৩০ অক্টোবর ২০২৪, ১৪ কার্তিক ১৪৩১, ২৬ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

রাষ্ট্রপতি অপসারণ ইস্যুতে অবস্থান পাল্টাবে না বিএনপি

নির্বাচনী রোডম্যাপে সোচ্চারের সিদ্ধান্ত
-

রাষ্ট্রপতির পদ থেকে মো: সাহাবুদ্দিনকে অপসারণ ইস্যুতে অবস্থান পাল্টাবে না বিএনপি। এ ইস্যুতে ইতোমধ্যে সংবিধানের বাইরে না যাওয়ার যে অবস্থান জানিয়েছে দলটি, সেটিতেই তারা বহাল থাকবে।

রাষ্ট্রপতির অপসারণ নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ও জাতীয় নাগরিক কমিটির ছাত্রনেতারা বিএনপির সাথে বৈঠকের দুই দিন পর গত সোমবার রাতে এ নিয়ে বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। জানা গেছে, বৈঠকে রাষ্ট্রপতির অপসারণ নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনা হয়েছে। সেখানে সাংবিধানিক শূন্যতা বা রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়, এমন কোনো উদ্যোগ না নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে দলটি।

বিএনপির শীর্ষ নেতারা বৈঠকে বলছেন, বিপ্লব বা গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও সাংবিধানিক পথেই অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। সুতরাং সেই সংবিধানকে উপেক্ষা করে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া যৌক্তিক হবে না। দলটি মনে করছে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সংবিধানকে বাতিল ঘোষণা করা হলে দেশে সাংবিধানিক সঙ্কট বা রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হবে। এমনটা হলে নির্বাচন আরো পিছিয়ে যেতে পারে, যা দেশকে গভীর সঙ্কটের দিকে নিয়ে যেতে পারে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিগত সরকারের আমলে দলীয়করণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টিতে রাষ্ট্রকাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কারে দশটি কমিশন গঠন করে অন্তর্বর্তী সরকার। সংস্কারপ্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কয়েক দফা সংলাপও করে সরকার। এমন অবস্থায় শেখ হাসিনার পদত্যাগের দালিলিক প্রমাণ নেই বলে সম্প্রতি মন্তব্য করেন রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিন। রাষ্ট্রপতির এই বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনসহ কয়েকটি সংগঠন তার পদত্যাগের দাবি তোলে।

গত ২২ অক্টোবর বঙ্গভবন ঘেরাওয়ের কর্মসূচিও পালন করা হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ২২ অক্টোবর রাতে দলের সিনিয়র নেতাদের সাথে ভার্চুয়ালি বৈঠক করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। সেখানে নেতারা অভিমত দেন, অসাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রপতিকে অপসারণ করা ঠিক হবে না। এমনটা হলে দেশে সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি হবে। দলীয় সিদ্ধান্তের আলোকে পরদিন ২৩ অক্টোবর বিএনপির তিন সদস্যের প্রতিনিধিদল যমুনায় গিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সাথে বৈঠক করে। সেখানে দলীয় অবস্থান তুলে ধরে বিএনপি নেতারা বলেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপতির পদ নিয়ে এই মুহূর্তে দেশে সাংবিধানিক, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হোক- সেটা কাম্য নয় বিএনপির। বিএনপি চায় না, দেশে নতুন করে কোনো সাংবিধানিক সঙ্কট সৃষ্টি হোক।

প্রধান উপদেষ্টার সাথে বৈঠক নিয়ে ওই দিন বিকেলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির পদটা একটা সাংবিধানিক পদ বা একটা প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদ। এই পদে হঠাৎ করে পদত্যাগের মাধ্যমে শূন্যতা সৃষ্টি হলে রাষ্ট্রীয় সঙ্কট ও সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে। রাষ্ট্রীয় সঙ্কট সৃষ্টির মাধ্যমে যদি গণতন্ত্রে উত্তরণের পথটা বিলম্বিত, বাধাগ্রস্ত কিংবা কণ্টকাকীর্ণ হয় তা জাতির কাম্য নয়।’

