আ’লীগের সুপারিশে মাউশির ৩১৮৩ পদে জনবল নিয়োগ
ছাত্রলীগ ও যুবলীগের পরিচয় ও অর্থের বিনিময়ে চাকরি- শাহেদ মতিউর রহমান
- ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:২২, আপডেট: ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ০৮:৫৬
আওয়ামী লীগের দলীয় পরিচয় আর নেতাদের সুপারিশ নিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরে (মাউশি) চাকরি নিয়েছেন তিন হাজার ১৮৩ জন কর্মচারী। মাউশি ও এর অধস্তন দফতর এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ২৮টি ক্যাটাগরির বিভিন্ন পদে ২০২৩ সালের ২২ আগস্ট এবং ১৪ নভেম্বর চাকরিতে যোগদান করেন তারা। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ নেতাদের সুপারিশ কিংবা ৫ থেকে ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে চাকরি পেয়েছেন তারা। জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের কারণে তালিকায় থাকা বাকি ৬১০ জনকে নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। তবে আওয়ামী লীগের দেয়া তালিকার এই ৬১০ জনকে নিয়োগ দেয়ার প্রক্রিয়াও আবার শুরু হয়েছে। জুলাই বিপ্লবের মাত্র এক মাস আগে গত ৬ জুন অতি গোপনীয় এই তালিকার ৬১০ প্রার্থীর লিখিত ও ভাইভা পরীক্ষার ফল প্রকাশ করা হয়। জুলাই মাসে তাদেরও নিয়োগপত্র পাওয়ার কথা ছিল।
মাউশি কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, নিয়োগ পাওয়া ৩১৮৩ পদের এই কর্মচারীদের নিয়োগ পরীক্ষার আগেই তাদেরকে দেয়া হয়েছিল পরীক্ষায় পাস ও চাকরি পাওয়ার নিশ্চয়তা। আর এভাবে আওয়ামী লীগের দেয়া তালিকা ধরে মোট চার হাজার ১০৯ জন কর্মচারী নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধস্তন প্রতিষ্ঠান মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতর (মাউশি)। জুলাই-আগস্টে ছাত্রজনতার বিপ্লবের মাত্র দুই মাস আগে চূড়ান্ত করা হয়েছিল তাদের মনোনীত প্রার্থী বাছাইয়ের এই তালিকা। সেই তালিকার ৬১০ জন নিয়োগপত্র এখনো পায়নি। তবে ওই তালিকা বাতিলও করা হয়নি। শিগগিরই আওয়ামী লীগের প্রস্তুত করা আগের সেই তালিকা ধরেই তৃতীয় শ্রেণীর (গ্রেড-১০) কলেজের বিষয়ভিত্তিক প্রদর্শক পদে এই ৬১০ জন নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করার ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এই ধরনের নিয়োগে অর্থের লেনদেন বিষয়ে মাউশিতে একাধিক কর্মকর্তার সাথে আলাপ হলেও কোনো কর্মকর্তাই প্রকাশ্যে কোনো কথা বলতে চাননি।
সূত্র জানায়, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের অধীন সরকারি কলেজের জন্য দশটি বিষয়ে ৬১০ জন প্রদর্শক ও সমমানের পদে নিয়োগে ২০২০ সালের ২৭ আগস্ট নামকাওয়াস্তে ৭০ নম্বরের সাজানো এমসিকিউ পরীক্ষা নেয়া হয়। নিয়োগ কমিটির কেউ কেউ পূর্ণ ১০০ নম্বরের লিখিত পরীক্ষা নেয়ার পক্ষে থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। টাকার বিনিময়ে এবং ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদেরকে সরকারি কলেজগুলোতে নিয়োগ দিতে যাওয়া এই প্রদর্শকরাই পরবর্তীতে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারভুক্ত হয়ে থাকেন। পদোন্নতি পেয়ে তারা অধ্যাপকও হতে পারবেন। যদিও শিক্ষা ক্যাডারের সৎ কর্মকর্তারা কথিত ওই এমসিকিউ পরীক্ষা বাতিল করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইবিএর অধীনে লিখিত পরীক্ষা নেয়ার দাবি তুলেছিলেন সেই সময়েই।
