প্রণোদনার বীজ আমদানিতে লুটপাট
পেঁয়াজ ভুট্টা ও সূর্যমুখীর দ্বিগুণ দাম প্রদর্শন- কাওসার আজম
- ০৩ নভেম্বর ২০২৪, ০২:১৪
সরকার সারা দেশের কৃষকদের মৌসুম অনুযায়ী বিভিন্ন ফসলের প্রণোদনা দিয়ে থাকে। প্রণোদনার জন্য কৃষি মন্ত্রণালয় বিদেশ থেকে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) মাধ্যমে বীজ আমদানি করে। পরে তা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের (ডিএই) মাধ্যমে কৃষকের হাতে পৌঁছে দেয়। কিন্তু প্রণোদনার এই বীজ আমদানিতে কোটি কোটি টাকা লুটপাট হয়েছে। গত কয়েক বছরের গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজবীজ, ভুট্টাবীজ ও সূর্যমুখীবীজ আমদানির তথ্য পর্যালোচনা করে লুটপাটের এ চিত্র পাওয়া গেছে।
বীজ আমদানির এই লুটপাটের সাথে সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক ও সচিব ওয়াহিদা আক্তারের সিন্ডিকেট জড়িত। তাদের হয়ে পুরো এই সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করেছেন আওয়ামী লীগের ঢাকা-৪ আসনের সাবেক এমপি কৃষিবিদ ড. আওলাদ হোসেন, ড. রাজ্জাকের বন্ধু ও কুয়েত আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ফারুক হোসেন ওরফে ফারুক মামা গংরা। এ ছাড়া কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ উইংয়ের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) কৃষিবিদ মো: আবু জুবাইর হোসেন বাবলু, বিএডিসির বীজ উইংয়ের সদস্য পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান, সাবেক এমপি মাশরাফি বিন মর্তুজার চাচা পরিচয়দানকারী জিল্লুর রহমান, বীজ কোম্পানির মালিক পবিত্র ভাণ্ডারি, আলমাস উদ্দিন সুমনসহ আরো কয়েকজনের নাম এসেছে এই সিন্ডিকেটে। বিএডিসির সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের পিডিরাও ভাগবাটোয়ারায় যুক্ত বলে জানা যায়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, বিএডিসির মানসম্মত মসলাবীজ উৎপাদন, প্রক্রিয়াজাকরণ এবং বিতরণ (সমাপ্ত) প্রকল্পের মাধ্যমে বিগত চার বছরে ১৫৬ মেট্রিক টন গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজবীজ আমদানি করা হয়। এন-৫৩ নামে ভারতীয় এই জাতের পেঁয়াজবীজ আমদানির পেছনে খরচ দেখানো হয়েছে প্রায় ৪২ কোটি টাকা।
জানা যায়, ২০২১-২২ অর্থবছরে দুই দফায় মোট ৩৬ টন পেঁয়াজবীজ আমদানি করা হয়। প্রতি কেজি পেঁয়াজবীজের দাম পড়েছে দুই হাজার ৭৬৫ টাকা। সেই হিসাবে ৩৬ টনের দাম পড়েছে ৯ কোটি ৯৫ লাখ ৪০ হাজার টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে গ্রীষ্মকালীন এন-৫৩ জাতের পেঁয়াজবীজ আমদানি করা হয়েছে ১৮ টন। প্রতি কেজি দুই হাজার ৭৬৭ টাকা হারে ১৮ টনের দাম পড়েছে চার কোটি ৯৮ লাখ ছয় হাজার টাকা।
