২৬ অক্টোবর ২০২৪, ১০ কার্তিক ১৪৩১, ২২ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

জননেত্রী পরিষদ নেতার প্লট বিক্রির নামে প্রতারণা

শতাধিক ব্যক্তির কোটি কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা
-

জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদের নেতা, গ্রেটওয়াল ল্যান্ড প্রোপার্টিজ লিমিটেডের এমডি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে প্লট বিক্রির নামে গ্রাহকদের সাথে প্রতারণা ও কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। স্বপ্নের আবাসনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্লট বিক্রির কথা বলে গ্রাহকদের কাছে থেকে কোটি কোটি টাকা নিয়ে মোয়াজ্জেম হোসেন এখন লাপাত্তা। এ ছাড়া মোয়াজ্জেমের বিরুদ্ধে অংশীদারদের ব্যবসায়ের অংশ আত্মসাৎ, আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়া, রাজনৈতিক পরিচয় প্রদর্শন করে সংখ্যালঘুদের জমি দখলের অভিযোগও পাওয়া গেছে।
ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) পূর্বাচল নতুন শহর প্রকল্পের পাশে ‘গ্রেটওয়াল ল্যান্ড প্রোপার্টিজ লিমিটেড’ নামে একটি আবাসন প্রকল্প চালু করে। গত প্রায় দেড়যুগে শতাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন মোয়াজ্জেম হোসেন। একযুগ আগে প্লটের নির্ধারিত পুরো টাকা পরিশোধ করেও এখন পর্যন্ত প্লট বুঝে পাননি গ্রাহকরা। এরই মধ্যে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর আওয়ামী লীগের এই নেতাকে আর খুঁজে পাচ্ছেন না গ্রাহকরা।
গ্রাহকদের অভিযোগ, গ্রাহকদের প্লট না দেয়ার কৌশল হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির এমডি মোয়াজ্জেম হোসেন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করতেন। নিজেকে ‘জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদের’ কার্যকরী সভাপতি বলে দাবি করতেন। এ ছাড়া মোঘল সম্রাটদের অনুকরণে নিজেই ‘জয়বাংলা বাবুল’ নাম ধারণ করেছেন। এ ছাড়া তিনি বরিশাল বিভাগ উন্নয়ন ফোরামের সভাপতি পরিচয় দিতেন। এই প্রভাব খাটিয়ে তিনি গ্রাহকদের মামলা ও হয়রানির ভয়ভীতি দেখাতেন। যারাই প্লট বুঝিয়ে দেয়ার জন্য যেতেন, তাদের নানাভাবে হুমকি দিতেন। গ্রাহকরা জানান, নিজের আধিপত্য বিস্তারে সাবেক সরকার প্রধানের সাথে তার সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে তা প্রমাণ করতে বিভিন্ন ছবি প্রচার করতেন। ফলে তার অপকর্মের প্রতিবাদ করার সাহস কেউ করতেন না।
প্লট ক্রেতা ভুক্তভোগী মোহাম্মদ শওকাত কাদের চৌধুরী জানান, গ্রেটওয়াল ল্যান্ড প্রোপার্টিজ লিমিটেডের ( গ্রাহক আইডি নম্বর ১১৯-১৮১) প্রকল্পটির বি-১৫৯ নম্বরে ৪ কাঠার একটি প্লটের জন্য নির্ধারিত ১০ লাখ ৮০ হাজার টাকার মধ্যে তিনি পরিশোধ করেছেন ৯ লাখ ৮০ হাজার। বাকি রয়েছে ১ লাখ টাকা। আরেক গ্রাহক সেলিম রশীদ খান জানান, (আইডি-১১৯-১২১, ব্লক-০২, প্লট সি-৩৬০-৩৬১) একটি ৫ কাঠার প্লটের মূল্য পরিশোধ করেছেন ১০ লাখ ৪৯ হাজার ৯০০ টাকা। গ্রাহক হাফিজ রশীদ খান (আইডি-১০৮-০২৫, প্লট ডি-৭২) একটি ৩ কাঠার প্লটের জন্য দিয়েছেন ৫ লাখ ৮৩ হাজার ৭৫০ টাকা। সামিয়া হাসান (আইডি ১১৯-১২২, প্লট-ডি-৭০-৭১) একটি ৬ কাঠার প্লটের জন্য দিয়েছেন ১২ লাখ ৬০ হাজার টাকা। সাখাওয়াত হোসেন বিশ^াস (আইডি ১১৯-১২০, প্লট-ডি-৭৩) ৩ কাঠা প্লটের জন্য দিয়েছেন ৬ লাখ ৩০ হাজার টাকা। এখন পর্যন্ত তারা কেউই প্লট বুঝে পাননি।
প্লট ক্রেতা ফারজানা ইসলাম অভিযোগ করেন, ২০০৭ সালে তিনি গ্রেটওয়াল ল্যান্ড প্রোপার্টিজ লিমিটেডের সাথে চুক্তি করেন। ৫ কাঠা প্লটের জন্য ১০ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়েছেন। কিস্তির মাধ্যমে ২০১২ সালে সব টাকা শোধ করার পরও প্লট বুঝিয়ে দেয়নি। টাকা চাইলে তারা ভয় দেখাত। তাদের অফিসই এখন ঠিক নেই। কখনো রূপগঞ্জ, কখনো নারায়ণগঞ্জ উল্লেখ করে। সরকার পতনের পর এখন আর কোনো যোগাযোগ করতে পারছেন না।
আরেক গ্রাহক শামীমা নাসরিন অভিযোগ করেন, ২০০৭ সালের ২৫ জানুয়ারি প্রথম কিস্তি প্রদান করেন। এরপর ২০১২ সালের ২৫ জানুয়ারি সব কিস্তি শোধ করলেও তারা প্লট বুঝিয়ে দেয়নি। বারবার বলার পরও প্লট দিচ্ছে না। আবার টাকাও ফেরত দিচ্ছে না। গ্রেটওয়াল ল্যান্ড প্রোপার্টিজ কখন কোথায় অফিস করে, কিছুই জানে না গ্রাহকরা। এক সময় তার অফিস ছিল বারিধারা ২৭৫ নম্বর বাসায়। এখন কোথায় আছে কেউ জানে না।
টাকা দিয়েও প্লট না পাওয়া গ্রাহক আনিসুজ্জামান খান শাহীন বলেন, গ্রেটওয়াল ল্যান্ড প্রোপার্টিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আওয়ামী লীগের দাপট দেখাতেন। তার কাছে প্লট বুঝিয়ে দেয়ার জন্য বললেই তিনি মামলার ভয় দেখাতেন। শেখ হাসিনার আমলে তিনি প্রভাব খাটিয়ে সমস্ত অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন।
বিতর্কিত ২০১৮ সালের নির্বাচনে বরিশাল-২ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হওয়ার জন্য ব্যাপক প্রচার চালিয়েছিলেন গ্রেটওয়ালের এমডি মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি প্লট ও টাকা নিয়ে উধাও হওয়ায় মো: আনিসুজ্জামান খান শাহীন ক্যান্টনমেন্ট থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন (জিডি নং-১৭৬৮, ৩০/৯/২০২৪)। জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, পূর্বাচল লেকভিউ সিটিতে ব্লক-০২-এ সি-১৩৭ ও সি ১৩৮ নম্বরের ৫ কাঠা আয়তনের প্লট কেনার জন্য বিবাদি মোয়াজ্জেম হোসেনের সাথে ৩০০ টাকার সরকারি স্ট্যাম্পে চুক্তি সই হয়। এ সময় ৩ লাখ ১৫ হাজার টাকা দেন তিনি। মোয়াজ্জেমের তৎকালীন বারিধারার ডিওএইচএসের ৪ নম্বর রোডের ২৭৫ নম্বর বাসায় অবস্থিত গ্রেটওয়াল ল্যান্ড প্রোপার্টিজের অফিসে এই চুক্তি করা হয়। চুক্তি অনুযায়ী ২০১৯ সালে প্লট বুঝিয়ে দেয়ার কথা ছিল। গত ২ আগস্ট মোয়াজ্জেম হোসেনের কাছে টাকা চাইলে তিনি দেবেন না বলে জানান। এ সময় বাদিকে ভয়ভীতি দেখান। এ জন্য নিজের জীবনের নিরাপত্তা চেয়ে আনিসুজ্জামান খান শাহীন থানায় জিডি করেন।
অভিযোগ রয়েছে, গ্রাহকের কাছ থেকে টাকা নিয়ে প্লট বুঝিয়ে না দিয়ে প্রকল্পের বড় অংশ অপর একটি আবাসনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন মোয়াজ্জেম হোসেন। এ ছাড়া জননেত্রী শেখ হাসিনা পরিষদের কার্যকরী সভাপতি পরিচয়ে ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়ায় কাঁন্দি ইউনিয়নে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ও সরকারের খাসজমি দখলের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক পদ ব্যবহার করে গাজীপুরের বন বিভাগের খাসজমিও দখল করেছেন বলে অভিযোগ মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে এম মোয়াজ্জেম হোসেনের মোবাইল ফোনে কল করা হলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল