ফ্যাসিবাদ রুখতে নির্বাচন জরুরি
নেতাকর্মীর ঢলে জনসমুদ্র রাজধানী- বিশেষ সংবাদদাতা
- ০৯ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৩০
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাজধানীতে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ র্যালি করেছে বিএনপি। জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উপলক্ষে গতকাল শুক্রবার বিকেলে এ বর্ণাঢ্য র্যালিতে রীতিমতো নেতাকর্মীর ঢল নামে। নয়া পল্টন থেকে মানিক মিয়া এভিনিউ পর্যন্ত দীর্ঘ ছয় কিলোমিটার পথ ছিল নেতাকর্মীদের স্লোগানে উত্তাল। দলীয় কার্যালয়ের সামনে লন্ডন থেকে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এ র্যালির উদ্বোধন করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ সময় বক্তব্যে তিনি গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্র এখনো থেমে নেই উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে জনগণকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদ রুখতে জনগণের সরাসরি ভোটে নির্বাচন জরুরি।
তারেক রহমান বলেন, স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণকে আমি একটি বিষয় আবারো স্মরণ করিয়ে সতর্ক থাকতে অনুরোধ জানাতে চাই, আমি নিজেও সতর্ক থাকতে চাই। সেটি হলো- গণতন্ত্রবিরোধী অপশক্তির ষড়যন্ত্র এখনো কিন্তু থেমে নেই। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে ব্যর্থ করে দিতে পলাতক স্বৈরাচারের দোসররা দেশে-বিদেশে, শাসনে-প্রশাসনে এখনো সক্রিয়। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে কোনোভাবেই ব্যর্থ হতে দেয়া যাবে না। নিজেদেরকে সতর্ক করতে চাইলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জনগণের প্রত্যাশা পূরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে, এটি আজ জনগণের চাওয়া। এই লাখো জনতার মিছিলকে কোনোভাবেই বৃথা যেতে দেয়া যাবে না। তিনি বলেন, রাজধানী ঢাকার রাজপথে আজ লাখো জনতার মিছিল, দেশের পক্ষের শক্তিকে ৭ নভেম্বরের অন্তর্নিহিত শিক্ষায় দীক্ষিত করার মিছিল এটি। লাখো জনতার আজকের এই মিছিল ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে আহত এবং অসংখ্য ছাত্র-জনতা ও হাজারো শহীদের স্বপ্নে একটি বৈষম্যহীন গণতান্ত্রিক মানবিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ী মিছিল। এটি রাজধানীর রাজপথে কারোর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ঝড় তোলার মিছিল নয় বরং দেশের স্বার্থ রক্ষার মিছিল। নিজের ভোট প্রয়োগের অধিকার আদায়ের মিছিল, নিজের অধিকার রক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার মিছিল।
মানুষের ভোটের অধিকার নিশ্চিত করার পক্ষে অবস্থান তুলে ধরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেন, ‘স্বৈরাচার বা ফ্যাসিবাদমুক্ত পরিবেশেও স্বল্প আয়ের মানুষদের বাজার সিন্ডিকেটের অভিশাপ থেকে মুক্ত করা অসম্ভব হয়ে পড়বে, যদি না আমরা মানুষের সরাসরি ভোটের অধিকার নিশ্চিত করতে পারি।’ তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশে আর কখনো যেন ফ্যাসিবাদ স্বৈরাচার ফিরে আসতে না পারে, সে জন্য প্রতিটি নাগরিকের সরাসরি ভোট দিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের সক্ষমতা অর্জন জরুরি। স্থানীয় সরকার থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত নির্বাচিত হতে ইচ্ছুক জনপ্রতিনিধিদের জনগণের ভোটের প্রতি মুখাপেক্ষী না করা পর্যন্ত জনগণ গণতন্ত্রের সুফল পাবে না। ছাত্র-জনতার বিপ্লবে ফ্যাসিবাদের পতন হওয়ায় জনগণকে অভিনন্দনও জানান তিনি।
তারেক রহমান বলেন, ‘১৯৭৫ সালের ৭ নভেম্বর ছিল শত্রু-মিত্র চেনার দিন। আর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের শত্রু চিহ্নিত করার দিন। বাংলাদেশের পক্ষের শক্তি ঐক্যবদ্ধ থাকলে আর কেউ দেশের স্বাধীনতাকে বিপন্ন করতে পারবে না ইনশা আল্লাহ।’
ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ৭ নভেম্বরের র্যালির কর্মসূচি বিএনপিকে নানা শর্তসাপেক্ষে সংক্ষিপ্তভাবে করতে হতো। র্যালি ও সড়ক ব্যবহারের অনুমতি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখত পুলিশ। তখন পুলিশের অনুমতি নিয়ে নয়াপল্টন থেকে শান্তিনগর মোড় পর্যন্ত কয়েকটি র্যালি করেছিল বিএনপি। এই রুটের বাইরে এক যুগের বেশি সময় পরে এই প্রথম মানিক মিয়া এভিনিউ পর্যন্ত র্যালি করেছে বিএনপি। ফকিরেরপুল থেকে কাকরাইল পর্যন্ত হাজার হাজার নেতাকর্মীর এই সমাবেশ একপর্যায়ে জনসমুদ্রে রূপ নেয়। বিকেল পৌনে ৪টায় নয়াপল্টন থেকে র্যালি শুরু হয়। কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল রেস্তোরাঁর মোড় থেকে শুরু হওয়া র্যালিটি কাকরাইল মোড়-কাকরাইল মসজিদ-মৎস্যভবন-ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট-শাহবাগ-হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-বাংলামোটর-কারওয়ান বাজার-ফার্মগেট হয়ে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে গিয়ে সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সমাপনী বক্তব্যের মধ্য দিয়ে শেষ হয়।
মির্জা ফখরুলসহ দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস, আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, অধ্যাপক ডা: এ জেড এম জাহিদ হোসেন, সিনিয়র নেতা মোহাম্মদ শাহজাহান, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, আবদুল আউয়াল মিন্টু, আহমেদ আজম খান, আবদুস সালাম, কেন্দ্রীয় নেতা মাসুদ আহমেদ তালুকদার, মজিবুর রহমান সারোয়ার, খায়রুল কবির খোকন, শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি, আবদুস সালাম আজাদ, রশিদুজ্জামান মিল্লাত, শামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস, নাসির উদ্দিন অসীম, শিরিন সুলতানা, মীর সরফত আলী সপু, মীর নেওয়াজ আলী, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, ডা: রফিকুল ইসলাম, সাইফুল আলম নিরব, রকিবুল ইসলাম বকুল, নিলুফার চৌধুরী মনি, তাইফুল ইসলাম টিপু, রফিকুল আলম মজনু, আমিনুল হক, আব্দুল মোনায়েম মুন্না, নুরুল ইসলাম নয়ন, এস এম জিলানি, রাজীব আহসান, হাসান জাফির তুহিন, রাকিকুল ইসলাম রাকিব, নাছির উদ্দীন নাছির, নিপুণ রায় চৌধুরীসহ কেন্দ্রীয় ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা র্যালিতে ছিলেন।
বিএনপি মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা একটি খোলা ট্রাকে এই মিছিলে অংশ নেন। বিএনপির ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের সকল থানা ও ওয়ার্ডসহ মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইল, নরসিংদী জেলা থেকে বাসে করে আসা নেতাকর্মীরা এই র্যালিতে অংশ নেয়। বর্ণাঢ্য র্যালিতে নেতাকর্মীদের হাতে ছিল ধানের শীষের ছড়া, জাতীয় পতাকা, বিএনপির দলীয় পতাকা ও নানা রঙের উৎসব পতাকা। বিভিন্ন পথ ধরে র্যালি চলার সময়ে রাস্তার দুই পাশে হাজার হাজার মানুষ করতালি দিয়ে বিএনপির নেতাকর্মীদের অভিনন্দন জানায়। নেতারাও হাত তুলে দর্শকদের অভিবাদনের জবাব দেন।
র্যালিপূর্ব সংক্ষিপ্ত সমাবেশের সভাপতি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই ৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার দিন, ৭ নভেম্বর ছিল বাংলাদেশকে আধিপত্যবাদের কবল থেকে মুক্ত করার দিন। তিনি বলেন, ৭ নভেম্বরের আগে ৩রা নভেম্বর একটা অভ্যুত্থান হয়েছিল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে। তার লক্ষ্য ছিল আবার আধিপত্যবাদকে প্রতিষ্ঠা করা, ওই একদলীয় শাসনে দেশকে নিয়ে যাওয়া। এ দেশের দেশপ্রেমিক সৈনিক ও জনগণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে তাদেরকে পরাজিত করে সেদিন স্বাধীনতার ঘোষক বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রবক্তা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব দিয়ে বাংলাদেশের জনগণ এক নতুন ইতিহাস রচিত করে। সেই ইতিহাস ছিল বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ইতিহাস, বাংলাদেশকে আধুনিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস, দেশের মানুষকে একটা স্বাতন্ত্র্য পরিচিতি দেয়ার ইতিহাস।
তিনি আরো বলেন, আজকে এ বছর আমরা আরেকটা অভ্যুত্থান দেখেছি- ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান। দীর্ঘ ১৭ বছর আমরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছি, সংগ্রাম করেছি। এই ১৭ বছরে আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক কাঠামো ধবংস করে দিয়েছিল। বাংলাদেশকে একটা লুটপাটের রাজত্বে মাফিয়া রাষ্ট্রে পরিণত করেছিল। শেখ হাসিনা তার পরিবার ও তার সহকর্মীদের নিয়ে এ দেশকে লুটপাট করেছে। আল্লাহর অশেষ রহমত, আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করি- জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে, ছাত্র-জনতার অভূতপূর্ব এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নতুন এক বাংলাদেশ সৃষ্টি করার প্রয়াস পায়। অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পালিয়ে গেলেও তার দোসররা দেশের সর্বত্র ঘাপটি মেরে বসে আছে উল্লেখ করে তাদের বিরুদ্ধে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব।
এ দিকে রাজধানী ছাড়াও বিভাগীয় শহরগুলোতে গতকাল একযোগে বর্ণাঢ্য র্যালির এই কর্মসূচি পালিত হয়েছে।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা