১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১ কার্তিক ১৪৩০, ১৩ রবিউস সানি ১৪৪৬
`
নাগালের বাইরে নিত্যপণ্য

সক্রিয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আওয়ামী সিন্ডিকেট

-


নিম্ন ও মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে গেছে নিত্যপণ্যের বাজার। দামের দিক থেকে সেঞ্চুরি করেছে কয়েক ধরনের সবজি। ওসব সবজি স্বাভাবিক সময়ে প্রতি কেজি ৫০ টাকার মধ্যে পাওয়া যেত। সবজি ছাড়াও ডিম, আলু, রসুন, পেঁয়াজসহ সবধনের নিত্যপণ্যের দামই আকাশ ছোঁয়া। এতে নিম্ন আয়ের মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। নিত্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের। কিন্তু এই মন্ত্রণালয়েল দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের অন্তর্বর্তী সরকারকে বিপদে ফেলতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘ দিন ধরে কর্মরত পতিত আওয়ামী সরকারের আস্থাভাজনরা এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্টরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিন্ডিকেটকে সুবিধা করে দিতে ভারসাম্য তৈরি থেকে বিরত থেকেছে পতিত আওয়ামী লীগ সরকার। ফলে কিছু কোম্পানিই পুরো বাজারে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। সরকারের ছায়াতলে থাকা এসব সিন্ডিকেট জনগণের পকেট থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। সিন্ডিকেটকে সহযোগিতা করে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদের মালিক হন সাবেক বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। সম্প্রতি পুলিশের হাতে গ্রেফতার হলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বহাল তবিয়তে আছে তার ১০ বছরের একান্ত সচিব মাসুকুর রহমান শিকদার।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব পদমর্যাদার একাধিক কর্মকর্তারা বলছেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে বসে প্রতিদিনই আওয়ামীপন্থী অফিসারদের নিয়ে বর্তমান সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে নানামুখী ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। একই অভিযোগ রয়েছে সচিবসহ আরো কয়েক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। আওয়ামী লীগের আস্থাভাজন হওয়ায় হাসিনার শেষ সময়ের বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটুর সাথেও প্রায় চার মাস একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করেছেন মাসুকুর রহমান। একান্ত সচিব থাকাকালীন নিত্যপণ্যের সিন্ডিকেটকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচারের অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে এই কর্মকর্তাকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে পদায়ন করা হয়। এর পর মাঝ খানে দুই বছর মাঠ প্রশাসকে দায়িত্ব পালন করে আবারো মন্ত্রীর পিএস হিসেবে যোগদান করে এখন পর্যন্ত প্রায় ১২ বছর ধরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে কর্মরত রয়েছে। অথচ সরকারি চাকরির নিয়মানুযায়ী এক স্টেশনে তিন বছরের বেশি চাকরি করার সুযোগ নেই।

সাবেক বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম টিটুর আস্থাভাজন বাণিজ্য সচিব মোহা: সেলিম উদ্দীন। মৎস ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত থাকাকালে তাকে পছন্দ করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নিয়ে আসেন। এর আগে তিনি বিদ্যুৎ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এবং পিডিবির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
পাঁচ বছরের বেশি সময় ধরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আছেন ঢাকা কলেজ ছাত্রলীগের নেতা মোহাম্মদ মশিউর রহমান। এর আগে গাজীপুরের এডিসি (এলএ) থাকাকালে তার বিরুদ্ধে এলএ শাখা ও বিভিন্ন ইউনিয়ন ভূমি অফিসে ব্যাপক ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। তার বিরুদ্ধে ভূমি মন্ত্রণালয়, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, বিভাগীয় কমিশনার ও দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখিত অভিযোগ পাওয়া গেলে বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয় থেকে জেলা প্রশাসককে তদন্তের নির্দেশ দেয়া দেয়। এরপর ২০২০ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রেষণ-১ অধিশাখা থেকে মশিউর রহমানকে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়ন ইউনিটে বদলি করা হলেও তাকে অবমুক্ত না করে চার মাস পর ৯ জুন বদলির আদেশ বাতিল করা হয়। এরপর ছাত্রলীগের এই নেতা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আসলে সেখানেও তার বিরুদ্ধে কয়েক কোটি টাকা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। অভিযোগ আমলে নিয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নির্দেশনা দেয় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। চার বছরের অধিক সময় ধরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে কর্মরত আছেন আওয়ামীপন্থী যুগ্ম সচিব ড. ফারহানা আইরিছ। গোপালগঞ্জের এই কর্মকর্তা বিসিএস উইমেন নেটওয়ার্কের সহসভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন (সিসিবি) পরিচালক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তারা জানান, পতিত আওয়ামী লীগ সরকার নিত্যপণ্যের লাগাম টেনে ধরতে ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত করে প্রতিযোগিতা কমিশন (সিসিবি)। কিন্তু আওয়ামী সরকারের কিছু মন্ত্রী সিন্ডিকেট প্রথা সচল রাখার জন্য এই কমিশনকে একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে। নিয়োগ দেয়া হয়েছিল আজ্ঞাবহ দলদাশ চেয়ারম্যান ও সদস্য। ইতোমধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্দেশনা অনুসারে চেয়ারম্যান পদত্যাগ করলেও প্রতিষ্ঠানটির চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া সদস্য সালমা আখতার জাহান এবং মো: হাফিজুর রহমান পদত্যাগ করেননি। প্রতিযোগিতা আইন ২০১২-এর আওতায় ২০১৬ সালে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন স্থাপন করা হয়েছে। সিন্ডিকেট ভাঙার ক্ষমতা এই প্রতিযোগিতা কমিশনকে দেয়া হয়েছে। তাদের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক জরিমানা করার। কোনো ব্যক্তি প্রতিযোগিতাবিরোধী চুক্তি সম্পাদন বা কর্তৃত্বময় অবস্থানের অপব্যবহার করলে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন সেই ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের মুনাফার ৩ (তিন) গুণ অথবা বিগত ৩ (তিন) অর্থবছরের গড় টার্নওভারের ১০ শতাংশ পর্যন্ত জরিমানা করার এখতিয়ার রাখে। একই সাথে বিভিন্ন পণ্যের ওপর প্রতিনিয়ত মার্কেট স্টাডি করাও তাদের দায়িত্ব।
কাজেই বাজারে যদি কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান মিলে সিন্ডিকেট তৈরি করে বাজারে প্রতিযোগিতা নষ্ট করে, তবে তা প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূলের দায়িত্ব মূলত বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের। কিন্তু আওয়ামী সরকারের অনুগত কর্মকর্তাদের এই প্রতিষ্ঠানে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ থাকায় তারা কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না।
এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব মোহা: সেলিম উদ্দীনের সাথে মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তাকে পাওয়া যায়নি।

 


আরো সংবাদ



premium cement