০৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ কার্তিক ১৪৩১, ৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
`

রাখাইনে অর্থনীতি ভেঙে পড়ায় দুর্ভিক্ষ আসন্ন : জাতিসঙ্ঘ

-


মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সঙ্ঘাতে অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ায় সেখানে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছে জাতিসঙ্ঘ। ইউএনডিপি রাখাইনের জনগণের জন্য অপ্রত্যাশীত এ সঙ্কট সম্পর্কে সতর্ক করে বলছে, আরাকান সেনাবাহিনী ও মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর মধ্যে লড়াই অব্যাহত থাকায় এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অনলাইন মিডিয়া ডিপ্লোম্যাট বলছে, রাখাইন রাজ্যে চলমান সঙ্ঘাতের কারণে আয় কমে যাওয়া এবং কর্মসংস্থান ও কৃষি উৎপাদনে বাধার কারণে সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষের মুখে পড়তে পারে বলে জাতিসঙ্ঘ সতর্ক করে একটি প্রতিবেদনে বলছে, রাখাইন রাজ্যের অর্থনীতি কার্যকরভাবে বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ সেখানকার অন্যতম অর্থকরি ফসল ধানের চাষ কমে গেছে এবং সামরিক-আরোপিত বাণিজ্য বিধিনিষেধ মারাত্মক খাদ্যঘাটতি এবং উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির দিকে মিয়ানমারের এ রাজ্যটিকে ঠেলে দিয়েছে। ইউএনডিপি বলছে, ‘রাখাইন একটি অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে, এ অবস্থা চলতে থাকলে এবং যথেষ্ট মানবিক সহায়তা ছাড়া আগামী বছরের মাঝামাঝি নাগাদ দুর্ভিক্ষকে আর ঠেকানো সম্ভব হবে না।
রাখাইন রাজ্য ২০২৩ সালের নভেম্বর থেকে সঙ্ঘাতের মধ্যে পড়ে। জাতিগত রাখাইন সশস্ত্র গোষ্ঠী, আরাকান আর্মি ২০২১ সালে দেশটিতে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জান্তা সরকার ক্ষমতায় বসার পর যুদ্ধবিরতি ভঙ্গ করে সনাবাহিনীর অবস্থানগুলোতে আক্রমণ শুরু করে। এরপর আরাকান আর্মি আরাকান রাজ্যের উত্তরাঞ্চলের বেশির ভাগ অংশে তার কার্যকর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে কিন্তু মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাজ্যটিকে তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করার কারণে লড়াই ক্রমাগত তীব্রতর হচ্ছে।

কয়েক হাজার বাসিন্দার বাস্তুচ্যুত ছাড়াও, এই সঙ্ঘাত রাখাইন রাজ্যের অর্থনীতিতে একটি উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে। জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদনে ‘আন্তঃসংযুক্ত উন্নয়নের শৃঙ্খল’ এর ক্ষতিকারক প্রভাব হিসেবে আন্তর্জাতিক এবং অভ্যন্তরীণ সীমানা পেরিয়ে রাজ্যে পণ্য প্রবেশের ওপর বিধিনিষেধ, উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, অভ্যন্তরীণ খাদ্য উৎপাদন ধসে পড়া এবং প্রয়োজনীয় পরিষেবার অভাবের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে তাই বলা হয়েছে, ‘ইতোমধ্যে একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ জনসংখ্যা রাখাইনে আগামী মাসগুলোতে পতনের দ্বারপ্রান্তে থাকতে পারে।’
ইউএনডিপির মতে, আরাকান আর্মির সাথে সংঘর্ষের কারণে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের সাথে রাখাইন সীমান্তকে বন্ধ করতে প্ররোচিত করেছে এবং চারটি প্রতিবেশী অঞ্চল : চিন রাজ্য, ম্যাগওয়ে অঞ্চল, বাগো অঞ্চল ও আইয়ারওয়াদি অঞ্চলে একই ধরনের অচল সীমান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ফলস্বরূপ, রাখাইনে প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ আনার জন্য এখন মাত্র দু’টি বাণিজ্য রুট রয়েছে।
একইসাথে, রাখাইন রাজ্যে অভ্যন্তরীণ ধানের উৎপাদন ‘নি¤œমান’ হচ্ছে ‘বীজ, সারের অভাব, আবহাওয়ার তীব্র পরিস্থিতি’ এবং রাখাইনে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যার অত্যধিক বৃদ্ধি ঘটছে। ইউএনডিপি ভবিষ্যদ্বাণী করেছে যে ২০২৪ সালে রাখাইনে প্রায় ৯৭ হাজার টন ধান চাষ করা হবে, যা গত বছরের ২ লাখ ৮২ হাজার টন থেকে কম। এটি ‘মার্চ-এপ্রিল ২০২৫ এর মধ্যে শুধু ২০ শতাংশের চাহিদা পূরণ করবে, সতর্ক করা হচ্ছে যে, ধানের উৎপাদন হ্রাসের কারণে দুই মিলিয়নেরও বেশি মানুষকে অনাহারের ঝুঁকিতে ফেলেছে।

এই উভয় কারণের পাশাপাশি নির্মাণ খাতের পতন, রাজ্যের কর্মসংস্থানের অন্যতম প্রধান উৎস, যা প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে সিমেন্ট আমদানি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, রাখাইনে অনেক বাসিন্দার আয় বন্ধ হয়ে গেছে। ইউএনডিপির গবেষণা পরামর্শ দিচ্ছে যে রাখাইনের অর্ধেকেরও বেশি পরিবার বা প্রায় ১.৪ মিলিয়ন মানুষ, তাদের মাসিক আয় ৬৬ হাচজার ৬০০ কিয়াট (৩১.৭০ ডলার) থেকে প্রায় ৪৬ হাজার ৬২০ কিয়াটে (২২.২১ ডলার) নেমে গেছে। এর কারণ লড়াই তীব্র হয়েছে।
একই সময়ে, পণ্য ঘাটতি কিছু ক্ষেত্রে শতভাগ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। ইউএন ওয়ার্ল্ডের মূল্য পর্যবেক্ষণের তথ্য অনুসারে, এই বছরের জুলাইয়ের মধ্যে, উদাহরণস্বরূপ, মংডুতে চালের দাম ৯৪৪ শতাংশ, টুংআপে ৪৮৭ শতাংশ, মায়েবনে ৪১১ ও সিটওয়েতে ৪০৪ শতাংশ বেড়েছে। প্রতিবেদনে রান্নার তেল ও পরিবহন খরচ একইভাবে বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এর পাশাপাশি বিশেষ ঝুঁকি হিসেবে রয়েছে দীর্ঘ নির্যাতিত রোহিঙ্গা মুসলিম সংখ্যালঘু, যারা অতীতে জাতিগত রাখাইন জাতীয়তাবাদী এবং মিয়ানমার সেনাবাহিনী উভয়ের দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়েছে এবং জাতিসঙ্ঘের অনুমান অনুযায়ী ৫ লাখ ১১ হাজার মানুষ এখন রাখাইন রাজ্যে বাস্তুচ্যুত হয়েছে।
ইউএনডিপির প্রতিবেদনে গুরুতর সমস্যা হিসেবে পশ্চিম মিয়ানমারে এখন যে মানবিক সঙ্কটের কথা বলা হয়েছে তা হচ্ছে জরুরি পদক্ষেপ ছাড়াই ৯৫ শতাংশ জনসংখ্যা বেঁচে থাকার অস্থিতিশীল পরিস্থিতির মধ্যে পড়বে যেখানে অভ্যন্তরীণ উৎপাদনে ব্যাপক হ্রাস, পণ্যের আকাশছোঁয়া দাম, ব্যাপক বেকারত্ব এবং বর্ধিত নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে ওই বিশাল জনগোষ্ঠীকে দিশেহারা অবস্থায় থাকতে হবে। এও বলা হচ্ছে, বাণিজ্য রুট বন্ধ এবং সাহায্যের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞার সাথে, রাখাইন গভীর মানবিক দুর্ভোগের সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন অঞ্চলে পরিণত হওয়ার ঝুঁকিকে রয়েছে।

 


আরো সংবাদ



premium cement