সরকারি বিধিমালা অনুযায়ী, দশম থেকে দ্বাদশ গ্রেড পর্যন্ত দ্বিতীয় শ্রেণীর পদ। কিন্তু মাউশির নিয়োগবিধিতে এই পদগুলোকে তৃতীয় শ্রেণীর দেখিয়ে শুধু এমসিকিউ পরীক্ষা নেয়া হয়েছে। আওয়ামী আমলের পাঁচ সদস্যের নিয়োগ কমিটির সভাপতি ছিলেন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের কলেজ ও প্রশাসন শাখার তৎকালীন পরিচালক বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের অধ্যাপক বিতর্কিত নেতা মো: শাহেদুল খবির চৌধুরী। অধিফতরের তৎকালীন সাধারণ প্রশাসন শাখার উপপরিচালক বিপুল চন্দ্র বিশ্বাস সদস্যসচিব এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশন, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন করে কর্মকর্তা এর সদস্য ছিলেন। ৫ আগস্টের পর তাদের অনিয়ম দুর্নীতির কারণে সবাইকে অন্যত্র বদলি করে দেয়া হয়েছে।
সূত্র জানায়, পতিত আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বিপুলসংখ্যক কর্মচারী নিয়োগের সব প্রক্রিয়া শেষ করে চূড়ান্ত ফল ঘোষণার ঠিক আগেই ছাত্রজনতার বিপ্লবের মাধ্যমে স্বৈরাচার আওয়ালীগের পতন হয়। এরপর মাত্র এক মাসের ব্যবধানে আগের প্রস্তুত করা ৬১০ জনের নিয়োগ প্রক্রিয়াও স্থগিত হয়ে যায়। তবে শিগগিরই আগের সেই অসমাপ্ত নিয়োগ প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করা হচ্ছে। আগের বেশ কয়েকজন সুবিধাভোগী কর্মকর্তা বিষয়টি নিয়ে বেশ তোড়জোর করছেন বলেও জানা গেছে।
এ দিকে মাউশি সূত্রে জানা গেছে, সরকারি নিয়োগ বিধিতে গ্রেড-১০ থেকে গ্রেড-২০ পর্যন্ত (পূর্বতন তৃতীয় শ্রেণী থেকে চতুর্থ শ্রেণী) বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে ৪ হাজার ১০৯ পদে নিয়োগের জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ২০০৩ সালের ছাড়পত্রের মাধ্যমে (নং ৩৭০০০.০৬৭.১২.০০২.২০১৫-১২২) মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতর এবং অধিদফতরাধীন এসব পদে সরাসরি জনবল নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। তারই অংশ হিসেবে ২০২০ সালের ২২ অক্টোবর বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। বিজ্ঞপ্তিতে ২৮টি ক্যাটাগরির বিভিন্ন পদের মধ্যে প্রদর্শক পদে ৫১৪টি, গবেষণা সহকারী (কলেজ) পদে ২১টি, সহকারী গ্রন্থাগারিক কাম ক্যাটালগার পদে ৬৯টি এবং ল্যাবরেটরি সহকারী পদে ৬টি পদ উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। এসব পদের বিপরীতে যারা আবেদন করেছেন তাদের মধ্য থেকে প্রদর্শক পদের জন্য ২০২১ সালের ২৭ আগস্ট এবং অন্যান্য সহকারি পদে ২০২১ সালের ২২ অক্টোবর লিখিত (এমসিকিউ টাইপের) পরীক্ষা নেয়া হয়।
এই দুই পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ হয় ২০২৪ সালের ২৪ এপ্রিল। দুই পরীক্ষার এই ফলাফলে মোট ৭ হাজার ৯৭৩ জনকে উত্তীর্ণ দেখানো হয়। পরে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নিয়ে ২০২৪ সালের ৪ মে থেকে মৌখিক পরীক্ষা শুরু হয়ে ২৯ মে শেষ হয়। মাউশির সূত্র জানিয়েছে আগের লিখিত এবং ভাইভা উভয় পরীক্ষায় পাসের নিশ্চয়তায় নানা রকম লেনদেন বা বিনিময়ও হয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী ঘরানার লোকজনকে আনুকূল্য দিয়ে চাকরি পাইয়ে দেয়ার নিশ্চয়তাও দেয়া হয়েছে। কিন্তু চূড়ান্ত ফল ঘোষণার আগেই জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের কারণে ফলাফল আটকে যায়। যদিও গত তিন মাস অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নানামুখী কার্যক্রম ও পরিকল্পনার কারণে বিষয়টি নিয়ে আগের সুবিধাভোগী কর্মকর্তারা খুব একটা নড়াচড়া না দিলেও এখন নতুন করে নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করার কাজে নজর দিয়েছেন। তারা কৌশলে সরকারকে মিসগাইড করে ২০২২ সালের তালিকার আলোকে কর্মচারী নিয়োগে তোড়জোর শুরু করেছেন।
