১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ কার্তিক ১৪৩১, ১০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`
পাচারকৃত অর্থ ফেরাতে সিঙ্গাপুরের সহায়তা চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা

সিঙ্গাপুরের সাথে এফটিএ স্বাক্ষরের আনুষ্ঠানিকতা শুরু

প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে গতকাল সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান সাক্ষাৎ করেন : পিআইডি -


খুব শিগগিরই সিঙ্গাপুরের সাথে ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট (এফটিএ) স্বাক্ষর করবে বাংলাদেশ। এরই মধ্যে সিঙ্গাপুরের সাথে এফটিএ স্বাক্ষরের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেছে সরকার। এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার অংশ হিসেবে সিঙ্গাপুরের সাথে এফটিএ সই করা হবে। শুধু সিঙ্গাপুরের সাথেই নয়, যত দেশের সাথে সম্ভব সবগুলোর সাথেই এফটিএ স্বাক্ষর করা হবে।
এদিকে বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া বিলিয়ন ডলার পুনরুদ্ধার এবং বাংলাদেশ থেকে অভিবাসনের ব্যয় কমাতে সহায়তা করার জন্য সিঙ্গাপুরের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
গতকাল রোববার বাংলাদেশে নিযুক্ত সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রদূত ডেরেক লো রাজধানীর তেজগাঁও কার্যালয়ে প্রধান উপদেষ্টার সাথে সাক্ষাৎ করেন। প্রায় ঘণ্টাব্যাপী আলোচনায় অধ্যাপক ইউনূস রাষ্ট্রদূত লো’কে বলেন, বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুরসহ অনেক দেশে প্রচুর অর্থ পাচার করা হয়েছে। সিঙ্গাপুরের কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা প্রয়োজন আমাদের’। রাষ্ট্রদূত লো সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেন।
অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিয়োগের খরচ উল্লেখযোগ্যভাবে কমানোর লক্ষ্যে ঢাকার সাথে কাজ করার জন্য সিঙ্গাপুরের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, প্রবাসীরা যেন তাদের পরিবারের কাছে আরো বেশি অর্থ পাঠাতে পারে সে লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অভিবাসনের ব্যয় কমিয়ে আনতে চায়। আমরা সিঙ্গাপুরের সাথে নিয়োগের খরচ কমানোর জন্য একটি মডেল কাঠামো তৈরি করতে পারি।
রাষ্ট্রদূত সহায়তার আশ্বাস দিয়ে বাংলাদেশকে বৈদেশিক নিয়োগ ব্যবস্থাকে ডিজিটালাইজ করার পরামর্শ দেন যাতে করে মানব পাচার ও শ্রমিক শোষণের আশঙ্কা কমে যায়। দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ সহযোগিতা, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্র নীতি, শিপিং, শিক্ষা এবং নিজ নিজ জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিয়েও আলোচনা হয়েছে।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, স্বৈরাচারী সরকার পতনের মাত্র তিন মাসের মাথায় অর্থনীতি ভালোভাবে পুনরুদ্ধার করে বাংলাদেশ এখন ব্যবসার জন্য প্রস্তুত। এখন এদেশে ব্যবসা করার উপযুক্ত সময়।
সিঙ্গাপুরের বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র ডিরেক্টর ফ্রান্সিস চং বলেন, বাংলাদেশ ২০২১ সালে সিঙ্গাপুরের সাথে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির প্রস্তাব করেছিল। প্রস্তাবিত এফটিএর ওপর একটি সম্ভাব্যতা সমীক্ষা সম্পন্ন হয়েছে এবং উভয় দেশই এখন কীভাবে একটি মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা শুরু করা যায় তার সুযোগ নির্ধারণ করবে। লো বলেন, সিঙ্গাপুর পানি শোধন এবং বর্জ্য শক্তি ব্যবস্থাপনা বিষয়ে তাদের দক্ষতা ভাগাভাগি করতে পারলে খুশি হবে। তিনি উভয় দেশের খাদ্য সংস্থার মধ্যে সহযোগিতার প্রস্তাব করেন।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পররাষ্ট্রনীতি প্রসাথে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, তার সরকার প্রতিবেশীদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখছে এবং সার্ককে দক্ষিণ এশীয় প্রতিবেশীদের সাথে আরো ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে পুনরুজ্জীবিত করার চেষ্টা করছে। তিনি আসিয়ানের সেক্টরাল ডায়ালগ পার্টনার হিসেবে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তির জন্য সিঙ্গাপুরের সমর্থন চান। প্রতিক্রিয়ায় ডেরেক লো জানান, তার দেশ এ ব্যাপারে ইতিবাচক রয়েছে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা নেয়ার পর থেকে ঢাকা তার পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের মিত্রদের কাছ থেকে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছে। ‘আমরা পূর্ব এবং পশ্চিমের মধ্যে পার্থক্য করি না। আমাদের সর্বত্র সেতু নির্মাণ করতে হবে।
বৈঠকে আরো উপস্থিত ছিলেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, এসডিজি বিষয়ক সিনিয়র সচিব ও মুখ্য সমন্বয়ক লামিয়া মোরশেদ এবং ঢাকায় সিঙ্গাপুরের চার্জ ডি'অ্যাফেয়ার্স মাইকেল লি।

