১৭ অক্টোবর ২০২৪, ১ কার্তিক ১৪৩০, ১৩ রবিউস সানি ১৪৪৬
`

এশিয়াজুড়ে ডিপফেক রোমান্স কেলেঙ্কারি : ৪৬ মিলিয়ন ডলার লুট

-

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে সুন্দরী মহিলার নকল কণ্ঠস্বরে টেলিফোনে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলা হয়। এরপর কায়দা করে ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেয়া হয় মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার। ৫৫২ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে অপরাধ চক্রটি। ফাঁদে জড়িয়ে পড়া পুরুষ বুঝতেই পারে না পুরো বিষয়টি অপরাধ চক্রের কারসাজি। ভুক্তভোগী বিপুল পরিমাণ অর্থ খুঁইয়ে টের পায় আদতে তাদের নতুন প্রেম বাস্তব ছিল না। এসব ভিডিওতে কোনো ব্যক্তিকে এমন কথা বলতে শোনা যায়, যা তারা আদতে বলেননি। এমন কাজ করতে দেখা যেতে পারে, যা তারা করেননি। ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় বিকৃত করা এসব ভিডিও কনটেন্ট প্রচলিত টেক্সট ও বিকৃত করা ছবির চেয়েও মারাত্মক। এসব ভুয়া ভিডিও ও তথ্য মানুষকে বেশি টানতে পারে। সিএনএন হংকংয়ের জেসি ইয়াং তার অনুসন্ধানি প্রতিবেদনে তুলে ধরেছেন এ ধরনের চাঞ্চল্যকর অপরাধ চক্রের কারসাজি।
হংকং পুলিশ ইতোমধ্যে কথিত কেলেঙ্কারি চক্রের দুই ডজনেরও বেশি সদস্যকে গ্রেফতার করেছে। তাইওয়ান, সিঙ্গাপুর এবং ভারত পর্যন্ত এ চক্র জাল বিস্তার করে আছে। হংকংয়ের হাং হোম জেলার ৪,০০০ বর্গফুট শিল্প ইউনিটে এই অপরাধ চক্রের অপারেটিং সেন্টারে অভিযান চালিয়ে প্রতারণার ষড়যন্ত্রসহ ২১ জন পুরুষ এবং ৬ মহিলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। কিন্তু তার আগে অন্তত ৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার হাতিয়ে নিয়েছে এ প্রতারক চক্র। ২১ থেকে ৩৪ বছর বয়সী, সন্দেহভাজনদের বেশির ভাগই সুশিক্ষিত, তাদের মধ্যে অনেকেই ডিজিটাল মিডিয়া এবং প্রযুক্তির ওপর স্নাতক শেষ করেছে। একটি জাল ক্রিপ্টোকারেন্সি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে বিদেশে আইটি বিশেষজ্ঞদের সাথে যোগসাজস রয়েছে তাদের। এবং এভাবেই ভুক্তভোগীদের ভুয়া বিনিয়োগ করতে বাধ্য করত অপরাধ চক্রটি।
ডিপফেক আসলে বাস্তবসম্মত জাল ভিডিও, অডিও এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সাহায্যে অন্যান্য সামগ্রী নিয়ে তৈরি। প্রযুক্তিটি বিভিন্ন ধরনের অপরাধ চক্র ব্যবহার করছে ক্রমবর্ধমানভাবে। অনলাইন স্ক্যামার ছাড়াও বিশ্বাসযোগ্য বিভ্রান্তি ছড়িয়ে অপরাধ চক্রের সদস্যরা শিকারকে ফাঁদে আটকায়। এ জন্য ব্যবহার করা হয় আকর্ষণীয় সুন্দরী মহিলা কণ্ঠস্বর। আসলে তা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে তৈরি। ভুক্তভোগী ধরতেই পারেন না যে কণ্ঠস্বরটি আসলে কোনো মহিলার নয়। ভুয়া বিনিয়োগে প্রলুব্ধ করাই তাদের কাজ। মিলিয়ন থেকে বিলিয়ন ডলারের এক অবৈধ শিল্প হয়ে উঠেছে ডিপফেক কেলেঙ্কারি। মিথ্যা অনলাইন পরিচয় দিয়ে ভুক্তভোগীদের আস্থায় আনতে তাদের বিনিয়োগের জন্য টার্গেট করে কয়েক মাস ব্যয় করা হয়। কৌশলে তাদের খোঁজ দেয়া হয় ভুয়া ক্রিপ্টো সাইটের। এ ধরনের ডিপফেক কেলেঙ্কারির শিকার সহজেই হয়ে পড়েন ধনাঢ্য বয়স্ক ব্যক্তিরা। তাদের নিসঙ্গতার সুযোগ নেয় অপরাধ চক্র। সাধারণত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বাইরে চীনা গ্যাং এ ধরনের অপরাধ চক্র পরিচালনায় সিদ্ধহস্ত। হংকং, একটি ধনী শহর যেখানে পুলিশ দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের টেলিফোন স্ক্যাম সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু অপরাধচক্র উন্নত ও সর্বশেষ ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করে অপরাধের ঝুঁকি বাড়িয়েই চলছে।

এই বছরের শুরুতে হংকংয়ের একটি ব্রিটিশ বহুজাতিক নকশা এবং প্রকৌশল সংস্থা প্রতারকদের কাছে ২৫ মিলিয়ন ডলার হারায়। সংস্থাটির একজন কর্মচারী তার প্রধান আর্থিক কর্মকর্তা এবং অন্যান্য কর্মীদের হিসাবে জাহির করার জন্য ডিপফেক প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রতারকদের খপ্পরে পড়েন। রোম্যান্স গ্যাংয়ের ডিপফেক কেলেঙ্কারিটি সাধারণত একটি টেক্সট বার্তা দিয়ে শুরু হয়, যেখানে প্রেরক- একজন আকর্ষণীয় মহিলা হিসাবে নিজেকে জাহির করে একপর্যায়ে জানায় যে সে ভুল করে ভুল নম্বরে যোগাযোগ করেছে। অভিযুক্ত স্ক্যামাররা তারপরে তাদের শিকারের সাথে অনলাইনে রোম্যান্স শুরু করে, যতক্ষণ না তারা একসাথে ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করা শুরু করে বা ভুয়া বিনিয়োগে রাজি না করায় ততক্ষণ পর্যন্ত ঘনিষ্ঠতার অনুভূতি জাগিয়ে তোলে।
এসব অপরাধ চক্র অত্যন্ত সংগঠিত, কেলেঙ্কারির বিভিন্নপর্যায়ে চৌকস। এমনকি ফেসবুকে ম্যানুয়ালটির কিছু অংশ পোস্ট করা থাকে। পুলিশ বলছে, ‘ভুক্তভোগীর আন্তরিকতা এবং আবেগের’ সুবিধা নিয়ে অপরাধ চক্রের সদস্যদের কীভাবে কাজটি চালাতে হয় তা শেখানোর জন্য তারা একটি প্রশিক্ষণ ম্যানুয়াল ব্যবহার করেছিল। প্রশিক্ষণে শিকারকে কিভাবে বিশ্বদর্শন সম্পর্কে শেখানো যায়, কিভাবে অন্য ব্যক্তির বিশ্বাসকে গভীর করতে’ ব্যর্থ সম্পর্ক বা ব্যবসার মতো অসুবিধাগুলো উদ্ভাবন করা যায় এবং আস্থায় এনে ভিকটিমকে বিনিয়োগে ঠেলে একসাথে ভ্রমণ পরিকল্পনাসহ একটি ‘সুন্দর স্বপ্ন’ আঁকা যায় তা শেখানো হয়। এ ধরনের কেলেঙ্কারি প্রায় এক বছর ধরে চালিয়ে আসছে অপরাধ চক্রের সদস্যরা। পুলিশ অভিযানে ১০০টিরও বেশি সেলফোন, প্রায় ২৬,০০০ ডলারের সমপরিমাণ নগদ এবং বেশ কয়েকটি বিলাসবহুল ঘড়ি উদ্ধার করে।
দ্বিতীয় ধাপে কথিত স্ক্যামাররা তাদের ফাঁদে পা দেয়া ব্যক্তিদের সাথে অনলাইনে প্রেমের অভিনয় শুরু করেন। ভবিষ্যৎ নিয়ে এক সাথে পরিকল্পনা শুরু করা পর্যন্ত এ স্ক্যামাররা ভুক্তভোগীদের মধ্যে ঘনিষ্ঠতার অনুভূতি জাগিয়ে তোলার চেষ্টা চালিয়ে যান। প্রতারণার বিভিন্ন ধাপের কার্যকলাপ পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছে বিভিন্ন শাখা। এমনকি চক্রের সদস্যদের প্রতারণায় দক্ষ করে তুলতে আয়োজন করা হয় প্রশিক্ষণ। শেখানো হয়, ফাঁদে পা দেয়া ব্যক্তির সরলতা ও অনুভূতি কিভাবে কাজে লাগাতে হয়, সেসব বিষয়েও। ফেসবুকে প্রশিক্ষণ ম্যানুয়ালের কিছু অংশ পোস্টও করেছে তারা। পুলিশ অভিযানে অপরাধ চক্রের কার্যালয় থেকে শতাধিক মুঠোফোন, নগদ প্রায় ২৬ হাজার ডলারের সমপরিমাণ অর্থ ও বেশ কিছু দামি ঘড়ি জব্দ করেছে।


আরো সংবাদ



premium cement