০৭ নভেম্বর ২০২৪, ২২ কার্তিক ১৪৩১, empty
`

ট্রাম্পের রেকর্ড প্রত্যাবর্তন

নির্বাচনে জয়ের পর ট্রাম্প পরিবার : সিএনএন -


দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেন রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিনি চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউজ নিশ্চিত করেছেন ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসকে হারিয়ে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হতে ইলেক্টোরাল কলেজের ৫৩৮টি ভোটের মধ্যে ২৭০টি পেলেই চলে। সর্বশেষ প্রাপ্ত ফলে ট্রাম্প জিতে নিয়েছেন ২৭৯টি ইলেক্টোরাল ভোট। আর কমলা পেয়েছেন ২২৩ ভোট। বিবিসি, রয়টার্স, সিএনএন ও আলজাজিরা।
৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প নানা নিরিখেই দেশটিতে ইতিহাস গড়লেন। নিউ ইয়র্কের এই ধনকুবেরকে ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিয়ে বিশ্বকে আরো একবার হতবাক করল যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ। ট্রাম্পের এই জয়ের মধ্য দিয়ে একবার হেরে যাওয়ার পর দ্বিতীয় চেষ্টায় প্রেসিডেন্ট হওয়ার দ্বিতীয় ঘটনা ঘটল যুক্তরাষ্ট্রে। তার আগে এই রেকর্ড ছিল কেবল গ্রোভার ক্লিভল্যান্ডের। ১৮৮৮ সালে নির্বাচনে হেরে গিয়ে চার বছর পর ফের তিনি জয়ী হয়েছিলেন ১৮৯২ সালে।

ইলেক্টোরালের পর পপুলার ভোটেও জয়ী : অনানুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ী ট্রাম্প ইলেক্টোরাল ভোটের পাশাপাশি পপুলার বা জনসাধারণের ভোটেও নিজের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কমলা হ্যারিসের চেয়ে অনেকখানি এগিয়ে আছেন ট্রাম্প। কমলার সাথে তার ভোটের ব্যবধান ৫০ লাখেরও বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের ভোটের চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারিত হয় ইলেক্টোরাল কলেজ নামের একটি বিশেষ নির্বাচক মণ্ডলীর ভোটের মাধ্যমে। আবার ইলেক্টোরাল কলেজের ভোট নির্ভর করে সাধারণ ভোটারদের ভোটের ফলাফলের ওপর। এই ভোটকেই বলা হয় পপুলার ভোট।

ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটের সংখ্যা মোট ৫৩৮টি। কোনো প্রার্থী যদি বিজয়ী হতে চান, তাহলে তাকে অন্তত ২৭০টি ভোট পেতে জয়ী হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের মধ্যে সবগুলোর ফলাফল এখনো ঘোষণা করা হয়নি, তবে বিবিসি, সিএনএন এবং অন্যান্য প্রথম সারির সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্য অনুযায়ী, এ পর্যন্ত ইলেক্টোরাল কলেজের ২৭৯টি ভোট পেয়েছেন ট্রাম্প। অন্য দিকে কমলা পেয়েছেন ২২৩টি ভোট।
সংবাদমাধ্যমগুলো আরো জানিয়েছে, ইলেক্টোরাল ভোটের পাশাপাশি পপুলার ভোটেও কমালার চেয়ে অনেকখানি এগিয়ে আছেন ট্রাম্প। তিনি পেয়েছেন ৬ কোটি ৯৬ লাখ ৯৮ হাজার ১০৬টি ভোট, আর কমলা পেয়েছেন ৬ কোটি ৪৪ লাখ ২৭ হাজার ৩৭৮টি ভোট। অর্থাৎ কমলার চেয়ে ৫২ লাখ ৭০ হাজার ৭২৮ ভোট বেশি পেয়েছেন ট্রাম্প। ট্রাম্পের ক্ষেত্রে এই প্রথম এমন ঘটল। ২০১৬ সালের যে নির্বাচনে নির্বাচনে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হিলারি ক্লিনটনকে পরাজিত করেছিলেন তিনি, সেবার ইলেক্টোরাল কলেজের ভোটে এগিয়ে থাকলেও পপুলার ভোটে বেশ পিছিয়ে ছিলেন। হিলারির সাথে তার প্রাপ্ত ভোটের ব্যবধান ছিল ৩০ লাখেরও বেশি।
ট্রাম্প হতে যাচ্ছেন ফৌজদারি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম প্রেসিডেন্ট। ‘মেইক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ স্লোগান নিয়ে ২০১৬ সালের নির্বাচনে রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পর দুইবার অভিশংসিত হয়েছিলেন ট্রাম্প।

২০২০ সালের নির্বাচনে চরম নাটকীয়তার মধ্যে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেনের কাছে হেরে যান ট্রাম্প, যদিও সেই পরাজয় তিনি কখনো মেনে নেননি। ওই নির্বাচনের পর ট্রাম্প সমর্থকদের ক্যাপিটলে হামলার ঘটনা চিহ্নিত হয়ে আছে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে কুখ্যাত এক অধ্যায় হিসেবে। ক্যাপিটল ভবনে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল- তাতে ধরে নেয়া হয়েছিল, ট্রাম্পের রাজনৈতিক জীবনের অবসান ঘটেছে। তার অনেক দাতা ও সমর্থক আর কখনো ট্রাম্পকে সমর্থন করবেন না বলে জানিয়েছিলেন। ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও তার দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিলেন।

ট্রাম্প অঙ্গীকার করেছেন মূল্যস্ফীতি কমিয়ে সবকিছু মানুষের ক্রয় সামর্থ্যরে মধ্যে আনার। অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠালে আবাসনের ওপর চাপ কমবে বলে মনে করেন তিনি। আমদানি পণ্যের ওপর উচ্চ হারে কর আরোপেরও আভাস দিয়েছেন ট্রাম্প। যদিও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এর ফলে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেতে পারে। ট্রাম্পও বিপুল পরিমাণ করছাড় দেয়ার প্রস্তাব রেখেছেন। তবে সেটি তার ২০১৭ সালের কর কমানোর নীতিরই আরেক রূপ, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ধনীদের জন্যই সহায়ক ছিল। এবারের নির্বাচনী প্রচারের সময় বিভিন্ন জনমত জরিপে আমেরিকানদের প্রায় অর্ধেকই বলেছিলেন, ৪ বছর আগের তুলনায় এখন তারা অর্থনৈতিক দিক দিয়ে খারাপ অবস্থায় আছেন। আর মঙ্গলবার ভোটের পর এডিসন রিসার্চের বুথফেরত জরিপে দেখা গেছে, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও মূল্যস্ফীতি নিয়ে যাদের উদ্বেগ বেশি ছিল, তারাই ট্রাম্পের দিকে ঝুঁকেছেন।

সর্বোচ্চ নির্বাচনী ব্যয়ের রেকর্ড
বিবিসি জানায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি নির্বাচনী ব্যয়ের রেকর্ড গড়েছে ২০২৪ সালের ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কমলা হ্যারিসের প্রেসিডেন্ট হওয়ার লড়াই। ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী, ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান শিবিরে দুই প্রার্থীর নির্বাচনী ব্যয় পৌঁছে গেছে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে। হ্যারিস ২ দশমিক ৩ বিলিয়নেরও বেশি নির্বাচনী তহবিল সংগ্রহ করেছেন এবং ইতোমধ্যে ব্যয় করেছেন ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। অন্য দিকে ট্রাম্প ১ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলার সংগ্রহ করেছেন, ব্যয় করেছেন ১ দশমিক ৬ বিলিয়ন। ২০২৪ সালে দুই প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর মিলিত নির্বাচনী ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারে, যা মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ব্যয়ের রেকর্ড। ব্যক্তিগত, দলীয় ও নাগরিকদের থেকে সংগৃহীত তহবিল এবং রাজনৈতিক অ্যাকশন কমিটির মাধ্যমে সংগ্রহ করা তহবিল মিলে গড়ে উঠে মার্কিন নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীর নির্বাচনী তহবিল। এবারো তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। তবে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকান-দুই শিবিরেই এবার অনেক মার্কিন ধনকুবেরের বিপুল অনুদানের খবর প্রকাশ্যে এসেছে।

রাশিয়ার সাথে সম্পর্কের নতুন সুযোগ
রয়টার্স জানায়, মস্কো ও ওয়াশিংটনের সম্পর্ক পুনরায় শুরু হওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন রাশিয়ার সার্বভৌম সম্পদ তহবিলের প্রভাবশালী প্রধান কিরিল দিমিত্রিয়েভ। বুধবার তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়ের পর রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কের নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। দিমিত্রিয়েভ রাশিয়ার অভিজাত রাজনৈতিক শ্রেণীর এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং রাশিয়ার সার্বভৌম সম্পদ তহবিলের প্রধান। তিনি বলেন, ট্রাম্পের টিম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ও সিনেট জয় করেছে। যদিও তাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক ধরনের মিথ্যা প্রচারণা পরিচালিত হয়েছে। তিনি আরো বলেছেন, এটি প্রমাণ করে যে সাধারণ আমেরিকানরা বাইডেন প্রশাসনের অস্বাভাবিক মিথ্যা, অযোগ্যতা ও শত্রুতায় ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তিনি দাবি করেছেন, এই জয় নতুন সুযোগ সৃষ্টি করেছে রাশিয়া-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক পুনরায় শুরু করার জন্য।

একসাথে কাজ করার প্রত্যাশা ইইউ-ন্যাটোর : এপি জানায়, মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প জয় পাওয়ার খবরে তার সাথে কাজ করার আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ন্যাটোর মহাসচিব মার্ক রুটে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) শীর্ষ কর্মকর্তা। মার্ক রুটে বলেছেন, শক্তির মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠায় ট্রাম্পের সাথে কাজ করতে আগ্রহী। ন্যাটোর মহাসচিব বলেন, বিশ্বব্যাপী ক্রমবর্ধমান চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছি আমরা। এর মধ্যে রয়েছে রাশিয়ার আক্রমণাত্মক অবস্থান, সন্ত্রাসবাদ, চীনের সাথে কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং চীন, রাশিয়া, উত্তর কোরিয়া ও ইরানের ক্রমবর্ধমান সহযোগিতা। তিনি আরো বলেন, ন্যাটোর মাধ্যমে একত্রে কাজ করা আমাদের নিরাপত্তা রক্ষায় এবং অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষায় সহায়তা করে। প্রথম মেয়াদে ট্রাম্প ন্যাটো মিত্রদের প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়ানোর আহ্বান জানানোর জন্য তার প্রশংসা করেন রুটে। তিনি উল্লেখ করেছেন, ন্যাটোর ৩২টি মিত্র দেশের মধ্যে প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এ বছর প্রতিরক্ষা ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে চলেছে।

এ দিকে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডের লিয়েন বলেছেন, ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র কেবল মিত্র নয়, আমাদের মধ্যে প্রকৃত অংশীদারত্ব রয়েছে, যা ৮০ কোটি নাগরিককে ঐক্যবদ্ধ করেছে। এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, আসুন, আমরা একটি ট্রান্সআটলান্টিক অংশীদারত্বে কাজ করি, যা আমাদের নাগরিকদের জন্য সুফল বয়ে আনতে অব্যাহত থাকবে। আটলান্টিকের দুই পারেই লক্ষাধিক কর্মসংস্থান এবং বিপুল বাণিজ্য ও বিনিয়োগ আমাদের অর্থনৈতিক সম্পর্কের স্থিতিশীলতা এবং গতিশীলতার ওপর নির্ভর করে। ট্রাম্পের আগের মেয়াদে ইইউ থেকে আমদানি করা স্টিল ও অ্যালুমিনিয়ামে শুল্ক আরোপ ইউরোপের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল।

শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান চায় চীন
রয়টার্স জানায়, নির্বাচনী ফল ঘোষণার মুহূর্তে চীন বলছে, যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান’ কামনা করে বেইজিং। গতকাল বুধবার নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাও নিং বলেছেন, আমরা পারস্পরিক সম্মান, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান এবং উভয়ের স্বার্থ রক্ষিত হয় এমন সহযোগিতার নীতির ভিত্তিতে চন-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবো। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আমাদের নীতি সুস্থির।

 


আরো সংবাদ



premium cement