৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ কার্তিক ১৪৩১, ২৭ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

২২ মামলার দায় থেকে অব্যাহতি পেলেন খালেদা জিয়া

রাষ্ট্রদ্রোহ ও নাশকতার ১১ মামলা বাতিল
-

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় সাজা দিয়ে আদালত থেকে কারাগারে নেয়া হয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে। এরপর দুই বছরের বেশি সময় তিনি কারাবন্দী ছিলেন। বন্দী অবস্থায় জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায়ও তাকে সাজা দেয়া হয়। কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়ায় ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সরকার নির্বাহী আদেশে সাজা স্থগিত করে শর্তসাপেক্ষে তাকে মুক্তি দেয়। তবে কার্যত তিনি ছিলেন গৃহবন্দী। বারবার বিদেশে সুচিকিৎসার আবেদন করেও উপেক্ষিত হন। এ অবস্থায় গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর গত ৬ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেয়। এরপর ওয়ান-ইলেভেনের সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় তার বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার জট খুলতে থাকে।
মঙ্গলবার খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহ ও নাশকতার অভিযোগে করা ১১টি মামলা বাতিল করেছেন হাইকোর্টে। এ মামলাগুলো বাতিল প্রশ্নে জারি করা রুল যথাযথ ঘোষণা করেছেন আদালত। আইনজীবীরা জানিয়েছেন, এ নিয়ে খালেদা জিয়া সর্বমোট ২২টি মামলার দায় থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন। অন্য যেসব মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন সেগুলো হলো- গ্যাটকো দুর্নীতি মামলা, হরতাল-অবরোধে ৪২ জনের মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা, মানহানির মামলাসহ ১১টি মামলা।
অপরদিকে উচ্চ আদালত ও নি¤œ আদালতে এখনো তার বিরুদ্ধে আরো সাত বা আটটি মামলা রয়েছে বলে আইনজীবীরা জানিয়েছেন। এর মধ্যে ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থার সময় করা নাইকো, বড়পুকুরিয়া মামলা রয়েছে। এছাড়া নাশকতা ও মানহানির অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আরো সাত থেকে আটটি মামলা রয়েছে বলে বিএনপির আইন সম্পাদক ব্যারিস্টার কায়সার কামাল জানিয়েছেন। তিনি আরো জানান, জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলার সাজার দণ্ড (কনভিকশন) বাতিল করেছেন রাষ্ট্রপতি। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি এই দুই মামলার দণ্ড বাতিল করেছেন বলে কায়সার কামাল জানিয়েছেন।
হাইকোর্টে রাষ্ট্রদ্রোহ ও নাশকতার ১১ মামলা বাতিল : বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের করা রাষ্ট্রদ্রোহ ও নাশকতার অভিযোগে করা ১১টি মামলা বাতিল করেছেন হাইকোর্ট। গতকাল বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চ শুনানি শেষে এই রায় দেন।
আদালতে খালেদা জিয়ার পক্ষে শুনানিতে ছিলেন সিনিয়র আইনজীবী জয়নুল আবেদীন, মাহবুব উদ্দিন খোকন, কায়সার কামাল, মো: জাকির হোসেন ভূইয়া, মো: মাকসুদ উল্লাহ ।
খালেদা জিয়ার পক্ষে আইনজীবী নাসির উদ্দিন অসীম, আমিনুল ইসলাম, রাগীব রউফ চৌধুরী, গাজী কামরুল ইসলাম, মোরশেদ আল মামুন লিটন, মোহাম্মদ সিদ্দিক উল্যাহ মিয়া, আনিসুর রহমান রায়হান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো: জসিম সরকার।
পরে জয়নুল আবেদীন বলেন, আদালত উভয়পক্ষকে শুনে সবগুলো মামলায় রুল অ্যাবসুলেট করেছেন। অ্যবসুলেট করার মানে হচ্ছে এই মামলাগুলো কোয়াশড (বাতিল) হয়ে গেল। এই মামলাগুলো আর থাকল না। এখানে একটা রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা ছিল। সরকারের অনুমতি না নিয়ে এ মামলা করেছে। আইন হচ্ছে অনুমতি নিতে হয়। শুনানি শেষে আদালত এ মামলাও বাতিল করা হলো। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে করা এসব মামলা থেকে আদালত বেগম খালেদা জিয়াকে অব্যাহতি দিয়েছেন।
মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, এই মামলাগুলো ২০১৬-১৭ সালের দিকে রুল ও স্টে হয়ে আছে। আজকে রুল শুনানি হয়েছে। এসব মামলায় তিনি আগে জামিন পেয়েছেন। আজকে মামলাগুলোর পরিসমাপ্তি ঘটেছে।
কায়সার কামাল বলেন, মামলাগুলো ছিল বেআইনি। সেটা আজকে প্রমাণিত হয়েছে। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় অনুমতি নিতে হয়। সেটা নেয়া হয়নি। নাশকতার মামলা যে ধারায় করা হয়েছে, সেখানে পাবলিক প্রপার্টি হতে হয়। এখানে সবগুলো প্রাইভেট প্রপার্টি। সেটা তারা জেনেও মামলা দিয়েছে। আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত আছে, ফিজিক্যালি উপস্থিত থাকতে হবে। কিন্তু ম্যাডাম জিয়া তখন গুলশানে অবরুদ্ধ ছিলেন। তারপরও রাজনৈতিক প্রতিহিংসায় এ মামলা দেয়া হয়েছে।
আইনজীবীরা জানান, ১১টি মামলার কার্যক্রমের বৈধতা নিয়ে ২০১৭ সালে পৃথক আবেদন করেন খালেদা জিয়া। প্রাথমিক শুনানি নিয়ে ২০১৭ সালের বিভিন্ন সময় হাইকোর্ট রুলসহ মামলার কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ দেন। এই রুলের ওপর শুনানি শেষে বুধবার রায় দেয়া হয়। মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে রাজধানীর দারুস সালাম থানায় করা নাশকতার সাতটি, যাত্রাবাড়ী থানার তিনটি ও রাষ্ট্রদ্রোহের একটি মামলা।
মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কিত মন্তব্য করার অভিযোগে ২০১৬ সালের ২৫ জানুয়ারি আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলাটি দায়ের করা হয়।
এদিকে যাত্রাবাড়ী থানার মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, ২০১৫ সালের ২৩ জানুয়ারি রাতে যাত্রাবাড়ীর কাঠেরপুল এলাকায় গ্লোরি পরিবহনের একটি বাসে পেট্রলবোমা হামলা হয়। এতে বাসের ২৯ যাত্রী দগ্ধ হন। পরে তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান নূর আলম (৬০) নামের এক যাত্রী। ওই ঘটনায় ২০১৫ সালের ২৪ জানুয়ারি খালেদা জিয়াকে হুকুমের আসামি করে যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করেন থানার উপপরিদর্শক এসআই কে এম নুরুজ্জামান। ওই বছরের ৬ মে খালেদা জিয়াসহ ৩৮ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন ডিবি পুলিশের পরিদর্শক বশির আহমেদ।
গ্যাটকো মামলা : গ্লোবাল অ্যাগ্রোট্রেড প্রাইভেট লিমিটেড (গ্যাটকো) দুর্নীতি মামলা থেকে বেগম খালেদা জিয়াসহ তিনজনকে অব্যাহতি দিয়েছেন আদালত। গত ২৪ অক্টোবর ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩ এর বিচারক আবু তাহের শুনানি শেষে এ আদেশ দেন। ২০০৭ সালের ২ সেপ্টেম্বর রাজধানীর তেজগাঁও থানায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ ১৩ জনের নামে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উপপরিচালক গোলাম শাহরিয়ার চৌধুরী বাদি হয়ে মামলাটি করেন।
৪২ জনের মৃত্যুর ঘটনায় হত্যা মামলা খারিজ : বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা হরতাল-অবরোধে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি থেকে ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অগ্নিদগ্ধ হয়ে ৪২ জনের মৃত্যুর ঘটনায় বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াসহ চারজনের বিরুদ্ধে করা মামলা খারিজ করে দিয়েছেন আদালত। গত বৃহস্পতিবার ঢাকার অতিরিক্ত চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট জিয়াদুর রহমান পুলিশের দেয়া তদন্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলাটি খারিজ করে দেন। ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এ বি সিদ্দিকী বাদি ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আতিকুর রহমানের আদালতে মামলাটি করেন।
মানহানির ৫ মামলায় খালাস : খালেদা জিয়াকে মানহানির পাঁচ মামলা থেকে খালাস দিয়েছেন আদালত। জননেত্রী পরিষদের সভাপতি এ বি সিদ্দিকীর করা মুক্তিযুদ্ধকে কলঙ্কিত করা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে মন্তব্যে অভিযোগে চার মামলা এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক গাজী জহিরুল ইসলামের ‘ভুয়া’ জন্মদিন পালন করার অভিযোগে একটি মামলাসহ মানহানির পাঁচ মামলায় খালাসের এ রায় দেন আদালত। গত ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পৃথক দুই ম্যাজিস্ট্রেট আদালত তাকে এসব মামলায় খালাস দেন।
এখন যেসব মামলা রয়েছে :
নাইকো মামলা : বেগম খালেদা জিয়াসহ আটজনের বিরুদ্ধে নাইকো দুর্নীতি মামলার সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য মামলার তদন্ত কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রপক্ষের সব সাক্ষীকে ৪ নভেম্বর আদালতে হাজির করাতে দুদককে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। ঢাকার ৯ নম্বর (অস্থায়ী) বিশেষ জজ আদালতের বিচারক মুহম্মদ আলী আহসান এদিন ধার্য করেন।
বড়পুকুরিয়া মামলা : বেগম খালেদা জিয়া ও অন্য আসামিদের বিরুদ্ধে দিনাজপুরের বড়পুকুরিয়া কয়লাখনি দুর্নীতি মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানির জন্য ৫ নভেম্বর দিন ধার্য রয়েছে। আইনজীবী মাসুদ আহমেদ তালুকদার জানান, রোববার এ মামলার অভিযোগ গঠনের বিষয়ে শুনানির জন্য রয়েছে। আমরা বেগম খালেদা জিয়াকে এ মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়ার আবেদন জানাব।


আরো সংবাদ



premium cement