২৭ অক্টোবর ২০২৪, ১১ কার্তিক ১৪৩১, ২৩ রবিউস সানি ১৪৪৬
`
পুলিশের অপারেশনাল পদগুলোতে ফ্যাসিবাদের সহযোগীরা

কার্যকর করা যাচ্ছে না সরকারের নীতি কৌশল

-

২০১৪ সালের একতরফা নির্বাচন, ২০১৮ সালের আগের রাতের নির্বাচন এবং ২০২৪ সালের একতরফা নির্বাচনে সম্পৃক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকেই ৫ আগস্টের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের পরেও পুলিশ সদর দফতর, ডিএমপি, এসবি, সিআইডিসহ পুলিশের গুরুত্বপূর্ণ ইউনিটে বহাল তবিয়তে কাজ করছে। ফলে কার্যকর করা যাচ্ছে না অন্তর্বর্র্তী সরকারের নীতি কৌশল।
সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে জানা গেছে, সর্বশেষ জুলাই-আগস্ট ২০২৪ বিপ্লবকালীন সময়কালে যেসব কর্মকর্তা পুলিশ সদর দফতরের বিশেষ মনিটরিং সেলে সারা দেশে ছাত্র-জনতার ওপর গুলি ও নিপীড়নের আদেশ সমন্বয়ের কাজসহ ২৪ ঘণ্টার সিসিটিভি ফুটেজ মনিটরিং করে তৎকালীন পুলিশের নিয়ন্ত্রক সিন্ডিকেট সদস্যদের রিপোর্টিং-এর কাজ করতেন- সেসব কর্মকর্তা ইতোমধ্যে বিভিন্ন জেলায় পুলিশ সুপার পদে পদায়ন পেয়েছেন। তারা ডিএমপিতে ডিসি- এডিসি- এসি হিসেবে, পুলিশ হেড কোয়ার্টারের বিভিন্ন শাখায় পদায়ন পেয়ে ডেস্কে কর্মরত থাকায় বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তারা এখনো বঞ্চিতই থেকে যাচ্ছেন। অন্য দিকে ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের ১৬ বছরের দুঃশাসনের সময়কালে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের অধিকাংশই ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে কাক্সিক্ষত পদোন্নতি পেয়েছে। কিন্তু দীর্ঘসময় ধরে তারা মূল পুলিশ কার্যক্রমের বাইরে থাকায় এবং ২০০৬ সাল পরবর্তী সময়ে যোগদানকৃত জাতীয়তাবাদী মনোভাবসম্পন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে যোগাযোগ পুরোপুরি না থাকায় তারা ফ্যাসিবাদকে সহায়তাকারীদের ঠিক মতো চিহ্নিত করতে পারছেন না। আর আওয়ামী দুঃশাসনের সময়কালীন জাতীয় নির্বাচন, উপজেলাসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচন, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার নির্বাচনে তৎকালীন শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের আস্থাভাজন হিসেবে কর্মরত কর্মকর্তারা বর্তমানে বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তাদের একটা অংশের সাথে অবৈধ লিয়াজোঁ রক্ষা করে নিজেদের অপকর্ম ঢাকার চেষ্টা করতে পারছেন। এতে আওয়ামীবিরোধী মনোভাবাপন্ন পুলিশ কর্মকর্তারা যথাযথ পদায়ন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন আর অন্তর্বর্তী সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন নানাভাবে বাধার মুখে পড়ছে।
২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের ভোটারবিহীন, একতরফা ও মধ্যরাতের নির্বাচনে একনাগাড়ে কাজ করা এবং তৎকালীন সময়ের শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের অত্যন্ত আস্থাভাজন ২২তম বিসিএস ব্যাচের কর্মকর্তা নাশিয়ান ওয়াজেদকে সম্প্রতি পুলিশ হেড কোয়ার্টারে অতিরিক্ত ডিআইজি অপারেশনের দায়িত্ব হতে বদলি হয়ে পুলিশ স্টাফ কলেজে পদায়ন করা হয়েছে। তিনি ২০১৮ সালের মধ্যে রাতের নির্বাচনের সময় তৎকালীন আইজিপি ড. জাবেদ পাটোয়ারি, তৎকালীন ডিএমপি কমিশনার আসাদুজ্জামান মিয়া, ঢাকা রেঞ্জ ডিআইজি হাবিবুর রহমানসহ মধ্য রাতের নির্বাচনের পরিকল্পনাকারী পুলিশ কর্মকর্তাদের অত্যন্ত আস্থাভাজন হিসেবে এআইজি অপারেশন্সের দায়িত্বে থেকে সারা দেশে পুলিশ ইউনিটগুলোর সমন্বয়ের কাজ করেছেন। এই সময়ে ডিআইজি অপারেশন্স হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী আনোয়ার হোসেন পরবর্তীতে ডিআইজি চট্টগ্রাম রেঞ্জ হিসেবে পদায়িত হয়েছিলেন। এ কর্মকর্তা ২০২৪ সালের একতরফা নির্বাচন অনুষ্ঠানসহ নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ে ২৮ অক্টোবর ২০২৩ সালে বিএনপি নয়াপল্টনের সমাবেশ ভণ্ডুলসহ বিরোধী দলের আন্দোলন সংগ্রাম সরকার ও শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তাদের বিভিন্ন অবৈধ আদেশ সারা দেশে গোপনীয়ভাবে প্রেরণসহ বাস্তবায়নের রিপোর্ট তৈরি করেন। আস্থাভাজন গুটিকয়েক কর্মকর্তার সাথে প্রতিনিয়ত গোপন বৈঠকসহ সরকারবিরোধী আন্দোলনে জড়িতদের গ্রেফতার, হয়রানি, গায়েবি মামলা, বিভিন্ন নাশকতার গোপন ফাঁদ তৈরিসহ একতরফা নির্বাচন, মধ্যরাতের নির্বাচন ও ভোটারবিহীন নির্বাচনের পুলিশি সিন্ডিকেটের অত্যন্ত আস্থাভাজন হিসেবে কাজ করে তিনি গত ২০ বছর একনাগাড়ে পুলিশ সদর দফতরে পদায়িত হয়ে নিয়মিত পদোন্নতি নিয়েছেন। ২০১৮ এবং ২০২৪ সালের মধ্যরাতের একতরফা নির্বাচনের সহযোগী হিসেবে কর্মরত পুলিশ সদর দফতরে ৩৩ ব্যাচের কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আবু তাহের, ২৭ ব্যাচের কর্মকর্তা মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম (যিনি বর্তমানে পুলিশ সুপার সাতক্ষীরা হিসেবে পদায়িত হয়েছে), ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা আব্দুলাহ আল মামুন (যিনি অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিসহ বর্তমান মিশনে কর্মরত), ৩৩ ব্যাচের কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইশরাত জাহান, ২৪ ব্যাচের কর্মকর্তা অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ জিয়াউর রহমান, অতিরিক্ত ডিআইজি মাহফুজা আক্তার, পিপিএম অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ খোরশেদ আলম, অতিরিক্ত ডিআইজি মো: আবু হাসান, অতিরিক্ত ডিআইজি মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান, অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতিপ্রাপ্ত ও বর্তমানে গাইবান্ধার পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত মোশাররফ হোসেন, ২৮ ব্যাচের কর্মকর্তা এআইজি মোহাম্মদ মনিরুল ইসলাম, ৩০ ব্যাচের কর্মকর্তা ফেরদৌসী রহমান, ৩১ ব্যাচের কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার তানিয়া সুলতানা (যিনি সম্প্রতি এডিসি ডিএমপি হিসেবে পদায়িত)সহ অন্যান্য কর্মকর্তারা পতিত সরকারের সময় শীর্ষ দলবাজ পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছেন। পুলিশ সদর দফতরের গোপনীয় ও এলআইসি শাখার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারদের প্রায় সব কর্মকর্তা গত ১৫ বছরের আওয়ামী লীগ শাসনামলের বিরোধী দল দমনের গোপনীয় নির্দেশনার সমন্বয়, গ্রেফতার ও ধরপাকড়ের নির্দেশনা তৈরি ও বাস্তবায়ন করেছেন। তাদের অনেকে বিএনপিসহ বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গোপন ভয়েস রেকর্ড আড়িপাতার কাজে জড়িত ছিলেন। ৫ আগস্টের ছাত্র গণ-অভ্যুত্থানের পর এই কর্মকর্তাদের সবাই পুলিশের অত্যন্ত গোপনীয় ও সংবেদনশীল এলআইসি (ল ইন্টারসেপ্সন্স সেল) শাখায় কর্মরত থাকায় বৈষম্যের শিকার কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।
অধিকন্তু বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও বুয়েটে ছাত্রলীগের পদধারী ৩০ ব্যাচের কর্মকর্তা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো: মাহবুবর রহমান, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইমরান আহমেদ, মোহাম্মদ হাসিনুজ্জামান দীর্ঘদিন যাবৎ সদর দফতরের ডেভেলপমেন্ট শাখায় কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তার ছত্রছায়ায় এখনো কর্মরত আছেন। সদর দফতরের বদলি ও পদায়ন শাখায় কর্মরত অতিরিক্ত ডিআইজি মো: মাহবুবুল করিম ২০১৮ সালে পুলিশ সুপার পদে পদোন্নতি পরবর্তী রাংক ব্যাজ পরিধান অনুষ্ঠানে শেখ মুজিবুর রহমানসহ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অত্যন্ত আবেগপ্রবণ বক্তব্য দিয়ে আলোচিত হলেও ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে দ্রুত জাতীয়তাবাদী ঘরানায় নিজের নাম যুক্ত করে গুরুত্বপূর্ণ পদায়ন পেয়েছেন।
৫ আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে যেসব অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ও সহকারী পুলিশ সুপাররা বদলি ও পদায়ন শাখায় শীর্ষ গুটিবাজ পুলিশ কর্মকর্তাদের অত্যন্ত আস্থাভাজন হিসেবে পদায়িত ছিলেন ওইসব কর্মকর্তা বর্তমানেও স্বপদে বহাল থাকায় নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।


আরো সংবাদ



premium cement