‘আয়নাঘর’ দুঃস্বপ্নের এক অনিশ্চিত কারাবাস
- নয়া দিগন্ত ডেস্ক
- ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ০০:০০
যখন জেলাররা ভোরের আগেই কারাগারে ঢুকে পড়ল, বন্দীটি ভাবলো তার জীবন সম্ভবত এখানেই শেষ। আট বছর ধরে তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল একটি আন্ডারগ্রাউন্ড জেলের জানালাহীন প্রকোষ্ঠে। যেখানে অন্ধকার রাতের কোনো শেষ নেই। জেলের রক্ষীরা তাকে তার প্রার্থনা শেষ করার নির্দেশ দিলো। তারপর তার চোখবন্ধনী ও ধাতব হাতকড়া খুলে ফেলল এবং তার হাতের কব্জি কাপড় দিয়ে বেঁধে দিলো। তারপর তারা সেই বন্দীকে দু’জন লোকের পায়ের নিচে একটি মিনিভ্যানের মেঝেতে এমনভাবে শুইয়ে দিলো যাতে দেখা না যায়। এরপর এক ঘণ্টার যাত্রার উদ্দেশে রওনা দিলো। কিন্তু বাংলাদেশে আগের অনেক রাজনৈতিক বন্দীর মতো, মীর আহমদ কাসেম আরমানকে হত্যা করার জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল না। পরিবর্তে তাকে রাজধানী ঢাকার প্রান্তে একটি মাঠে নামিয়ে দেয়া হয়েছিল।
অনেক পরিবর্তন হয়েছে : নতুন হাইওয়ে, পাতাল রেল। কিন্তু আরমান সর্বশেষ এবং সব থেকে বড় পরিবর্তন সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যিনি গত ১৫ বছর লোহার মুষ্টি এবং প্রতিহিংসামূলক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেশ শাসন করছিলেন বিক্ষোভকারীরা তার বাসস্থানে (গণভবন) হামলা চালানোর আগেই তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। আরমান ২০১৬ সালে আধাসামরিক বাহিনীর হাতে নিখোঁজ হওয়ার সময় একজন সচ্ছল আইনজীবী ছিলেন। হাসিনার পতন তার ১৮ কোটি মানুষের দেশকে নতুন স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দিয়েছে। সময়ের সাথে সাথে তিনি কর্তৃত্ববাদ এবং দমন-পীড়নের পথ অবলম্বন করেছিলেন। সামনে আসা যে কোনো চ্যালেঞ্জকে মোকাবেলা করতে রাষ্ট্রযন্ত্রকে হাতিয়ার করেন। যার অন্যতম ছিল জোরপূর্বক গুম। তার নিরাপত্তা বাহিনী দ্বারা অপহৃত হওয়ার পর শত শত মানুষ কোনো চিহ্ন ছাড়াই অদৃশ্য হয়ে গেছে। কিছু ক্ষেত্রে ছোটখাটো রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপের জন্যও তাদের টার্গেট করা হয়েছে। যেমন বিরোধী সমাবেশ সংঘটিত করা, প্রতিবাদে রাস্তা অবরোধ করা বা সোশ্যাল মিডিয়াতে কোনো সমালোচনামূলক বার্তা পোস্ট করা। নিহতদের অনেককে হত্যা করে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। বাকিদের একটি আন্ডারগ্রাউন্ড মিলিটারি ডিটেনশন সেন্টারে দৃষ্টির বাইরে রাখা হয়েছিল, যাতে তারা নিজেরাই উন্মাদ হয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে যেতে পারে। সেই কারাগারের কোড-নাম ছিল ‘হাউজ অব মিররস’ বা ‘আয়নাঘর’। দ্য টাইমস আরমান এবং আগস্টে মুক্তি পাওয়া অন্য একজন বন্দীসহ দুই ডজনেরও বেশি লোকের সাক্ষাৎকার নিয়ে হাসিনার গোপন ডেরার গল্প প্রকাশ্যে এনেছে। সেইসাথে বর্তমান এবং সাবেক সরকারি কর্মকর্তারা, নিরাপত্তা প্রধান, কূটনীতিক এবং মানবাধিকার কর্মীরাও মুখ খুলেছেন যাদের একসময় নীরব করে রাখা হয়েছিল।
এটি ধ্বংস হয়ে যাওয়া পরিবারগুলোর একটি গল্প
আগস্টে মুক্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে একজন বারবার সংজ্ঞা হারাচ্ছিলেন যখন জানতে পারেন যে তাকে মৃত বলে ধরে নিয়ে তার স্ত্রী আবার বিয়ে করেছেন। আরেকজন জানতে পারেন যে তার বাবা তার নিখোঁজ হওয়ার সূত্র খুঁজতে বছরের পর বছর দ্বারে দ্বারে ঘুরে অবশেষে মৃত্যুকে বরণ করে নেন। কয়েক ডজন যারা নিখোঁজ হয়ে গেছেন তাদের পরিবার এখনো তাদের অপেক্ষায় রয়েছেন যদি কোনো দিন ঘরের লোকটি ফিরে আসে। এমনকি সরকারি দমন-পীড়ন এবং ভয় দেখানোর পরেও তারা আশা ছাড়েননি। তারা চান, হয় তাদের ছেলে, ভাই যারা নিখোঁজ তাদের ফিরিয়ে আনা হোক নতুবা মনের ক্ষতে প্রলেপ লাগাতে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হোক। ‘কী হয়েছে আমরা সবটা জানতে চাই?’ বলছেন তাসনিম শিপ্রা, যার চাচা বেলাল হোসেন ২০১৩ সালে নিখোঁজ হয়ে গেছেন।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনা যখন ক্ষমতায় ফিরে আসেন তখন তিনি বাবার মতো নিজের কঠোর হাতে দেশের নিয়ন্ত্রণ তুলে নেন। হাসিনা দমন-পীড়ন অভিযানে বেশ কিছু নিরাপত্তা বাহিনীকে নিয়োগ দেন। সেইসাথে বিরোধীদের হত্যা ও নির্মূল করতে তিনি অভিজাত পুলিশ এবং আধাসামরিক ইউনিটকে ব্যবহার করেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতে হাসিনা র্যাবকে রূপান্তরিত করেছিলেন ‘ইন-হাউজ ডেথ স্কোয়াড’ হিসেবে। ২০০৯ থেকে এ বছর পর্যন্ত ৭০০ জনেরও বেশি লোককে জোর করে গুম করা হয়েছে। পরিচিত নিখোঁজদের মধ্যে প্রায় ৪৫০ জন পরে ফিরে এসেছেন। ৮০টি পরিবার শুধুমাত্র তাদের আপনজনের লাশ হাতে পেয়েছিল, প্রায় ১৫০ ভুক্তভোগীর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি।
অভিযোগ রয়েছে সামরিক বাহিনী হাসিনার বর্বরোচিত কাজে সহায়তা করে এসেছে। তিনি তার এক আত্মীয় অবসরপ্রাপ্ত জেনারেলকে সামরিক বিষয়গুলো সমন্বয়ের দায়িত্বে নিযুক্ত করেছিলেন। তিনি সেনার বিশ্বস্ততা নিশ্চিত করতে শীর্ষস্থানীয় ব্যক্তিদের দরাজ হাতে অর্থ বিলানোর পরামর্শ দিতেন। আবদুল্লাহিল আমান আজমীর আট বছরের বন্দিজীবনে ৪১,০০০ বার চোখ তাকে বেঁধে হাতকড়া পরানো হয়েছিল। আজমী বলছেন, আমি সৃষ্টিকর্তার তৈরি আকাশ, সূর্য, চাঁদ, গাছ দীর্ঘদিন দেখিনি। একবার একটা ছোট ঘুলঘুলি দিয়ে কিছুটা সূর্যালোক দেখার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তারা সিসিটিভি ক্যামেরার মাধ্যমে জানতে পেরে সেগুলো বন্ধ করে দেয়।
অফিসারদের আবাসিক কোয়ার্টার এই আয়নাঘরের কাছাকাছিই ছিল। আমান বলছেন ‘প্রতি শুক্রবার, আমি শিশুদের গান শুনতে পেতাম। আমাকে ভারতে থাকার বিষয়টি নিয়ে বারবার জিজ্ঞাসা করা হচ্ছিলো এবং মুখে বারবার ঘুষি মেরে দুটি দাঁত ভেঙে দেয়া হয়েছিল।
হাসিনা সরকার ১৯৭১ সালে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মীর কাসেম আলীকে ফাঁসিতে ঝুলানোর আগে আরমানকে কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। মীর কাসেম আলী বাংলাদেশ সৃষ্টির বিরোধিতাকারী একটি ইসলামিক দলের কিশোর ছাত্রনেতা ছিলেন। আলীকে হাসিনার জন্য বিশেষভাবে হুমকি হিসেবে দেখা হয়েছিল। কারণ তিনি একটি বৃহৎ এবং লাভজনক ব্যবসা গড়েছিলেন : একটি ব্যাংক, একটি মিডিয়া নেটওয়ার্ক, হাসপাতাল। আরমান তার বাবার কথা বলতে গিয়ে জানাচ্ছেন, আমার বাবার একটি দিনও জেলে কাটানোর কথা নয়, ফাঁসি তো দূরের কথা। বছরের পর বছর যন্ত্রণা এবং অনিশ্চয়তার পর আরমান হাসপাতাল থেকে ফিরে অবশেষে তার স্ত্রী, কন্যা এবং মায়ের সাথে আবার মিলিত হতে সক্ষম হন। কিন্তু বাবার মৃত্যুদণ্ড, পারিবারিক জীবন থেকে চুরি হয়ে যাওয়া বেশ কয়েকটি বছর আর দুর্ব্যবহার- যা হয়তো ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। (সংক্ষেপিত)
আরো সংবাদ
-
- ৫ঃ ৪০
- খেলা