এরপর ওই দিন (২৩ অক্টোবর) রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠক হয়। সেখানে রাষ্ট্রপতির অপসারণের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে দলীয় অবস্থান পরিষ্কার করেন বিএনপি নেতারা। তারা বলেন, গণ-অভ্যুত্থানে সরকার পরিবর্তনের পর দেশের সংবিধান স্থগিত করা হয়নি। রাষ্ট্রপতির কাছে শপথ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ফলে এখন সংবিধানের বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিএনপির এমন অবস্থানে রাষ্ট্রপতি অপসারণ ইস্যুতে ছাত্রনেতাদের দাবি থমকে যায়। এরপর এ ইস্যুতে ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টায় রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির নেতারা। এর অংশ হিসেবে গত শনিবার বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে তিন সদস্যের প্রতিনিধি দলের সাথে বৈঠক করেন ছাত্রনেতারা। সেখানে ছাত্রনেতাদের তরফ থেকে বিএনপিকে তাদের অবস্থান জানানো হয়, কেন তারা রাষ্ট্রপতির অপসারণ চান-সেটিও তুলে ধরেন। তবে বিএনপি তাদের চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। দলটি তখন জানায়, এ ইস্যুতে দলীয় ফোরামে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিবেন তারা।

এর পরিপ্রেক্ষিতে গত সোমবার রাতে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সভায় প্রধান এজেন্ডা ছিল রাষ্ট্রপতির অপসারণ ইস্যু। জানা গেছে, সভার শুরুতে রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে ছাত্রনেতাদের সাথে অনুষ্ঠিত বৈঠকের সারমর্ম তুলে ধরা হয়। এরপর নেতারা তাদের অভিমত ব্যক্ত করেন। তারা ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী রাষ্ট্রে নতুন করে কোনো ধরনের সঙ্কট বা জটিলতায় পড়ুক- এমন পরিস্থিতি সতর্কভাবে এড়িয়ে চলার অবস্থান প্রকাশ করেন। বিশেষ করে, রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিনের পদত্যাগ প্রশ্নে। সভায় কেউ কেউ বলেন, সম্প্রতি রাষ্ট্রপতির অপসারণ ও প্রক্লেমেশন অব সেকেন্ড রিপাবলিক (দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্রের ঘোষণাপত্র) ঘোষণাসহ কয়েকটি দাবি তোলা হয়েছে। এ জন্য যদি সংবিধান বাতিল করা হয়, তাহলে দেশে বড় ধরনের সঙ্কট সৃষ্টি হতে পারে। তারা যুক্তি তুলে ধরে বলেন, সাংবিধানিক সঙ্কট এ জন্য সৃষ্টি হবে যে, রাষ্ট্রপতি কার কাছে পদত্যাগ করবেন সে ধরনের কোনো অপশন খোলা নেই। প্রধান বিচারপতিও বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন বলে সভায় একজন জানান।

স্থায়ী কমিটির সভায় বিএনপি নেতারা বলেন, রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় সংস্কারে অন্তর্বর্তী সরকার ইতোমধ্যে দশটি কমিশন গঠন করেছে। তারাই মতামত দিবেন কী ধরনের সংস্কার হতে পারে রাষ্ট্রের। তাদের স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়া উচিত। বাইরে থেকে নানা ধরনের দাবি তুললে, কমিশন ঠিকমতো কাজটা করতে পারবে না।

জানা গেছে, সভায় এবার ৭ নভেম্বর ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ জাঁকজমকভাবে পালন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ওই দিন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের (বীর উত্তম) মাজারে বড় ধরনের শোডাউন করবে দলটি। দেশব্যাপীও বৃহৎ আকারে দিবসটি পালিত হবে।

সভায় মতামত এসেছে, দ্রুততম সময়ে সরকারের উচিত নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা এবং দ্রব্যমূল্য ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি উন্নয়নের দিকে নজর দেয়া। বিএনপি আগামী দিনে তাদের সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক সব ধরনের কর্মসূচিতে দ্রুত নির্বাচনের ব্যাপারে সোচ্চার হবে। এর মধ্য দিয়ে সরকারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখবে দলটি। বৈঠকে রাষ্ট্র মেরামতের ৩১ দফার ব্যাপক প্রচারণা অব্যাহত রাখার ওপর জোর দেয়া হয়।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে কাজ করা। পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্যের দিকে নজর দেয়া। একইসাথে সাংবিধানিক কোনো শূন্যতা যাতে সৃষ্টি না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখা উচিত।

জানা গেছে, বিএনপি জনসম্পৃক্ত নানা ইস্যুতে পর্যায়ক্রমে সোচ্চার হবে। এর মূল লক্ষ্য হবে আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে জনমতকে তাদের সাথে সম্পৃক্ত রাখা।

 


আরো সংবাদ



premium cement