সিঙ্গাপুরের সাথে এফটিএ স্বাক্ষরের আনুষ্ঠানিকতা শুরু
গতকাল রোববার বিকেলে সচিবালয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সভাকক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এই চুক্তি সইয়ের আনুষ্ঠানিকতা শুরুর ঘোষণা দেয়া হয়। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনিই বলেন, যত দেশের সাথে পারি আমরা এফটিএ সই করব। আমরা চেষ্টা করছি আসিয়ানে যাওয়ার জন্য। সিঙ্গাপুর এ বিষয়ে সাহায্য করবে।
অর্থ উপদেষ্টা বলেন, সিঙ্গাপুর বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য একটি সম্ভাবনাময় এলাকা। পণ্য ছাড়াও সেবা ও বিনিয়োগ খাতেও সিঙ্গাপুরের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুরের মধ্যে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রাথমিকভাবে দুই দেশের মধ্যে মুক্তবাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত সিঙ্গাপুরের হাইকমিশনার ডেরেক লো বলেন, ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে সিঙ্গাপুরের জন্য বাংলাদেশ বিশেষ করে চট্টগ্রাম খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রামের বে-টার্মিনালে সিঙ্গাপুরের শিপিং কোম্পানি পিএসএ বিনিয়োগ করছে, বে-টার্মিনাল ট্রান্সফরমেশনের মাধ্যমে এটি আন্তর্জাতিক বৃহৎ বন্দরে উপনীত হবে। এ সূত্রে দু’দেশের মধ্যে ব্যবসাবাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে।
অনুষ্ঠানে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশ ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হবে। এ অর্জন বিশ্বে বাংলাদেশের ইতিবাচক ভাবমূর্তি সৃষ্টি এবং বিনিয়োগ ও বাণিজ্যে নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টির পাশাপাশি বেশ কিছু চ্যালেঞ্জও তৈরি করবে। যার মধ্যে স্বপ্লোন্নত দেশ হিসেবে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে পণ্য রফতানিকালে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার সুবিধা হারানো অন্যতম।

এর ফলে বাংলাদেশের রফতানি পণ্যকে ওই সব দেশের বাজারে প্রবেশের সময় সাধারণভাবে আরোপিত শুল্কের সম্মুখীন হতে হবে। ফলে ওই সব দেশে বাংলাদেশের রফতানিবাজার সঙ্কোচনের আশঙ্কা রয়েছে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। বাংলাদেশের এলডিসি গ্র্যাজুয়েশন পরবর্তী সম্ভাব্য চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশের রফতানিবাজার সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন দেশ ও ট্রেড ব্লকের সাথে আঞ্চলিক বাণিজ্যচুক্তি সম্পাদনের উদ্যোগ গ্রহণ অন্যতম।
সিঙ্গাপুর বিশ্বের ৩২তম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ এবং এটি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক অংশীদার। সিঙ্গাপুর বিশ্বের অন্যতম বাণিজ্যিক কেন্দ্র। সিঙ্গাপুর বাংলাদেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণের জন্য একটি সম্ভাবনাময় এলাকা। পণ্য ছাড়াও সেবা ও বিনিয়োগ খাতেও সিঙ্গাপুরের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক উন্নয়নের সম্ভাবনা রয়েছে। এ উদ্যোগের অংশ হিসেবে সিঙ্গাপুর ও বাংলাদেশ নিজ নিজ পক্ষে সম্ভাব্যতা সমীক্ষা পরিচালনা করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল উভয় দেশ নেগোসিয়েশন শুরুর অনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদান করে।
যৌথ ঘোষণায় বাণিজ্য উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ, প্রধান উপদেষ্টার পররাষ্ট্রবিষয়ক বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী, বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহা: সেলিম উদ্দিন, বাংলাদেশে নিযুক্ত সিঙ্গাপুরের হাইকমিশনার ডেরেক লো এবং সফররত সিঙ্গাপুরের প্রতিনিধিদল ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

প্রধান উপদেষ্টার সাথে সেনা প্রধানের সাক্ষাৎ : অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। গতকাল রোববার প্রধান উপদেষ্টার তেজগাঁও কার্যালয়ে এ সাক্ষাৎ অনুষ্ঠিত হয়। পরে বিষয়টি নিশ্চিত করে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, রোববার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে তার কার্যালয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান।
সাক্ষাৎকালে সেনাবাহিনী প্রধান দেশের সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও সেনাবাহিনীর কার্যক্রম সম্পর্কে প্রধান উপদেষ্টাকে অবহিত করেন। এ সময় প্রধান উপদেষ্টা সেনাবাহিনী প্রধানকে প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেন। এর আগে গত ২৬ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সফর সম্পর্কে জানাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন সেনাপ্রধান।

 


আরো সংবাদ



premium cement