অপর দিকে মাউশির এই নিয়োগ প্রক্রিয়ার পদ ও শ্রেণিভিত্তিক তালিকা থেকে জানা যায়, গ্রেড ১৩ থেকে ১৬ পর্যন্ত ৯২৬ জন কর্মচারী নিয়োগ পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল ঘোষণা করা হয় ২০২৩ সালের ২২ আগস্ট। আর তাদের নিয়োগ দেয়া হয় ২০২৩ সালের ২২ ও ৩০ অক্টোবর। আবার গ্রেড ১৯ ও গ্রেড ২০ এর অধীনে ২২৫৭ কর্মচারীর নিয়োগ পরীক্ষার ফল ঘোষণা করা হয় ২০২৩ সালের ১৪ নভেম্বর এবং তাদের নিয়োগপত্র দেয়া হয় ২০২৪ সালের ১৮ জানুয়ারি। সর্বশেষ ১০ম গ্রেডের মোট ৬১০ জনের নিয়োগ পরীক্ষার ফল ঘোষণা করা হয় ২০২৪ সালের ২৪ মে।
মাউশিতে ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে চাকরি পাওয়াদের তালিকায় রয়েছেন কম্পিউটার অপারেটর ৯ জন, উচ্চমান সহকারী ৮৫ জন, ক্যাশিয়ার ১১৯ জন, স্টোরকিপার ৫০ জন, হিসাব সহকারী ১০৬ জন, অফিস সহকারী ৫১৩ জন, মেকানিক ৩৩ জন, গাড়িচালক ১১ জন, বুক সর্টার ৪৬ জন, অফিস সহায়ক ১৭০৪ জন, নিরাপত্তা প্রহরী ২৪৭ জন, মালী ৯৭ জন, পরিচ্ছন্নকর্মী ১৬৩ জন।
অন্য দিকে তালিকায় নিয়োগের অপেক্ষায় রয়েছেন প্রদর্শক পদে পদার্থবিদ্যায় ১০৯ জন, রসায়নে ১২০ জন, জীববিজ্ঞানে ৩১ জন, প্রাণিবিদ্যায় ১০৯ জন, উদ্ভিদবিদ্যায় ৯৬ জন, ভুগোলে ১৩ জন, মৃত্তিকায় ৫ জন, গণিতে ২২ জন, গার্হস্থ্য বিজ্ঞানে ৮ জন, কৃষিতে একজন, গবেষণা সহকারী (কলেজ) ২১ জন, সহকারী গ্রন্থাগারিক ৬৯ জন এবং ল্যাবরেটরি সহকারী ৬ জন।
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও অধিদফতরের কর্মকর্তারা এই প্রতিবেদককে বলেন, বর্তমানে জেলে থাকা সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি ও তার ভাই টিপু, চাঁদপুর পুরান বাজার ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ রতন কুমার মজুমদারসহ নিয়োগ বাণিজ্যে অভিযুক্ত মাউশির সংশ্লিষ্টদের বাছাইকৃত ছাত্রলীগ ও যুবলীগের প্রার্থীদের এমন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে দেওয়াটা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের চেতনার পরিপন্থী। তাই আওয়ামী সময়ের এমন ত্রুটিপূর্ণ পরীক্ষা বাতিল করে নতুন করে পরীক্ষা ও যোগ্যপ্রার্থীদের নিয়োগ দেয়া উচিত।
পতিত আওয়ামী আমলের প্রস্তুত করা এই কর্মচারীদের তালিকা থেকে যারা নিয়োগ পেয়েছেন এবং যারা নিয়োগ পাওয়ার জন্য তোড়জোর শুরু করেছেন তাদের নিয়োগ বাতিল করা হবে কি না এ বিষয়ে গতকাল বিকেলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রফেসর এ বি এম রেজাউল করীম নয়া দিগন্তকে জানান, বিষয়টি সংস্থাপন মস্ত্রণালয়ের এখতিয়ারধীন। তবে আগের সময়ে (আওয়ামী লীগের আমলে) এমন কোনো তালিকা হয়েছিল কি না সে বিষয়েও আমার কিছু জানা নেই। আমি নিয়োগ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত ছিলাম না। কাজেই এর বেশি আর কিছুই আমি জানি না। তবে যেহেতু বিষয়টি সংস্থাপন মন্ত্রণালয় দেখভাল করে তারাই এই বিষয়টি নিয়ে সঠিক সমাধান দিতে পারবে।