৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১, ২৭ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

বাংলাদেশের ইতিহাসের জন্য এটি একটি অভূতপূর্ব মুহূর্ত

সংস্কার হতে হবে টেকসই : ভলকার তুর্ক
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো: তৌহিদ হোসেনের সাথে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক সাক্ষাৎ করেন : পিআইডি -

জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার তুর্ক বলেছেন, বাংলাদেশের ইতিহাসের জন্য এটি একটি অভূতপূর্ব মুহূর্ত। অবজ্ঞা ও প্রান্তিকীকরণের বিরুদ্ধে বিরাট ব্যক্তিগত ঝুঁকি নিয়ে এ দেশের তরুণ-তরুণীরা রাজপথে নেমে এসেছে। ভিন্ন মত দমন, চরম বৈষম্য, দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে তারা সোচ্চার হয়েছে। তাদের অন্যতম দাবি ছিল মানবাধিকার ও সামাজিক ন্যায়বিচার। এবার অবশ্যই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। সংস্কার হতে হবে টেকসই, যাতে বিগত দশকের অবমাননাকর কাজগুলোর পুনরাবৃত্তি না ঘটে।
বাংলাদেশে দুই দিনের সফর শেষে গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে আয়োজিত সাংবাদ সম্মেলনে তিনি এ সব কথা বলেন। এর আগে তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ এবং পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন ও সংস্কার কমিশনগুলোর প্রধানদের সাথে বৈঠক করেছেন। এ ছাড়া তিনি জুলাই বিপ্লবে আহতদের দেখতে নিটল হাসপাতাল পরিদর্শন করেছেন।
সকালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ভলকার তুর্কের সাথে বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেছেন, গত ১ জুলাই থেকে ১৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশে যেসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, তার স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত করার দায়িত্ব জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশন কার্যালয়কে দেয়া হয়েছে। এই কার্যালয়ের একটি তথ্যানুসন্ধান মিশন প্রায় এক মাস ধরে বাংলাদেশে কাজ করছে। ভলকার তুর্ককে আমি জিজ্ঞাস করেছি তথ্যানুসন্ধান মিশনের প্রতিবেদন দিতে আর কতদিন সময় লাগবে। তিনি জানিয়েছেন আরো হয়তো এক মাস সময় লাগবে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের যে ঘটনা ঘটেছে সেটির ওপরে তারা প্রতিবেদন তৈরি করছে।
তৌহিদ হোসেন বলেন, তথ্যানুসন্ধান মিশনের জন্য আমরা সব উন্মুক্ত করে দিয়েছি। বলেছি, আপনারা যা দেখতে চান, দেখুন। আমার সাথে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশন কার্যালয়ের প্রথম যে প্রতিনিধি দলটি দেখা করতে এসেছিল, তাদের বলেছি, আমার লোকজন আপনাদের সাথে যোগাযোগ করবে না। আপনারা স্বাধীনভাবে কাজ করুন। আপনাদের যদি কোনো প্রয়োজন হয়, তবে পররাষ্ট্র বা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানাবেন। আমরা সার্বিক সহায়তা দেবো।
বাংলাদেশে জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশন কার্যালয় খোলা সম্পর্কে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে কিনা জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এই কার্যালয় খুলতে দিলে সব ঠিক হয়ে যাবে এবং না দিলে কিছু হবে না, এটা মনে করার কোনো কারণ নেই। অল্প কিছু দেশেই তাদের কার্যালয় রয়েছে। এই কার্যালয় আমাদের দেশে প্রয়োজন আছে কিনা তা খতিয়ে দেখছি।
কার্যালয় খোলার সম্মতি-অসম্মতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সম্মতি ও অসম্মতি একসাথে হতে পারে না। সম্মতি ও অসম্মতির প্রশ্ন যখন আসে, তখন বুঝতে হবে যে এটি নিয়ে আলোচনা চলছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কার্যালয় খোলার অনুমতি জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশনকে দেয়া হবে বা হবে না, এটা বলা হয়নি। আমরা এখনো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছি। কার্যালয় খোলার জন্য জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার কমিশনের পক্ষ থেকে কোনো লিখিত প্রস্তাব দেয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে উপদেষ্টা বলেন, লিখিতভাবে কোনো প্রস্তাব তারা দেয়নি। তবে এটি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের তদন্ত এবং জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার হাইকমিশন কার্যালয় খোলার মধ্যে সম্পর্ক আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি এ দুটোর মধ্যে কোনো সম্পর্ক দেখছি না। আমরা তাদের নির্দিষ্ট একটি কাজ করার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছি। সার্বিকভাবে মানবাধিকার নিয়ে একটি সমস্যা ছিল। এগুলোর সমাধান চাই। বিশেষ করে বর্তমান সরকার যে কাজ করছে সেটির অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে মানবাধিকার যেন লঙ্ঘিত না হয়।
প্রসঙ্গত, ঢাকায় জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের কার্যালয় স্থাপনের জন্য অন্তর্বর্তী সরকার সম্মতি দিয়েছে উল্লেখ করে সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা শারমিন এস মুরশিদ গত মঙ্গলবার সাংবাদিকদের বলেছেন, একটা খুব বড় সিদ্ধান্ত হয়েছে। জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের কার্যালয় চালু হলে সবচেয়ে বেশি যে সুবিধা হবে তা হলো, মানবাধিকার লঙ্ঘনের ক্ষেত্রগুলো মানবাধিকার পরিষদ সরাসরি তদন্ত করতে পারবে। শিগগিরই এই কার্যালয় স্থপিত হবে। এখানে কার্যালয়টি থাকা মানে মানবাধিকারের জায়গা থেকে আমাদের শক্তি বাড়বে।
বিশ্বের ১৯টি দেশে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের কার্যালয় রয়েছে। এসব কার্যালয় প্রধানত মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণ, সুরক্ষা, গবেষণা, সরকার, নাগরিক সমাজ এবং অন্যান্য অংশীদারদের প্রযুক্তিগত সহযোগিতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করে থাকে। তবে মানবাধিকারকে অনেক সময় কোনো দেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ থাকায় সরকারগুলো এ ধরনের কার্যালয় খোলার অনুমতি দেয়ার ক্ষেত্রে বেশ সতর্কতা অবলম্বন করে থাকে।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আগামী ৭ নভেম্বর ব্রিটেন যাবেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কোনো সহায়তা দেবে কিনা জানতে চাইলে তৌহিদ হোসেন বলেন, বেগম জিয়া চিকিৎসার জন্য ব্রিটেন যাবেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যাচ্ছেন বলেই তো তার এবং তার টিমের ভিসার ব্যাপারে আমরা সহযোগিতা করব। ব্রিটেনে যাওয়ার পরে আমার মনে হয় না তার আর কোনো সমস্যা হবে। সেখানে তার নিজস্ব সংগঠন আছে, আমাদের মিশন আছে। যেটুকু নিয়ম অনুযায়ী করার আমরা অবশ্যই করব।
গতকাল রাজধানীর একটি হোটেলে ভলকার তুর্কের সাথে সংস্কার কমিশনগুলোর প্রধানদের বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে দুর্নীতি দমন কমিশনবিষয়ক সংস্কার কমিশনের প্রধান ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যদি কোনো কমিশনের কারিগরি সহায়তা প্রয়োজন হয়, তারা তা দিতে রাজি আছে। এ ছাড়া লজিস্টিক সাপোর্ট দিতেও তারা আগ্রহী।
বৈঠক প্রসঙ্গে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, সংস্কার কমিশন প্রধানদের সাথে আলোচনায় বৈষম্যহীন সমাজের কথা উঠে এসেছে। গণতান্ত্রিক, সুশাসিত ও দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ বিনির্মাণের অভূতপূর্ব সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে।
সাংবাদিক সম্মেলনে তুর্ক বলেন, বর্তমানে প্রকৃত সুযোগ ও উচ্চ প্রত্যাশার সৃষ্টি হয়েছে। আর এটি হলো উন্নতির জন্য মৌলিক পরিবর্তন, সুশাসন, উন্নয়ন, মানবাধিকারের ওপর ভিত্তি করে অর্থনৈতিক নীতি, সাম্প্রতিক আন্দোলনের অর্জনগুলো থেকে সুফল তুলে আনা এবং বৈষম্য ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে আসা। অসমতা, প্রতিশোধের চক্র, প্রান্তিকীকরণ, দুর্নীতি ও মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন অতীতের বস্তুতে পরিণত করতে হবে। আর এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সফলতার জন্য জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার কার্যালয় সবকিছু করার জন্য প্রস্তুত রয়েছে।
তিনি বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার অর্থনীতি, উন্নয়ন, সামাজিক, রাজনৈতিক ও আইনের শাসনসহ সব ক্ষেত্রে ব্যাপক চ্যালেঞ্জ অতীতের সরকারের কাছ থেকে পেয়েছে। রূপান্তর সব সময়ই জটিল একটি বিষয়। কিন্তু প্রত্যাশা অনেক বেশি। দীর্ঘদিনের অনিষ্পন্ন ইস্যুগুলো সুরাহায় সময় প্রয়োজন।
জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার প্রধান বলেন, গত জুলাই ও আগস্টে আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো তদন্তে আমার কার্যালয়ের একটি তথ্যানুসন্ধান মিশন কাজ করছে। এটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। বাংলাদেশে আমার কার্যালয়ের শক্তিশালী অবস্থান আইনি পরামর্শ, প্রতিষ্ঠানিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংস্কার, ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, পুনঃএকত্রীকরণ ও উপসমের ক্ষেত্রে রূপান্তর প্রক্রিয়ায় সহায়ক হতে পারে। বাংলাদেশে জাতিসঙ্ঘের মানবাধিকার হাইকমিশনের কার্যালয় স্থাপনের প্রক্রিয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সমাপ্ত করতে আমরা আগ্রহী।


আরো সংবাদ



premium cement