২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রথম দফায় ১৮ টন এবং পরেরবার ২৪ টন মোট ৪২ টন পেঁয়াজবীজ আমদানি করা হয় ভারত থেকে। দুই হাজার ৭৬৬ টাকা কেজি দরে ৪২ টনের দাম পড়েছে ১১ কোটি ৬১ লাখ ৭২ হাজার টাকা।
সর্বশেষ চলমান ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৬০ টন এন-৫৩ জাতের গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজবীজ আমদানি করা হয় ভারত থেকে। এবার দাম কমিয়ে প্রতি কেজি দুই হাজার ৫০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। চারটি বীজ আমদানি কোম্পানির মাধ্যমে বিএডিসি এই বীজ আমদানি করেছে। এ জন্য মোট খরচ হয়েছে ১২ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
এর বাইরে বিএডিসির সবজিবীজ বিভাগ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এন-৫৩ জাতের মোট ২৮.৫০ টন পেঁয়াজবীজ আমদানি করা হয়। এর মধ্যে ১৬.৫০ টন দুই হাজার ৭৬৫ টাকা দরে এবং ১২ টন দুই হাজার ৭৫৫ টাকা দরে কেনা হয়। সবমিলিয়ে যার দাম পড়ে সাত কোটি ৮৬ লাখ ৮২ হাজার ৫০০ টাকা।
দৈনিক নয়া দিগন্তের কাছে ১৮ টন পেঁয়াজবীজ আমদানির একটি হিসাবের তথ্য এসেছে। যে হিসাবে প্রণোদনার বীজ আমদানিতে কে, কিভাবে, কত টাকার ভাগ পেয়েছেন তার হিসাব রয়েছে। ভারত থেকে ১৮ টন এন-৫৩ জাতের পেঁয়াজবীজ আমদানির পেছনে খরচ দেখানো হয়েছে মোট প্রায় চার কোটি ৯৮ লাখ টাকা। তবে, এই সিন্ডিকেটের করা ভাগবাটোয়ারার গোপন তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ১৮ টন পেঁয়াজবীজ কাস্টম-সহ বাংলাদেশে নিয়ে আসা পর্যন্ত মোট খরচ হয়েছে দুই কোটি ৪১ লাখ ১৫ হাজার ৮৫৭ টাকা। বাকি প্রায় এক কোটি ৬৪ লাখ টাকা বিভিন্ন জনের মধ্যে ভাগবাটোয়ারা করা হয়েছে।
বাটোয়ারার কাগজ বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিএডিসির এমডি (বীজ) মোস্তাফিজুর রহমানকে ২৫ লাখ টাকা, সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. রাজ্জাকের ছেলের বিয়েতে পাঁচ লাখ ৬১ হাজার ৫০০ টাকা, কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ উইংয়ের ডিজি মো: আবু জুবাইর হোসেন বাবলু এক লাখ টাকা, তখনকার (২০২২-২৩ অর্থবছর) পিডি (ওনিয়ন) ১৫ লাখ ৫০ হাজার টাকা, টিভি প্রোগ্রাম বাবদ দেড় লাখ টাকা, ফিন্যান্সিয়াল কস্ট বাবদ ১২ লাখ খরচ হয়েছে। অন্য দিকে, ফারুক মামা, জিল্লুর মামা, রাসেল ও সুজাত নামের চারজনের নামে একেক জনকে ৪০ লাখ ৫০ হাজার টাকা করে দেয়া হয়েছে। অন্যান্য খরচ এক লাখ ৯৫ হাজার এবং ট্যাক্স ৩ শতাংশ হারে ১৪ লাখ ৯৩ হাজার ৬৪০ টাকা হিসাবের খাতায় রয়েছে।
