্ন সেøাগান দেয়। ১৫ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘রাজাকার’ সেøাগানের জবাব ছাত্রলীগই দেবে। ওবায়দুল কাদেরের এই বক্তব্যের পর আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা করার জন্য বহিরাগত দুর্বৃত্তদের আনা হয় বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।

এ দিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আগ্নেয়াস্ত্র ও বিভিন্ন দেশীয় অস্ত্র নিয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায়। ছাত্রলীগের হামলায় তিন শতাধিক আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী আহত হন। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি জাহাঙ্গীরনগর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুড়িগ্রাম সরকারি কলেজ, রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও যশোরে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় হেলমেট পরিহিত সরকার সমর্থক দুর্বৃত্তরা।
১৬ জুলাই রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদকে এসআই ইউনুস নামে এক পুলিশ সদস্য সরাসরি গুলি করে হত্যা করে, যা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। ময়নাতদন্ত সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক জানান, কাছ থেকে গুলি করার কারণে এটা হয়েছে। তবে আবু সাঈদের মৃত্যুর ঘটনায় করা মামলাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার জন্য মামলার প্রাথমিক তথ্য বিবরণীতে বলা হয়, আন্দোলনকারীদের ছোড়া গুলি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপের একপর্যায়ে আবু সাঈদের মৃত্যু হয়। আবু সাঈদ হত্যা মামলায় রংপুর পুলিশ লাইনস স্কুল অ্যান্ড কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্র আলফি শাহরিয়ার মাহিমকে অভিযুক্ত করে পুলিশ। মাহিমের বাবা জানান, পুলিশ তার ছেলেকে পায়ে গুলি করে আটক করে। মাহিমকে ১৯ জুলাই আবু সাঈদ হত্যা মামলায় গ্রেফতার দেখিয়ে রংপুর আদালতে হাজির করা হয়। জন্ম সনদ অনুযায়ী মাহিমের বয়স ১৬ বছর ১০ মাস। কিন্তু পুলিশ মামলায় তার বয়স ১৯ বলে উল্লেখ করে।
আবু সাইদকে হত্যার পর সারা দেশে ছাত্ররা রাস্তায় নেমে আসলে তাদের ওপর পুলিশ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মীরা একের পর এক হামলা চালাতে থাকে। সরকার এই সময় পুলিশ, বিজিবি ও বিশেষায়িত বাহিনী সোয়াটকে ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে। এই সময় বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের সাথে স্থানীয় সাধারণ মানুষও যোগ দেন। এভাবে চলতে থাকে একের পর এক বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড। পুলিশ ড্রোন ব্যবহার করে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলি চালায়। এর মধ্যে সরকার সেনা মোতায়েন করে কারফিউ জারি করে। জুলাই আগস্টের এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ৪৪ জন (পুলিশ সদর দফতর থেকে দেয়া তথ্য) পুলিশ সদস্যও রয়েছেন।

অধিকারের প্রতিবেদনে দেয়া সুপারিশে বলা হয়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সংঘটিত বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, নির্যাতন এবং অমানবিক ঘটনাগুলোর সাথে জড়িত আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর সংশ্লিষ্ট সদস্যদের বিচারের সম্মুখীন করতে হবে।
নির্যাতন ও হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন ২০১৩ বাস্তবায়ন করে রিমান্ডের নামে নির্যাতন বন্ধের জন্য ব্লাস্ট বনাম বাংলাদেশ মামলায় হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগের নির্দেশনা মেনে চলতে হবে। সরকারকে নির্যাতনবিরোধী জাতিসঙ্ঘ সনদের অপসোনাল প্রোটোকল অনুমোদন করতে হবে।
গুমের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট আইন প্রণয়ন করে গুমের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের বিচারের সম্মুখীন করতে হবে এবং ভিকটিম পরিবারদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। কারা কর্মকর্তাদের অনিয়ম-অবহেলা-দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করে কারাবন্দীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়নসহ সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করতে হবে। সর্বস্তরে মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।

সাংবাদিকসহ সমস্ত মানবাধিকার কর্মীর বিরুদ্ধে দায়ের করা সব হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার করে তাদের ওপর হামলার ঘটনাগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে দোষী ব্যক্তিদের বিচারের সম্মুখীন করতে হবে। বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬, সন্ত্রাস দমন আইন ২০০৯ ও সাইবার নিরাপত্তা আইন ২০২৩ সহ সমস্ত নিবর্তনমূলক আইন অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।
নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা বন্ধে দ্রুততার সাথে অপরাধীদের বিচার করে শাস্তি দিতে হবে। ধর্ষণকারীসহ নারীদের ওপর সহিংসতাকারীদের বিষয়ে সালিস করা বন্ধ করতে হবে এবং নারীর বিচার প্রাপ্তির জন্য পুলিশকে সঠিকভাবে তদন্ত করে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করে বিচারের সম্মুখীন করতে হবে।
সীমান্তে বাংলাদেশী নাগরিকদের ভারতীয় বিএসএফ কর্তৃক হত্যা, নির্যাতনসহ সব ধরনের মানবাধিকার লঙ্ঘন বন্ধ করতে এবং ভিকটিমদের ক্ষতিপূরণ পাওয়ার ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ভারতের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে হবে। ভারতকে দুই দেশের মধ্যে সীমান্তসংক্রান্ত চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারক মেনে চলতে হবে। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের আধিপত্য এবং আগ্রাসী আচরণ বন্ধ করতে হবে।


আরো সংবাদ



premium cement