২৫ অক্টোবর ২০২৪, ৯ কার্তিক ১৪৩১, ২১ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

ছাত্রলীগ নিষিদ্ধ করা বিপ্লবের আকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন : বিএনপি

বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে প্রেস ব্রিফিং করেন রুহুল কবির রিজভী : নয়া দিগন্ত -

রাষ্ট্রপতি মো: সাহাবুদ্দিনের অপসারণ ইস্যুর রেশ কাটতে না কাটতেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবির মুখে ‘সন্ত্রাসী’ কাজে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকারের এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে বিএনপি। একইসাথে দলটি বলছে, এটি একটি সাহসী ও বিপ্লবী সিদ্ধান্ত। আওয়ামী লীগের শাসনামলে বিগত দেড় দশকে ছাত্রলীগকে রাষ্ট্রীয় মদদে একটি দানব বাহিনীতে পরিণত করা হয়েছিল। বিএনপির দাবি, ছাত্রলীগের কর্মকাণ্ডই তাদেরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি দিয়েছে। সুতরাং সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করার মধ্য দিয়ে জনআকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটেছে।
ছাত্রলীগকে ২০০৯ সালের সন্ত্রাসবিরোধী আইন অনুযায়ী ‘সন্ত্রাসী সত্তা’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করে গত বুধবার প্রজ্ঞাপন জারি করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এতে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের এই ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠনের বিরুদ্ধে কোটা সংস্কার ও সরকার পতন আন্দোলন চলাকালে ছাত্র-জনতা ‘হত্যা’ ও অসংখ্য মানুষের জীবন বিপন্ন করা এবং বিভিন্ন সময় ‘সন্ত্রাসী’ কাজে জড়িত থাকার অভিযোগ আনা হয়েছে।
বিএনপি মনে করে, স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন ছাত্রলীগের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা থাকলেও স্বৈরাচারী সরকারের ছত্রছায়ায় দীর্ঘ সময়ব্যাপী হত্যাকাণ্ডসহ নানা ধরনের সহিংসতায় জড়িত হওয়ায় সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার। এই সিদ্ধান্তটি খুবই যৌক্তিক ও যথাযথ, জনগণের আকাক্সক্ষার সাথেও সঙ্গতিপূর্ণ।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হল থেকে ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ’ নাম নিয়ে শুরু করা সংগঠন ধাপে ধাপে পাল্টে স্বাধীনতার পর ‘বাংলাদেশ ছাত্রলীগ’ নামধারণ করে। পাকিস্তান আমলে ছাত্র অধিকার আন্দোলন ও স্বাধিকার আন্দোলনে ছাত্রলীগ ছিল নেতৃত্বের ভূমিকায়। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় পরিস্থিতি পাল্টাতে থাকে। নানা ঘটনায় সমালোচনায় পড়তে হয় সংগঠনটিকে। ২০০৯ সাল থেকে টানা ১৫ বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালে কমিটি বাণিজ্য ও চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজিসহ নানা অনিয়মে সংগঠনটির নাম জড়ায়। চাঁদাবাজির অভিযোগে ২০১৯ সালে সমালোচনার মুখে থাকা সভাপতি রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানীকে ছাত্রলীগের নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। ২০১২ সালে দর্জি দোকানের কর্মী বিশ্বজিৎ দাস হত্যাকাণ্ড, একই বছর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ছাত্র জুবায়ের আহমেদ হত্যাকাণ্ড, ২০১৯ সালে বুয়েটে আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডে ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের সাজাও হয়েছে। সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে ২০১৮ সালে আন্দোলন শুরু হলে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালান ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা। একই দাবিতে ২০২৪ সালে আবার আন্দোলন শুরু হলে গত ১৫ জুলাই শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ। ওই দিনই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছিলেন, ক্যাম্পাসে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ হয়েছে, তার জবাব দেয়ার জন্য ছাত্রলীগ প্রস্তুত। জুলাইয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের হামলার পরই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সহিংস রূপ পায়। আন্দোলন দমাতে প্রকাশ্যে রাজপথে সংগঠনটির সশস্ত্র কর্মীদের কর্মকাণ্ডের ছবি সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশিত হয়।
ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দাবি ছিল ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করা। দাবি মানতে সম্প্রতি সরকারকে আলটিমেটামও দিয়েছিলেন তারা। নির্ধারিত সময়সীমা শেষ হওয়ার আগেই ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করল সরকার। নিষিদ্ধ করার ফলে এই সংগঠনটি আর কোনো সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে পারবে না। ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধের ঘটনায় ছাত্রদলসহ সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠনগুলো আনন্দ প্রকাশ করেছে। বিভিন্ন জায়গায় আনন্দ মিছিল হয়েছে। একইসাথে ছাত্রলীগকে দেখামাত্রই তাদেরকে পুলিশে সোপর্দ করার কথাও বলেছে তারা। ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির বলেন, ছাত্রলীগ একটি খুনি সংগঠন। খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, ভোট ডাকাতি থেকে শুরু করে গণহত্যার মতো মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে ছাত্রলীগ। সবগুলো জঙ্গি সংগঠন মিলে যত মানুষ খুন করেছে- ছাত্রলীগ এককভাবে তার চেয়ে বেশি মানুষ খুন করেছে। ২০০৯ সাল থেকে সারা দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী তাণ্ডবের বিরুদ্ধে ছাত্রদল প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। এতে ছাত্রলীগ এবং সরকারি বাহিনীর হাতে ছাত্রদলের শতাধিক নেতাকর্মী গুমের শিকার হয়েছে এবং শহীদ হয়েছে। ছাত্রলীগ ছাত্র রাজনীতির ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছিল। ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড থেকে রেহাই পেতে যখন বিভিন্ন মহল থেকে বুয়েটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠেছিল, তখন ছাত্রদল শুধু সন্ত্রাসী ছাত্রলীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দারি করেছিল। আজ ছাত্রলীগের রাজনীতি নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে ছাত্ররাজনীতি কলঙ্কমুক্ত হয়েছে। গণতন্ত্রকামী সব ছাত্রসংগঠন এবং সাধারণ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক পরিবেশে সুস্থ ধারার রাজনীতি চর্চার পথ উন্মুক্ত হয়েছে।
আলাপকালে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে তালিকাভুক্ত করে নিষিদ্ধ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ জন্য সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। এটা জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের আকাক্সক্ষা ছিল। তিনি বলেন, বর্বর হানাদার বাহিনীর মতো এরা বাংলাদেশের আন্দোলনকামী জনগণের ওপরে অত্যাচার-নির্যাতন, নির্বিচারে গুলি এবং হত্যা করেছে। বিগত কয়েক দশক ধরে ছাত্রলীগের ঐতিহ্য তাই। ফলে এই জাতি ছাত্রলীগকে কোনো ঐতিহ্যবাহী সংগঠন মনে করে না, বরং তাদেরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবেই মনে করে।
বিএনপির এই নেতা বলেন, এটা ঠিক- স্বাধীনতা-পূর্ববর্তী সময়ে ছাত্রলীগের একটা গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসে এক সময় তাদের ভূমিকা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ক্রমেই এই সংগঠনটি নানা অপকর্মের মধ্য দিয়ে একটি ভয়ানক সন্ত্রাসী সংগঠনে পরিণত হয়েছে, যেটি চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে বিগত ফ্যাসিবাদের সময়ে। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের শাসনামলের দিকে তাকালে দেখবেন- এই সময়ে প্রায় প্রত্যেক দিন ছাত্রলীগের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ইতিহাস পাওয়া যাবে। সুতরাং ছাত্রলীগকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে জাতীয় এবং আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতি দিয়েছে তাদের কর্মকাণ্ডই। ফলে ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করায় জাতির আকাক্সক্ষা পূরণ হয়েছে। এতে সারা জাতি খুশি, তারা এই সরকারের কাছে কৃতজ্ঞ থাকবে।
এ দিকে ছাত্র-জনতার ওপর গণহত্যা চালানোর দায়ে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন মহল থেকে ছাত্রলীগের অভিভাবক সংগঠন আওয়ামী লীগকেও নিষিদ্ধ করার দাবি উঠেছে। তবে সরকার এ ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি। ছাত্রলীগ নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তকে বিএনপি স্বাগত জানালেও মোটা দাগে কোনো রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধের পক্ষে নয়। দলটি মনে করে, দায়ী নেতাদের অপরাধের বিচার হতে পারে, কিন্তু দলকে নিষিদ্ধ করে কার্যত খুব ভালো ফল পাওয়া যায় না।


আরো সংবাদ



premium cement