গুম কমিশনে অভিযোগ দায়ের করলেন ব্যারিস্টার আরমান
- নিজস্ব প্রতিবেদক
- ৩০ অক্টোবর ২০২৪, ০২:৫২
গুম হওয়ার দীর্ঘ ৮ বছর পর কথিত বন্দিশালা ‘আয়নাঘর’ থেকে মুক্ত সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাসেম (আরমান) গুম কমিশনে অভিযোগ দায়ের করেছেন। গতকাল মঙ্গলবার দুপুর ১টায় তারপক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন গুম কমিশনে অভিযোগ দাখিল করেন। গুম কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন আবেদন গ্রহণ করে গুরুত্বসহকারে তদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন।
অভিযোগে বলা হয়েছে, ২০১৬ সালের ৯ আগস্ট রাত ১১টার দিকে সিভিল পোশাক পরিহিত ৭-৮ জন ব্যক্তি আমার বাসার কলিং বেল প্রেস করে। দরজা খুলে দিলে তারা বাসায় প্রবেশ করে। তাদের সবার কাছে অস্ত্র ছিল এবং অস্ত্রের মধ্যে সিরিয়াল নাম্বারও লেখা ছিল। দেখে বোঝা যাচ্ছিল তারা কোনো বাহিনীর লোক। তখন তারা আমাকে বলে যে, আমার কাছে তাদের কিছু প্রশ্ন আছে এবং আমাকে তাদের সাথে যেতে হবে। আমি বলেছিলাম আপনারা কারা, কেন আমাকে নিয়ে যাবেন? আমার নামে কোনো ওয়ারেন্ট আছে কি না? তারা বলে, আমাদের সাথে গেলেই সব বুঝতে পারবেন। অতঃপর জোরপূর্বক আমাকে আমার স্ত্রী-সন্তানদের সামনে থেকে টেনে-হেঁচড়ে নিয়ে যায় ও সাদা মাইক্রো গাড়িতে উঠায়। গাড়িতে উঠানোর পর তারা আমার হাত ও চোখ বেঁধে দেয়। আমি বলি আমার চোখ বাঁধছেন কেন? তারা বলেন, এটাই আমাদের নিয়ম এবং সাথে গেলেই সবকিছু বুঝতে পারবেন।
আমার পিতা মীর কাসেম আলী বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অসত্য অভিযোগ এনে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কথিত বিচার শুরু করেন। আমি আমার বাবার মামলা পরিচালনায় পারিবারিকভাবে দায়িত্বরত ছিলাম এবং ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আইনজীবী প্যানেলের সাথে বাবার হয়ে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলাম। সে কারণে বাবার মামলাসংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও নথি আমার কাছে সংরক্ষিত ছিল। বাবার মামলাটি যখন শেষ পর্যায়ে ছিল অর্থাৎ ট্রাইব্যুনালের রায়, এরপর আপিল, আপিলের পর রিভিউ শুনানির একেবারে শেষপর্যায়ে এবং কিছুদিন পরেই রায় কার্যকর হয়ে যাবে। এমতাবস্থায়, বাবার মামলা পরিচালনা এবং ন্যায়বিচার বাধাগ্রস্ত করার পূর্বপরিকল্পিত উদ্দেশ্যেই আমার বাবা মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর হওয়ার চার সপ্তাহ আগে আমাকে জোরপূর্বক গুম করা হয়। পরিবারের সদস্যরা আমার নিখোঁজ হওয়ার সাথে সাথেই নিকটস্থ পল্লবী থানায় শরণাপন্ন হলে দায়িত্বরত অফিসাররা কোনো আইনি পদক্ষেপ নেয়নি এবং আমাকে খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে কোনো সহযোগিতা করেনি। বরং আমি আত্মগোপন করেছি বলে আমার পরিবারের সদস্যদের কাছে অপবাদ দেয়া হয়।
অতঃপর তারা আমাকে একটি জায়গায় নিয়ে গিয়ে একটি নির্জন কক্ষে/সেলে বন্দী করে রাখে। জায়গাটি কোথায় আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু এতটুকু বলতে পারি যে, সেলটি খুবই পুরনো ছিল। সেখানে আমি ১৬ দিন অবস্থান করি। স্যাঁতসে্যঁতে আবহাওয়া এবং ফ্লোরে ইঁদুর ঘুরে বেড়াত। সার্বক্ষণিক তারা আমার চোখ ও হাত বেঁধে রাখত। সেখানকার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আমি প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ি। ১৬ দিনের মাথায় এক মধ্যরাতে আমাকে সেখান থেকে গাড়িতে করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়। বুঝতে পারছিলাম না কোথায় নিয়ে যাচ্ছে। আনুমানিক আধা ঘণ্টার মধ্যে আমাকে নিয়ে তারা দ্বিতীয় লোকেশনে পৌঁছায়। সেখানে টাইলস করা ফ্লোর আর রুমের সাথে টয়লেট ছিল। সেখানকার প্রহরীরা অনেক কঠোর ছিল।
তাদের কথাবার্তা খুবই কঠোর, চাল-চলন অনেক সুশৃঙ্খল, খাওয়া দাওয়ার বিষয়টিও ছিল নিয়মতান্ত্রিক। সবসময় বলত তাদের ওপর আদেশ করা হয়েছে। দিনের বেলা দুই হাতে সামনের দিক থেকে হাতকড়া পরানো থাকত আর রাতে হাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে রাখত। টয়লেটের ভেতর গোসল করার সময় হাত খোলার অনুমতি ছিল। এক হাতে হাতকড়া পরানো থাকত, আরেক হাত খোলা থাকত। গোসল শেষ করে ভালোমতো চোখ বেঁধে ওদেরকে আওয়াজ দিতে হতো। তখন ওরা এসে আবার চেক করত সব ঠিকঠাক বাঁধা আছে কি না। তারপর তারা চলে যেত। তিনবেলা খাবার দেয়া হতো। গোসলের সময় বামহাত খুলে দিত, আর খাবারের সময় ডান হাত খুলে দিত। যখন হাতকড়া খুলে দিত তখন একটু চোখ খুলতে পারতাম কিন্তু ওরা বকাবকি করত। কোন দিকে তাকানোর নিয়ম ছিল না। প্রচণ্ড কঠোরতা অবলম্বন করা হতো। আমি যেখানে ছিলাম সেখান থেকে খুব কাছেই ইন্টারোগেশন রুম ছিল। আমি ইন্টারোগেশনের হালকা আওয়াজ শুনতে পেতাম। যাদের ওপর নির্যাতন চলছে তাদের আওয়াজে ঘুমাতে পারতাম না। এভাবে দীর্ঘ আট বছর আমাকে সেখানে গুম করে রাখা হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে আমি কোনো প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের ছোঁয়া পাইনি।
হাতকড়া অবস্থায় নামাজ পড়তে হতো। একহাত দিয়ে রুকু করতে হতো, এক হাত দিয়ে সেজদা করতে হতো। একবার ডান হাত একবার বাম হাতে। প্রথম বন্দিশালা/জায়গা থেকে দ্বিতীয় বন্দিশালা/টর্চার সেলে অনেক বেশি সিসটেমেটিক পদ্ধতিতে নির্যাতন করা হতো। সেখানে মাঝেমধ্যে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরিদর্শনে আসতেন। তারা যখন আসত তখন দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে থাকতে হতো, নড়াচড়া করতে দেয়া হতো না। সারা দিন দেয়ালের দিকে মুখ করে বসে থাকতে হতো। আমাকে এক অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টের জীবন অতিবাহিত করতে হয়েছে। জীবিত ব্যক্তিদের জন্য এই বন্দিশালা ছিল একটি কবরের মতো। সুপরিকল্পিতভাবে এবং সিসটেমেটিক পদ্ধতি অবলম্বন করে এমনভাবে বন্দীদের নির্যাতন করা হতো বন্দীরা যেন মৃত্যুর চেয়েও আরো ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়। তাদের নিয়ম-কানুন ও কঠোরতা দেখে মনে হয়েছে তারা সেনাবাহিনীর সদস্য বা কর্মকর্তা। কর্তৃপক্ষের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এক মুহূর্তের জন্য আমাদের মুক্ত থাকার সুযোগ ছিল না বা স্বাধীনতা হরণ করা হয়েছিল। সরকারের অবগতি, নির্দেশ বা সহযোগিতা ব্যতীত কারো পক্ষে এত মানুষকে দিনের পর দিন বা বছরের পর বছর গুম করে রাখার সুযোগ নাই।
অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেছেন, অপহরণের বিষয়ে প্রথমে পুলিশ কোনো অভিযোগ বা মামলা না নিলেও পরে ২০১৬ সালের ১০ আগস্ট আমার স্ত্রী তাহমিনা আক্তার পল্লবী থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন (ডায়েরি নং-৮০৮)। অতঃপর তাহমিনা আক্তার গত ২০১৬ সালের ২২ ডিসেম্বর পল্লবী থানায় একটি এজাহার দায়ের করেন। তেজগাঁও জোনাল টিম, ডিবি তেজগাঁও বিভাগের এসআই মো: আবুল বাশার ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করেন। তদন্তে আমার অপহরণের সত্যতা পাওয়া গেলেও কাউকে অভিযুক্ত করে কোনো চার্জশিট প্রদান করা হয় নাই। প্রকৃতপক্ষে সত্য গোপন করে দায়ী ব্যক্তিদের বাঁচানোর জন্য ওই মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট প্রদান করা হয়। অতঃপর ওই ফাইনাল রিপোর্টের বিরুদ্ধে বাদি তাহমিনা আক্তার নারাজি দরখাস্ত দাখিল করেন। বর্তমানে মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে।