১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩০, ১৫ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

খুনাখুনি বাড়ছে ৯ মাসে নিহত ১৫৬ জন

-


গত ৩০ সেপ্টেম্বর বাসার সামনে আড্ডা দিচ্ছিলেন মো: রাসেল শিকদার (২৪)। পেশায় তিনি কাঁচামাল ব্যবসায়ী। রাত ৮টার দিকে রসুলপুর শাহী মসজিদ রোড দিয়ে যাওয়ার সময় কয়েকজন রাসেলকে এলোপাতাড়ি কুপিয়ে চলে যায়। তাকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যালে নিলে চিকিৎসকরা রাত ১০টার দিকে মৃত ঘোষণা করেন। গত বুধবার রাজধানীর মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে দুর্বৃত্তের গুলিতে শানেমাজ (৩৭) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। তিনি একটি রেস্টুরেন্টে চাকরি করতেন। দুই গ্রুপের গোলাগুলির মধ্যে রাত ১১টার দিকে গুলিবিদ্ধ হন শানেমাজ। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিলে চিকিৎসক রাত পৌনে ১২টার দিকে মৃত ঘোষণা করেন।

নিহতের বোন নাসরিন আক্তারের দাবি- রাতে কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলেন। তখন হুমায়ুন রোডে জালাল ডেকোরেটরের সামনে দুর্বৃত্তদের গুলিতে তার ভাই নিহত হন। আইন ও সালিস কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী গত জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ৭৫ জন। ৫২৫টি ঘটনায় আহত হয়েছেন ৪ হাজার ৮৩৫ জন। আর মব জাস্টিসের শিকার হয়ে গত ৯ মাসে নিহত হয়েছেন ৮১ জন।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলন চলাকালে গত ৫ আগস্ট গণ-অভ্যুত্থানের মুখে পড়ে পালাতে বাধ্য হন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সময় থানাগুলোতে ভাঙচুর ও হামলার ঘটনায় পুলিশ সদস্য নিহত হওয়ার পর আতঙ্কের সৃষ্টি হয় পুলিশের মধ্যে। কার্যত থানা হয়ে পড়ে অচল। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অপরাধীরা সক্রিয় হয়ে ওঠে। এমনকি পুরনো দ্বন্দ্বের জেরে শুরু হয় খুনোখুনি। আইন হাতে নিয়ে ‘চোর’ সন্দেহে পিটিয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এমন পরিস্থিতিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে পুলিশের।

নাগরিক কমিটি, সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা ও বিশেষজ্ঞদের মতে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে অপরাধপ্রবণতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে শুধু সামাজিক অস্থিরতাই প্রত্যক্ষ কারণ নয়, এর সাথে কোনো কোনো মহলের ক্ষমতা অপব্যবহারের মতো অনাকাক্সিক্ষত বিষয়গুলোও জড়িত। এই ধারার ঘটনা রুখতে একই সাথে সামাজিক আন্দোলন ও রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের তাগিদ দিয়েছেন তারা। এই পরিস্থিতি এখনই ঠেকাতে না পারলে ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের যে উদ্দেশ্য তা সম্পূর্ণ বৃথা যাবে বলে মন্তব্য করেছেন তারা। এখন পাড়া-মহল্লায় আগের মতো সৌহার্দ্য বা বন্ধুত্বমূলক সম্পর্কের অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে। এ কারণে পরস্পরের মধ্যে আস্থা, বিশ্বাস ও নিরাপদ সম্পর্ক না থাকায় তুচ্ছ কারণ বা ছোট ভুলে সহিংস হয়ে উঠছে। এর বাইরে পেশাগত পরিচয়ে আধিপত্য বিস্তারের কারণে একটি উচ্ছৃঙ্খল শ্রেণী তৈরি হওয়া একটি বড় কারণ। এ ধরনের ঘটনাকে তুচ্ছ বা ছোট হিসেবে বিবেচনা না করে প্রতিরোধে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সতর্ক ও সক্রিয় থাকতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ তৌহিদুল হক বলেন, ৫ আগস্টের পর অস্থিরতা ও সহিংসতার যে ঘটনাগুলো লক্ষ করা যাচ্ছে সেগুলো মানুষের মনে নানা ধরনের প্রশ্ন তৈরি করছে। ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক মতাদর্শের কারণে প্রতিহিংসা ও ক্ষোভ থাকতেই পারে। তবে আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার অধিকার কারো নেই। কারো বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে সেটি আইনের মাধ্যমে সমাধান করাটাই স্বস্তির বার্তা। এর ফলে শৃঙ্খলা বজায় থাকবে। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার প্রবণতা বাড়তে থাকলে ব্যক্তি ক্ষোভের প্রভাব বেশি পড়বে। সমাজে সহাবস্থানের ক্ষেত্রে আমাদের যেই প্রতিশ্রুতি বা অঙ্গীকার রয়েছে সেগুলোকে প্রাধান্য দিতে হবে। খুনোখুনি বা আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার ঘটনা যেখানেই হোক তা কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। নয়তো রাষ্ট্র সংস্কারকে কেন্দ্র করে সরকারের গৃহীত উদ্যোগগুলো নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন তৈরি করবে।

ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) মো: ইসরাইল হাওলাদার বলেন, পুলিশের টহল এখনো পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। যানবাহন সঙ্কট রয়েছে। যেখানে টহলে প্রতিটি থানায় ছয় থেকে আটটি গাড়ি চলাচল করত, বর্তমানে কোথাও কোথাও দুই থেকে তিনটি চলছে। যানবাহন সঙ্কটে আগের মতো টহলে বের হতে পারছে না পুলিশ। যার কারণে আইনশৃঙ্খলা কিছুটা অবনতি। তবে একেবারেই যে পুলিশ নেই তা ঠিক নয়। পুলিশের সক্ষমতা বাড়াতে সার্বক্ষণিক চেষ্টা চলছে। কার্যক্রম আরো ত্বরিত গতিতে চলছে। পুলিশের তৎপরতা বৃদ্ধির কারণে গত দুই মাসের তুলনায় অপরাধ অনেকটা কমে আসছে। এখন যেসব ঘটনায় খুনোখুনি হচ্ছে তার বেশির ভাগই হচ্ছে পুরনো দ্বন্দ্ব বা আধিপত্যের লড়াইয়ের কারণে।

 


আরো সংবাদ



premium cement