বাটোয়ারার এই হিসাব ধরেই মাঠে নামে নয়া দিগন্ত। অনুসন্ধানে জানা যায়, এই বীজ আমদানির টাকা ভাগবাটোয়ারার মাস্টারমাইন্ড ফারুক মামা ওরফে ফারুক হোসেন। তিনি বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবেক কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ছিলেন কুয়েত আওয়ামী লীগের সভাপতি। দীর্ঘ দিন প্রবাস জীবন শেষে দেশেই ব্যবসা করছেন। অন্য দিকে, জিল্লুর মামা ওরফে জিল্লুর রহমান কৃষি মন্ত্রণালয়ে মাশরাফি বিন মর্তুজার চাচা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। রাসেল ও সুজাত নামের দুইজন বীজ কোম্পানি বঙ্গ অ্যাগ্রিটেকের মালিক বলে জানা যায়।
এ বিষয়ে ফারুক ও জিল্লুর রহমানের বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে, ফারুকের ঘনিষ্ঠ সূত্র নিশ্চিত করেছেন যে, এই ভাগবাটোয়ারা তিনি নিজেই করেছেন। এ বিষয়ে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বীজ উইংয়ের ডিজি আবু জুবাইর হোসেন বাবলু জানান, বিষয়টি (ভাগবাটোয়ারা) তার জানা নেই। তিনি এর সাথে জড়িত নন।
কথা হয় বিএডিসির এমডি সিড (সদস্য পরিচালক) মোস্তাফিজুর রহমানের সাথে। ভাগবাটোয়ারার তথ্য তার সামনে উত্থাপন করলে তিনি তৎক্ষণাৎ বীজ আমদানিকারক বঙ্গ অ্যাগ্রিটেকের পক্ষ থেকে এই প্রতিবেদকের সাথে কেউ যোগাযোগ করবে বলে জানান। পরে কথা হয় নাজমুল কবির (রাসেল)-এর সাথে। তিনি ভাগবাটোয়ারার এই হিসাব দেখে অবাক হন। তিনি একপর্যায়ে বলেন, এই বীজ আমদানি করে আমি ধরা খেয়েছি। সবকিছু ফারুক মামা করেছেন। তিনি ড. রাজ্জাক সাহেবের খুব কাছের লোক। প্রতিবেদকের কাছে থাকা হিসাবের চিত্র প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই হিসাবের বাইরে আরো আছে। আমাদের লাভ যেটা দেখানো হয়েছে সেখান থেকে ফারুক মামা মন্ত্রী ও সচিবের (ড. রাজ্জাক ও ওয়াহিদা আক্তার) নামে আরো ৩০ লাখ নিয়েছেন। এত টাকা ইনভেস্ট করার পরে আমার তেমন কিছুই (লাভ) থাকেনি। সব নিয়ন্ত্রণ করেছেন ফারুক মামা। আমি বিএনপি ফ্যামিলির হওয়ায় সচিব ওয়াহিদা আক্তার এমনিতেই আমার কোম্পানিকে দূরে সরিয়ে রাখত। তাই আমার কিছুই করার ছিল না।
বিষয়টি নিয়ে আবার বিএডিসির এমডি (সিড) মোস্তাফিজুর রহমানের কাছে গেলে তিনি বলেন, এসবের আমি কিছুই জানি না।
জানা যায়, প্রণোদনার বীজ সবচেয়ে বেশি এনেছেন আলমাস উদ্দিন সুমন। আতিফ এন্টারপ্রাইজসহ একাধিক বেনামী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি বীজ এনে থাকেন। যদিও তিনি অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। অন্য দিকে, ড. আওলাদ হোসেন ও পবিত্র ভাণ্ডারি জিও লাইফসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বীজ এনেছেন বলে জানা যায়।
পেঁয়াজবীজের আসলে দাম কত?
এন-৫৩ জাতের পেঁয়াজবীজ ভারত থেকে আমদানি করা হয়ে থাকে। ব্যবসায়ী সেজে সে দেশের একজন বড় বীজ রফতানিকারকের কাছে চলতি বছর পেঁয়াজবীজের দাম জানতে চাওয়া হয়। তিনি জানান, এন-৫৩ জাতের ভালো মানের পেঁয়াজবীজ ৮.৫ ইউএস ডলারে (কেজি) দিতে পারবেন। বাংলাদেশে ১২০ টাকা মুদ্রাহারে যা এক হাজার টাকার কিছু বেশি। এর সাথে যোগ হবে ট্রাকভাড়া ও পোর্ট খরচ। সবমিলিয়ে এক হাজার ৩০০ থেকে এক হাজার ৪০০ টাকার মতো। কিন্তু চলতি বছর (২০২৪-২৫ অর্থবছর) পেঁয়াজবীজ দুই হাজার ৫০ টাকা কেজি দরে আমদানি করেছে বিএডিসি। আতিফ এন্টারপ্রাইজ, সিভিনেট, জিও লাইফ, গোল্ডেন এন্টারপ্রাইজ ও বঙ্গ অ্যাগ্রিটেক ১০ টন করে মোট ৬০ টন বীজ আমদানি করেছে।
ভারতীয় ওই ব্যবসায়ীর তথ্য মতে, চলতি বছরের চেয়ে আগের দুই বছরে এন-৫৩ জাতের পেঁয়াজবীজের দাম ছিল আরো কম, প্রতি কেজি আট ডলার করে। তখন ডলার মূল্যও কম ছিল।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, যখন এক কেজি পেঁয়াজবীজের মূল্য এক হাজার ২০০ টাকার মধ্যে তখন বিগত তিন বছরে প্রতি কেজি পেঁয়াজবীজের দাম দুই হাজার ৭৬৫ টাকা থেকে দুই হাজার ৭৬৭ টাকায় কেনা হয়েছে। অর্থাৎ দ্বিগুণেরও বেশি দাম দেখিয়ে কিনে এসব টাকা ভাগবাটোয়ারা করে নিয়েছেন সিন্ডিকেটের সদস্যরা।
জানা যায়, দেশে পেঁয়াজসঙ্কট সমাধানে ২০২১-২২ অর্থবছর থেকে গ্রীষ্মকালীন পেঁয়াজবীজ আমদানির মাধ্যমে কৃষককে প্রণোদনা দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কৃষি মন্ত্রণালয়। বিএডিসির মাধ্যমে এই বীজ এনে তা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর (ডিএই) কৃষকদের হাতে দিয়ে থাকে। শুধু যে, পেঁয়াজ বীজ আমদানিতে এমন লুটপাট হয়েছে তা নয়। ভুট্টা ও সূর্যমুখীর বীজ অনেক বেশি দাম দিয়ে আমদানি করে সিন্ডিকেট ভাগাভাগি করে নিয়েছে।
২০২২-২৩ ও ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট ২৪১ টনেরও বেশি বিভিন্ন জাতের সূর্যমুখীবীজ আমদানি করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৯৯০ টাকা কেজি হারে ৯১.৮৪ মেট্রিক টন সূর্যমুখীর বীজ আমদানি করে বিএডিসির বীজ বিভাগ। যার মূল্য আসে ১৮ কোটি ৬১ হাজার ৬০০ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৫০ মেট্রিক টন সূর্যমুখীর বীজ আমদানি করা হয়। ১৯৭৫ টাকা কেজি দরে আমদানি করা এই বীজের মোট দাম পড়েছে ২৯ কোটি ৬২ লাখ ৫০ হাজার টাকা। অর্থাৎ গত দুই অর্থবছরে প্রায় ৪৮ কোটি টাকার সূর্যমুখীর বীজ আমদানি করা হয়েছে।
বিএডিসি সূত্রে জানা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৫৪০ মেট্রিক টন এবং ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রায় ৭৫৬ টন ভুট্টাবীজ আমদানি করা হয় কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক অনুমোদনক্রমে। ৩৭০ টাকা কেজি ও ৩৯৫ টাকা কেজিতে কেনা আমদানির বীজের দাম আসে মোট প্রায় ৪৯ কোটি টাকা।
নয়া দিগন্তের হাতে আসা কাগজপত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ভুট্টা ও সূর্যমুখীবীজ ক্রয়েও লুটপাট করেছেন কথিত সিন্ডিকেটের সদস্যরা। এ বিষয়ে কৃষি সচিব ড. মো: এমদাদ উল্লাহ মিয়ানকে ফোন দিলেও পাওয়া যায়নি।
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা