১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার আহ্বান জানিয়ে ড. ইউনূসকে সিপিজের চিঠি

-

বাংলাদেশে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা রক্ষার আহ্বান জানিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে চিঠি দিয়েছে কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্ট (সিপিজে)। সিপিজের নিজেস্ব ওয়েবসাইটে বলা হয়, গত ৪ নভেম্বর অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয় আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিলের ঘোষণা দিয়েছে। আইনটি ২০২৩ সালে পাস করা হয়। এই আইনের আগের নাম ছিল ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন। বাংলাদেশের আগের সরকারের অধীনে সাংবাদিকদের ওপর দমন-পীড়ন চালানোর হাতিয়ার হিসেবে বারবার এই আইনের ব্যবহার হয়েছে। বেশ কয়েকজন সাংবাদিককে ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার দল আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে মনে করা হয়। যাদের বিগত সময়ের কাজের জন্য পুলিশি তদন্ত চলছে। এ ছাড়া অক্টোবরের শেষের দিকে এবং নভেম্বরের শুরুর দিকে এসব সাংবাদিকের অনেকেরই প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকারের তথ্য মন্ত্রণালয়। যাদের অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল করা হয়েছে তাদের চারজন এখনো কারাগারে রয়েছেন।

ড. ইউনূসকে লেখা চিঠিতে তার এসব কাজের প্রশংসা করা হয়েছে। পাশাপাশি সাংবাদিকদের হয়রানি না করার ক্ষেত্রে বিভিন্ন পরামর্শও তুলে ধরা হয়েছে। ইউনূসের কাছে চিঠিটি লিখেছেন সিপিজের প্রধান নির্বাহী জোডি গিন্সবার্গ। চিঠিতে তিনি বলেছেন, কমিটি টু প্রটেক্ট জার্নালিস্টের সাথে (সিপিজে) বৈঠক করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। এটি একটি স্বাধীন বেসরকারি সংস্থা। যার কাজ হচ্ছে বিশ্বব্যাপী গণমাধ্যমের স্বাধীনতার পক্ষে সমর্থন দেয়া। সংবাদপত্রের স্বাধীনতার প্রতি আপনার প্রতিশ্রুতি শুনে আমি সন্তুষ্ট হয়েছি।
চিঠিতে ড. ইউনূসের কাছে বাংলাদেশের সংবাদপত্রের ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার সমুন্নত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন জোডি গিন্সবার্গ। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক চুক্তিতে যেসব মানবাধিকারের বিষয় সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার যেন পদক্ষেপ নেয়। এ ক্ষেত্রে সিপিজের প্রধান বেশ কিছু পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশের দমনমূলক আইনটিকে অবিলম্বে বাতিল করতে হবে। বিশেষ করে ১৯২৩ সালে ঔপনিবেশিক যুগে করা ফৌজদারি মানহানি বিষয়ক আইন সংশোধন বা পুরোপুরি বাতিলের আহ্বান জানিয়েছে সিপিজে। হাসিনার আমলে করা সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করার লক্ষ্যে সাম্প্রতিক অন্তর্বর্তী সরকার যে ঘোষণা দিয়েছে, সেটিকে অভিনন্দন জানিয়েছেন জোডি গিন্সবার্গ। যেটি গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রথম ২০১৮ সালে প্রণয়ন করে হাসিনা সরকার।
এ ছাড়া সাংবাদিকদের কাজের প্রতিশোধ নিতে তাদের বিরুদ্ধে করা যে মামলা হয়েছে তা প্রত্যাহারের আহ্বান জনানো হয়েছে সিপিজের চিঠিতে। সেখানে বলা হয়েছে, ২০০৬ সালের ইনফরমেশন এবং কমিউনিকেশন টেকনলোজি আইনের পরিবর্তে সংবিধানের ৫৭ ধারার অধীনে যেসব মামলা হয়েছে সেগুলো বাতিল করে সাংবাদিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

২০২০ সালে ইন্টারন্যাশনাল প্রেস ফ্রিডম অ্যাওয়ার্ড জয়ী বাংলাদেশের প্রখ্যাত ফটোসাংবাদিক শহীদুল আলম এবং প্রথম আলোর পলাশ কুমার দে’র বিরুদ্ধে এসব ধারায় মামলা হয়েছিল। ঢাকাভিত্তিক থিংক ট্যাংক সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের তথ্যানুসারে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধীনে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে চার শতাধিক মামলা দায়ের করা হয়েছিল।
আওয়ামীপন্থী যেসব সাংবাদিককে আটক করা হয়েছে, তাদের বিচারের ক্ষেত্রে মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করারও আহ্বান জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, ফারজানা রুপা, শাকিল আহমেদ, মোজাম্মেল বাবু এবং শ্যামল দত্তের মতো আওয়ামীপন্থী চারজন কারাবন্দী সাংবাদিকের বিচারিক কার্যে যেন মানবাধিকার নিশ্চিত করা হয় সে বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকারকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
এ ছাড়া সাম্প্রতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর হামলার স্বাধীন ও স্বচ্ছ তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে সিপিজে। বিশেষ করে ২০২৪ জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নিহত সাংবাদিক হাসান মেহেদী এবং মোহাম্মদ তুরাবের ঘটনাকে সঠিক তদন্ত নিশ্চিত করতে হবে। আলোচিত সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করে তার সঠিক বিচার সম্পন্ন করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
এ ছাড়াও সাংবাদিকদের ওপর আইন প্রয়োগকারী সংস্থার অযাচিত নজরদারি এবং হয়রানি বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েন সিপিজের প্রধান। বিশেষ করে যেসব সাংবাদিক রোহিঙ্গা এলাকা এবং চট্টগ্রামের পার্বত্য এলাকায় গিয়ে সংবাদ সংগ্রহ করে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান তিনি।

সিপিজের প্রধান নির্বাহী জোডি গিন্সবার্গ ড. ইউনূসকে লেখা চিঠিতে বলেন, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে এবং সাংবাদিকদের সুরক্ষা দিতে গণমাধ্যম বিশ্লেষক এবং সুশীল সমাজের সাথে আলোচনার মাধ্যমে নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে। যেন সাংবাদিকরা কোনো ধরনের ভয়ভীতি ছাড়াই তাদের কাজ করতে পারে।
অন্তর্বর্তী সরকারপ্রধানকে জোডি গিন্সবার্গ আরো কয়েকটি বিষয়ে নজর দেয়ার অনুরোধ জানান। যার মধ্যে রয়েছে, প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন পুনর্নবায়ন করা, যাতে সাংবাদিকদের ওপর অযাচিত কোনো বিধিনিষেধ থাকবে না। বিদেশী সাংবদিকদের ভিসার উপর যেন কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকে সে দিকেও নজর দিতে ড. ইউনূসকে আহ্বান জানিান জোডি। কেননা আগের সরকারের আমলে বিদেশী সাংবাদিকরা তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে বেশ বাধার সম্মুখীন হতেন।
চিঠির শেষে ড. ইউনূসকে ধন্যবাদ জানিয়ে সিপিজে প্রধান বলেন, আপনার অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে বাংলাদেশের নাগরিকদের অধিকারের সুযোগ দিচ্ছে, পরবর্তী সরকারও যেন এমন আইন ও সাংবিধানিক কাঠামোর উত্তরাধিকারী হয়। এ ছাড়া দেশের এই সঙ্কটকালে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যেন সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং জনগণের তথ্যের অধিকারকে সম্মান করে তা নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছে সিপিজে।


আরো সংবাদ



premium cement